ইফতেখার আহমেদ টিপু

  ১৯ আগস্ট, ২০১৭

আশঙ্কা

ভয়াবহ বন্যার মুখে দেশ

বন্যা হঠাৎ করেই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে এবং পাঁচ দিন ধরে অন্তত ২০ জেলায় তার ছোবল অনুভূত হচ্ছে। উজান থেকে আসা ঢল এবং টানা বৃষ্টিপাতে প্রতিদিনই ডুবছে কোনো না কোনো জনপদ। বন্যায় ইতোমধ্যেই প্রাণ হারিয়েছে ৩০ জনেরও বেশি। বন্যাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করেই বাংলাদেশ নামের বদ্বীপের মানুষ টিকে আছে শত শত বছর ধরে। তবে এবার বন্যা যেভাবে এগিয়ে আসছে, তা উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো।

দ্য ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর মিডিয়াম রেঞ্জ ওয়েদার ফোরকাস্ট পূর্বাভাস দিয়েছে, এ বছর বিগত ২০০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় বন্যার আশঙ্কা রয়েছে। পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, আগামী ১০ দিনের মধ্যে ব্রহ্মপুত্রের ভারত ও বাংলাদেশ অংশে পানি বাড়বে। হিমালয়ের দক্ষিণাঞ্চলে ২০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে এবং এমনটি হলে নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি পাবে। গত শুক্রবার থেকে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় পানি বাড়ছে এবং ১৯ আগস্ট পর্যন্ত এ পানি ভাটির দিকে প্রবাহিত হবে। গত ২০০ বছরের বেশি সময়ের ইতিহাসে ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকার উজানে বন্যার মাত্রা সবচেয়ে বেশি।

আবহাওয়া বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে বর্তমানে টানা বৃষ্টি হচ্ছে। আর কদিন পর ২১ আগস্ট অমাবস্যা। আসামে বড় ধরনের বন্যা হওয়ায় সে পানি বাংলাদেশের দিকে ধেয়ে আসছে। যার প্রভাবে ব্রহ্মপুত্র ও পদ্মা অববাহিকায় পানি বাড়ছে। পদ্মা এখনো বিপৎসীমা অতিক্রম না করলেও পানি যেভাবে বাড়ছে, তাতে সহসাই তা বিপৎসীমা অতিক্রম করবে। দুই নদীর পানি একসঙ্গে বাড়ার কারণে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে। বাংলাদেশে চলতি বছর হাওর এলাকার বোরো ফসল ডুবে যায় আগাম বন্যায়। যার প্রতিক্রিয়ায় ১০ বছর পর বাংলাদেশ বড় ধরনের খাদ্য সংকটে পড়েছে। দেশের চাহিদা পূরণে কয়েক কোটি মণ চাল আমদানি করা হচ্ছে। বন্যার কারণে মার খেয়েছে সব ধরনের ফসল। তরি-তরকারির দাম আকাশচুম্বী হয়ে ওঠায় তা মানুষের জীবনমানে প্রভাব বিস্তার করছে।

টানা বৃষ্টি ও উজানের ঢলে সৃষ্ট বন্যা পরিস্থিতির দেশের কয়েকটি এলাকায় আরো অবনতি হয়েছে। নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় প্লাবিত হচ্ছে নতুন এলাকা। এতে লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে, ভেসে যাচ্ছে খামারের মাছ।

রংপুর : তিস্তার পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় গঙ্গাচড়া ও কাউনিয়া উপজেলার ৬৮ গ্রামের ৭০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি আরও অবনতির আশঙ্কায় অনেক এলাকার মানুষ নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিচ্ছে। তলিয়ে গেছে রোপা আমন ও সবজি ক্ষেত। ভেসে যাচ্ছে পুকুর-খামারের মাছ।

নীলফামারী : বুধবার রাতে শুরু হওয়া বৃষ্টিতে জেলা শহরের সওদাগড়পাড়া, বাবুপাড়া, প্রগতিপাড়া, নিউবাবুপাড়া, শাহীপাড়া, নতুন বাজার কলোনিসহ কয়েক এলাকার বাড়িঘর হাঁটুপানিতে তলিয়ে রয়েছে। শহরের অনেক রাস্তার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে পানি।

কুড়িগ্রাম : ধরলা, ব্রহ্মপুত্র, দুধকুমোর ও তিস্তাসহ কুড়িগ্রামের সবকটি নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। ধরলার পানি কুড়িগ্রাম ফেরিঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ৪১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম জানান, গত ১২ ঘণ্টায় ধরলার সেতু পয়েন্টে পানি ৫৭ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে নিম্নাঞ্চলের ২০০ গ্রামের লক্ষাধিক মানুষ। বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে ৬৯টি স্কুল।

গাইবান্ধা : তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘট ও করতোয়া নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। করতোয়ার পানি বৃদ্ধির ফলে গোবিন্দগঞ্জ ও পলাশবাড়ী উপজেলার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের কয়েকটি স্থানে মাটি সরে গেছে। করতোয়ার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের কয়েকটি পয়েন্ট ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

ঠাকুরগাঁও : পাঁচ উপজেলার কয়েক হাজার ঘরবাড়ি, ব্রিজ-কালভার্ট তলিয়ে গেছে। নষ্ট হচ্ছে ফসল। গবাদিপশুসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে বিপাকে পড়েছে লক্ষাধিক মানুষ। টাঙ্গন নদের পানি বিপৎসীমার ৪০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

লালমনিরহাট : ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি বৃদ্ধি পেয়ে গতকাল বিপৎসীমার ৩০ এবং ধরলার পানি কুলাঘাট পয়েন্টে ৪৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে তিস্তা ও ধরলা নদীর চরাঞ্চল ও নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। সদর উপজেলার মোগলহাটে পাউবোর দুটি বাঁধ ভেঙে ১৩ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ধসে গেছে পাটগ্রাম শহররক্ষা বাঁধটিও।

সিরাজগঞ্জ : যমুনার পানি সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে নিম্ন এলাকায় পানি ঢুকতে শুরু করেছে।

পঞ্চগড় : জেলা শহরসহ পাঁচ উপজেলা বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। করতোয়া, মহানন্দা, ডাহুক, ভেরসাসহ সব কটি নদ-নদীর পানি বেড়ে নদীপারের মানুষের ঘরবাড়ি ডুবে গেছে। বেশকিছু এলাকার মানুষ বিভিন্ন স্কুল-কলেজে আশ্রয় নিয়েছে।

দিনাজপুর : পুনর্ভবা ও আত্রাই নদীর পানি বিপদসীমা ছুঁই ছুঁই করছে। তলিয়ে গেছে নিচু এলাকা। খানসামা উপজেলার খামারপাড়া ইউনিয়নে ৯০০ বাড়িতে হাঁটুপানি জমেছে।

নালিতাবাড়ী : শেরপুরের নালিতাবাড়ীর সাত হাজার একর আমন ক্ষেত তলিয়ে গেছে। প্লাবিত হয়েছে পৌরসভাসহ ছয়টি ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা। ভোগাই নদীর হাতিপাগার, নয়াবিল, শিমুলতলা, খালভাংগা, নিজপাড়া এলাকা এবং চেল্লাখালি নদীর গোল্লাপারে বাঁধের ১০ স্থান ভেঙে পানি প্রবেশ করছে। ইতোমধ্যে অর্ধলক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

সুনামগঞ্জ : বিভিন্ন উপজেলায় সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পাশাপাশি পানিবন্দি হয়ে পড়েছে কয়েক লাখ মানুষ। সাত উপজেলার ২৮১টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরীক্ষা স্থগিত করেছে শিক্ষা বিভাগ।

হবিগঞ্জ : খোয়াই নদীর পানি বিপৎসীমার ২০০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে শহর প্রতিরক্ষা বাঁধ এলাকায় বসবাসকারীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।

খাগড়াছড়ি : দীঘিনালা উপজেলার পাঁচটি গ্রাম ডুবে গেছে। মাইনি নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে এ বন্যার সৃষ্টি হয়েছে।

খুলনা : নগরীর বিভিন্ন স্থানে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। তলিয়ে গেছে শান্তিধাম মোড়, ফারাজিপাড়া রোড, শামসুর রহমান রোড, রয়্যালের মোড়, পিটিআই, নিরালা, বাগমারা, মিস্ত্রিপাড়া, শিববাড়ী, ডাকবাংলা, খানজাহান আলী রোডসহ বিভিন্ন এলাকা।

বিশ্বনাথ : সিলেটে বিশ্বনাথ উপজেলার বাসিয়া ও সুরমা নদীর দুই কূল ছাপিয়ে নদীপারের গ্রাম ও ফসলি জমিতে পানি প্রবেশ করেছে। এরই মধ্যে ওইসব এলকার রাস্তাঘাট পানির নিচে তলিয়ে গেছে। ভেসে গেছে অনেকের মাছের খামার।

বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার সব ধরনের চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে এ ব্যাপারে সরকারের পাশাপাশি দেশের সব সম্পন্ন মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। মানুষ মানুষের জন্য এ প্রতিপাদ্যকে

সামনে রেখে বন্যার্তদের প্রতি সহায়তার হাত বাড়াতে হবে। এবং প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে একটি স্থায়ী সমাধানের পথ খুঁজতে হবে সরকারকে।

লেখক : চেয়ারম্যান ইফাদ গ্রুপ

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist