আবু তাহের

  ১৯ আগস্ট, ২০১৭

মতামত

সমাধান : বিকল্পে নয় চরিত্র পরিবর্তনে

ছোটবেলায় অনেক দেখেছি। আজও দেখা যায় গ্রামে গেলে। আম, বরই, পেয়ারাসহ বিভিন্ন ফলের গাছের গোড়ার দিকে মানুষ বিভিন্ন কাঁটাযুক্ত গাছের ডাল দিয়ে রাখে। যাতে করে দুষ্ট ছেলেরা ফল চুরি করতে না পারে। চোরের হাত থেকে গাছের ফল রক্ষা করার এক ধরনের দুর্বল প্রয়াস। যদিও স্বাভাবিক অবস্থায় এতে কাজও হয়। তাই হয়তো আমরা এই প্রক্রিয়া সব জায়গাতেই ব্যবহার করতে শিখে গেছি। বাড়ির দেয়ালে কাঁটাতার, দেয়ালের ওপর কাঁচের টুকরো গেঁথে রাখা, সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া। প্রবেশ নিষেধ আরকি। শাহবাগের রাস্তায়ও একবার কাঁটা গেঁথে রাখা হলো। আধুনিকায়নও করা হলো কাঁটাগুলোকে। ইস্পাতের তৈরি কাঁটা। যার সঙ্গে আপসে ওপর দিয়ে যাওয়া যাবে। কিন্তু তার মতের বিরুদ্ধ হলে গেঁথে যাবে গাড়ির চাকায়। মজার ব্যাপারই বলতে হবে। চমৎকার একটা সিস্টেম। উল্টোপথের লোকজনদের জন্য এই পদ্ধতি। যদি কোনো গাড়ি উল্টোপথে যেতে চায়, তবে আর রক্ষা নেই। বিশ্বের অন্য কোনো দেশে এই পদ্ধতি আছে কি না জানা নেই, তবে এই পুরো প্রযুক্তিটাই তৈরি হয়েছে আমাদের দেশে। তাই স্বাভাবিকভাবেই ধারণা হতে পারে, এই পদ্ধতি আমাদের দেশেরই। আমরা উল্টোপথের যাত্রী। সব কিছুতেই একটু উল্টো না হলে যেন কিছুই ভালো লাগে না। তা না হলে শাহবাগের রাস্তায় সভ্য মানুষেরই তো চলাচল। দামি গাড়ি নিয়ে উল্টোপথের যাত্রী হওয়ারইবা কী দরকার! দামি গাড়ির দামি লোকেরা তো এগুলো করতে পারে না। ট্রাক কিংবা বাস ড্রাইভাররা করলে মানায়। ট্রাক তো আর ওই রাস্তায় চলে না, বাস চলে। আর বাসগুলো যাত্রীসহ উল্টোপথে সাধারণত দৌড়ায় না। রিকশায় তো আমরা ভদ্রলোকেরাই চড়ি। রিকশাওয়ালারা যেতে না চাইলেও আমরাই তো কানে ধরে নিয়ে যাই। ভালোই। দিন যাচ্ছে। দেশ এগোচ্ছে। আর আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি।

ভদ্রলোকের রাস্তায় কাটা লাগে নাকি! দুষ্ট ছেলেরা আছে বলেই তো গাছে কাঁটা। আর যদি বেশি দুষ্ট হয়, তবে গাছতলায় দাদু বসে বসে পাহারা দেন। আমাদেরও তাই হয়েছে। কাঁটা আছে আর সঙ্গে আছে ট্রাফিক। ট্রাফিক লাইটগুলো জ্বলছে, সঙ্গে ট্রাফিকের হাতও উঠছে। দাদু বুড়ো মানুষ, তাই দুষ্ট ছেলেরা দাদুকে আর পরোয়া করে না। হই-হুলোড় করে গাছে উঠে যায়। ফল পাড়ে। ট্রাফিকরাও আজ বুড়ো হয়ে গেছে। পারলে চাকায় পিষ্ট করে যেন এগোতে চায় গাড়িগুলো। ধমকেও কাজ হয় না। হাতের অস্ত্র দিয়ে চাকা ফুটো করে দিলেও মনে হয় যেন কেউ একটু চিমটি কাটল।

সম্প্রতি ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করে উল্টোপথে গাড়ি নিয়ে গেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া। বুঝে আসে না এই আইনটি নতুন করে হলো কি না, নাকি পুরনো আইনের নতুন প্রয়োগ? ডিএমপি কমিশনারের মন্তব্য, তথাকথিত প্রভাবশালীরা আইনকে তোয়াক্কা না করে উল্টোপথে গাড়ি চালান। উল্টোপথে গাড়ি চলাচলে বাধা দিলে পুলিশকেও নাজেহাল হতে হয়। এতে অনেক সময় বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। এতে পুলিশ বাধা দিলে তাদের নাজেহাল করার অপপ্রয়াস দুঃখজনক। এই তথাকথিত প্রভাবশালী মহলের সঙ্গে পেরে ওঠা যায় না। তাই হয়তো রাস্তায় কাঁটা বিছানোর বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। গাঁটের পয়সা খরচ করে লাভের গুড় পিঁপড়ে খেয়েছিল। আমাদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন লোকেরা যদি বলি, পেরে ওঠা যায় না, তবে জনগণের ক্রন্দন কে শুনবে?

কমিশনার এসব প্রভাবশালীর উদ্দেশে বলেন, ‘আমি বিনয়ের সঙ্গে আপনাদের মাধ্যমে সবাইকে জানাতে চাই, পরিচয় যাই হোক, ট্রাফিক আইন ভায়োলেশন করলে, উল্টোপথে গেলে, সিগন্যাল ভায়োলেশন করলে, অবৈধ পার্কিং করলে তার বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’ প্রভাবশালীদের হাত অনেক লম্বা, তারা এই হাত দিয়ে অনেক কিছুই করে দেখান। তাই হয়তো তাদের বিনয়ের সঙ্গে বলতে হয়। কমিশনার সাহেব ‘রাতারাতি’ ট্রাফিক ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয় বলেছেন। কথাটি অবশ্যই যুক্তিযুক্ত। দীর্ঘদিন ধরে ঘুণে ধরা এই সিস্টেমকে রাতারাতি একটি মার্জিনে আনা আসলেই অসম্ভব। এর অন্যতম কারণ হলো এই প্রভাবশালী মহল। যারা প্রতিনিয়ত আইনের লঙ্ঘন করে যাচ্ছে। যার ফলে অনেকক্ষেত্রেই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছুই করার থাকে না।

কয়েক সপ্তাহ আগে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মিডিয়াতে স্পষ্টভাবে বলেছেন, কোনো মন্ত্রী-এমপির গাড়িও উল্টাপথে চলতে পারবে না। যদি আইন অমান্য করেন, তাহলে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই উল্টোপথে চলার সিস্টেম কীভাবে চালু হলো? কে চালু করল, আর কেনই বা গোড়া থেকে এর বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয় না? মূল কারণ শনাক্ত করে সঠিক ব্যবস্থা নিলেই সমস্যা মিটে যায়। যেমন- হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার করা আইনত অপরাধ। গত এক বছরে ১০ হাজার হাইড্রোলিক হর্ন পুলিশ জব্দ করেছে। জব্দ করাটা কিন্তু সমাধান নয়। সমাধানের জন্য পুলিশ যেটা করেছে সেটা হলো এই অপরাধে মামলা করা হয়েছে কয়েক হাজার। আর বিদেশ থেকে হাইড্রোলিক হর্ন আমদানি করে কেউ যাতে কেনাবেচা করতে না পারে সে ব্যাপারে নজরদারি রাখা হচ্ছে। কিন্তু প্রভাবশালী মহলের ক্ষমতার অপব্যবহারে প্রশাসন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করে। আমরাও বিকল্প ব্যবস্থায় অভ্যস্ত হয়ে গেছি। প্রায় ক্ষেত্রেই সমাধান খোঁজা হয় বিকল্প মাধ্যমে। যেমন খোঁজা হয়েছিল রাস্তায় কাঁটা বসিয়ে।

দেশের বন্যা পরিস্থিতি খুব নাজুক অবস্থায় রয়েছে। ভোগ্যপণ্যের চাহিদা সংকট আর মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে নাভিশ্বাস ছুটে যাচ্ছে। গত পনের দিনের ব্যবধানে পিঁয়াজের দাম ৩০ টাকা থেকে বেড়ে ৬০ টাকায় উঠেছে। অতিবৃষ্টি, বন্যা ও আসন্ন কোরবানির ঈদের প্রভাবে পিঁয়াজের দাম বেড়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলায় অতিবৃষ্টি আর বন্যায় বহু আড়তে পানি জমে মজুদ পিঁয়াজ নষ্ট হয়েছে। ভারতেও অনেক বৃষ্টি হচ্ছে। এই ভারত থেকেই সবচেয়ে বেশি পিঁয়াজ আমদানি হয় বাংলাদেশে। তাই সে দেশেও বেড়ে গেছে পিঁয়াজের রফতানি দর। এ দেশটি পিঁয়াজের সবচেয়ে বড় রফতানিকারক দেশ হওয়ায় বৃষ্টি ও বন্যা আমদানিতেও প্রভাব ফেলছে। আর ১৪ থেকে ১৫ দিন পর কোরবানির ঈদ। এ সময় পিঁয়াজের বাড়তি চাহিদা তৈরি হয় বলে সে সুযোগটাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছেন ব্যবসায়ীরা। ফলে প্রতিদিন একটু একটু করে বাড়ছে পিঁয়াজের দাম।

আর তাই সরকারও বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে তিনটি দেশ থেকে দ্রুত গতিতে পিঁয়াজ নিয়ে আসার ব্যবস্থা করছে। আমদানি হবে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে। পিঁয়াজের দর সহনীয় করতে কয়েক দিন আগে মিসর থেকে পিঁয়াজের জাহাজ দেশে এসে পৌঁছালেও গতকাল পর্যন্ত বন্দরে ভিড়তে পারেনি জাহাজ জটের কারণে। এ জাহাজের পিঁয়াজ খালাস হয়ে বাজারে ঢুকলেই দাম কমতে পারে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আশা করছে, দাম খুব শিগগিরই স্বাভাবিক স্তরে ফিরবে।

কিন্তু কেন এই বিকল্প ব্যবস্থা? বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক হিসাবে দেখা গেছে, দেশে প্রতিবছরে ২০ থেকে ২২ লাখ টন পিঁয়াজের চাহিদা আছে। রমজান মাস ও কোরবানিকে কেন্দ্র করে এ চাহিদা বেড়ে যায়। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে, এই চাহিদার বিপরীতে বাংলাদেশে পিঁয়াজ উৎপাদন হয় ১৭ থেকে ১৮ লাখ টন। পিঁয়াজের চাহিদার ৬০ ভাগ দেশীয় পিঁয়াজ দিয়ে পূরণ হয়। বাকিটা আমদানি করে মেটাতে হয়। বছরে পিঁয়াজের চাহিদা ২২ লাখ টনের মধ্যে দেশে ১৮ লাখ টন পিঁয়াজ উৎপাদন হয়। ঘাটতি মাত্র ৪ লাখ টন। এই চার লাখ টন পিঁয়াজই পাশের দেশ ভারত থেকে আমদানি করতে হয়। আর এই ৪ লাখ টন পিঁয়াজই বাংলাদেশে উৎপাদিত ১৮ লাখ টনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। আর বাজার চলে আমদানি করা ৪ লাখ টন পিঁয়াজের মর্জি অনুসারে। ভারত থেকে ৫ লাখ টন নয়, মাত্র ১ লাখ টন পিঁয়াজ আমদানি করার প্রয়োজন হলেই দেশের বাজারের চিত্র পাল্টে যায়। ওই এক লাখ টনের দাম গিয়ে পড়ে উৎপাদিত ১৮-২০ লাখ টনের ওপর।

দেশে গড়ে প্রতিমাসে পিঁয়াজের চাহিদা ১ লাখ ১০ হাজার টন। এর মধ্যে নভেম্বর, ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে পিঁয়াজের চাহিদা বেশি থাকে। এ ছাড়া রমজান মাস ও কোরবানির সময় পিঁয়াজের দেড় থেকে দুই লাখ টনের বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়। এ চাহিদাকে পুঁজি করে সক্রিয় হয়ে ওঠে সিন্ডিকেট। কিন্তু সরকার এই সিন্ডিকেটকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে পিঁয়াজ আমদানির দিকে ঝুঁকেছে। হয়তো অনেকে বলবেন, পিঁয়াজের মূল্য কমিয়ে আনতে এই বিকল্প ব্যবস্থা। কিন্তু এই বিকল্প ব্যবস্থাই কি সমাধান? দিবালোকের মতো পরিষ্কার। বিকল্পে সমাধান নয়। সমাধান চরিত্র পরিবর্তনে।

লেখক : কলামিস্ট ও শিশুসাহিত্যিক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist