মাহমুদ আহমদ
মতামত
বন্যা : আমাদের জন্য একটি পরীক্ষা
অবিরাম বৃষ্টি এবং উজান থেকে নেমে আসা ঢলে দেশের উত্তরাঞ্চলে সৃষ্ট বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটেছে বলে গণমাধ্যমের সুবাদে খবর পাওয়া যাচ্ছে। উত্তরাঞ্চলের বেশ কয়েকটি জেলাসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জেলা সুনামগঞ্জেও কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছে। এ বছর বর্ষা মৌসুমের বৃষ্টিপাতের সঙ্গে উজানের পাহাড়ি ঢল যুক্ত হওয়ায় বিভিন্ন নদ-নদীর পানি ইতোমধ্যে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইছে। ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, আত্রাই তিস্তা, পদ্মা ও সুরমাসহ প্রধান নদ-নদীগুলোর পানি প্রবাহের তোড়ে ভাঙনে বিলীন হচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। বন্যার পানিতে তলিয়ে আছে শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বিশুদ্ধ খাওয়ার পানি ও খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে প্রবল আকারে। বন্যায় অনেক দরিদ্র পরিবারের বাড়িঘর, সহায়-সম্পদ যা ছিল সব কিছু শেষে হয়ে গেছে। এসব ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের সাহায্য করাই ইসলামের শিক্ষা। আর এর মাধ্যমেই আল্লাহপাক বান্দার প্রতি সন্তুষ্ট হন। আল্লাহপ্রেমিক বান্দারা ঘরে বসেই তার আল্লাহর বান্দাদের কষ্ট দূর করার মাধ্যমে আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারে। যারা আল্লাহর বান্দার কষ্টের সময় সহযোগিতা করে আল্লাহপাক তাকে তার বন্ধু বানিয়ে নেন। আমরা আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি লাভ করতে পারি, এসব অসহায় মানুুষদের পাশে দাঁড়িয়েও।
এ জগতে কেউ যদি ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্তকে আহারের ব্যবস্থা করে তাহলে আল্লাহপাক তাকে অসংখ্য নেয়ামতে ভূষিত করেন। যেভাবে হাদিসে বর্ণিত আছে, মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দুনিয়াতে মানুষকে খাদ্য দান করেছে, আখেরাতে তাকে খাদ্য দান করা হবে। যে আল্লাহকে খুশি করার জন্য মানুষকে পানি পান করিয়েছে, তাকে সেদিন পানি পান করিয়ে তার পিপাসা দূর করা হবে। যে মানুষকে বস্ত্র দান করেছে, তাকে সেদিন বস্ত্র পরিধান করিয়ে তার লজ্জা নিবারণ করা হবে।’ (আবু দাউদ)। আমাদের দেশে প্রায় প্রতিবছরই কম বেশি প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাক হানা দেয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ কখনো এমনভাবে ধেয়ে আসে, যার ফলে গ্রামের পর গ্রাম তছনছ হয়ে যায়। বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো ইত্যাদি দুর্যোগ প্রাকৃতিক, মানুষের এতে কোনো হাত নেই। এ ধরনের দুর্যোগ মহান খোদাতায়ালা যেকোনো দেশে এবং যেকোনো শহরে যেকোনো মুহূর্তে ঘটাতে পারেন। এসব দুর্যোগে কোনো মানুষের হাত থাকে না। আমরা কেউ বলতে পারি না কোন সময় আমরা ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকারে পরিণত হতে যাচ্ছি বা কখন প্লাবন আমাদের সব কিছু ডুবিয়ে দেয়। তাই এসব প্রাকৃতিক আজাব থেকে যেন আল্লাহপাক আমাদের নিরাপদ রাখেন এজন্য সব সময় দোয়া করা আর আল্লাহর হক এবং বান্দার হক সব সময় আদায় করা উচিত।
এই যে একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ ধেয়ে আসছে এসব আসলে খোদাতায়ালার পক্ষ থেকে সতর্ক সংকেত। খোদা সতর্ক করছেন যেন আমরা আল্লাহওয়ালা এবং আল্লাহপ্রেমিক হয়ে যাই। সমাজ ও দেশের বেশিরভাগ মানুষ যখন পাপ, ব্যাভিচার, অন্যায় এবং খোদাকে ভুলতে বসে তখনই খোদাতায়ালা তার পক্ষ থেকে বিভিন্ন আজাব নাজিল করেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘এমন কোনো জনপদ নেই যা আমরা কেয়ামতের আগে ধ্বংস না করব, অথবা অতি কঠোর আজাব দেব।’ (সুরা বনী ইসরাইল, আয়াত : ৫৮)। আল্লাহতায়ালার উপরোক্ত ভবিষ্যদ্বাণী আজ আমরা অক্ষরে অক্ষরে পূর্ণ হতে দেখছি। বন্যা একটি আজাব, মনে হচ্ছে তা কেয়ামত তথা মহাধ্বংসের পূর্বলক্ষণ স্বরূপ প্রকাশিত হচ্ছে। আর এসব পবিত্র কুরআন তথা ইসলামের সত্যতার জ্বলন্ত নিদর্শন বহন করছে। খোদাতায়ালা পরম করুণাময়, তিনি কোনো জাতিকে সাবধান না করে কখনো আজাব অবতীর্ণ করেন না। আমাদের মতো দেশ থেকে প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ হজে গিয়ে থাকেন। এ বছরও ইতোমধ্যে অনেকেই চলে গেছেন, বাকিরা যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অথচ তারই প্রতিবেশী, তারই ভাই বা আত্মীয়স্বজন বন্যাকবলিত হয়ে খেয়ে না খেয়ে কত কষ্টেই না দিনাতিপাত করছেন, তাদের খোঁজখবর নেওয়ার মতো কেউ নেই। অথচ লাখ লাখ টাকা খরচ করে এক ভাই হজে গিয়েছেন! জানি না আল্লাহপাকের দরবারে এমন লোকদের হজ কতটা মর্যাদা পাবে?
বন্যায় হাজার হাজার ঘরবাড়ি পানির নিচে, ছোট ছোট শিশু কান্নাকাটি করছে খাবারের জন্য। শিশুদের কাছে পানি মানে আনন্দ, পানিতে লাফঝাঁপ করবে- এটাই তারা ভাবে, কিন্তু পানির জন্য যে তাদের না খেয়ে থাকতে হবে- এটা তো তারা বোঝার কথা নয়। যারা কখনো এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করেনি তারা হয়ত বুঝতে পারছেন যে, কত কষ্টকর। এমন পরিস্থিতিতে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকাটাই এক চ্যালেঞ্জ। এ ধরনের দুর্যোগের পর সমাজ ও দেশের প্রতিটি সচেতন নাগরিকের দায়িত্ব অনেক বেড়ে যায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় আমাদের যার যতটুকু সামর্থ্য আছে তা নিয়েই দুর্যোগকবলিত লোকদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পারি। আমাদের সবার একটু সহযোগিতার ফলে একটি পরিবার ফিরে আসতে পারে স্বাভাবিক জীবনে। বন্যায় তাদের যে ক্ষতি হচ্ছে হয়তো তা আমরা পূরণ করতে পারব না, কিন্তু তাদের জন্য যদি আমরা একটু সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেই তাহলে হয়তো তারা সব হারানোর যে দুঃখ তা থেকে কিছুটা হলেও সুখ খুঁজে নেবে। আমরা কি পারি না এসব দুর্যোগকবলিত লোকের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে? আমরা কি পারি না তাদের দুঃখের দিনের বন্ধু হতে? মানুষ হিসেবে কি আমাদের ওপর এই দায়িত্ব বর্তায় না তাদের সাহায্য করা? সমাজে অনেক এমন মানুষও রয়েছেন, যারা সব সময় অন্যের সাহায্যের জন্য নিবেদিত থাকেন, তারা সহযোগিতা করেও থাকেন, কিন্তু তা একান্তই সীমিত। এমন পরিস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যের জন্য দেশের বিত্তশালী, বিভিন্ন এনজিও, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনসহ দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে পাশে দাঁড়াতে হবে। বন্যায় সবচেয়ে বেশি যারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তারা নিতান্তই গ্রামের সহজ-সরল দরিদ্র মানুষ। আমরা যদি সবাই মিলে এদের পাশে গিয়ে দাঁড়াই তাহলে হয়তো তারা নতুন করে আবার বাঁচার স্বপ্ন দেখতে পারে। অবুঝ শিশুদের মুখে আবার হাসি ফুটে উঠবে। এসব লোকদের জন্য আমাদের অনেক কিছুই করার আছে, আমাদের সবার সম্মিলিত সহযোগিতার ফলে হাজারো মানুষের দুঃখ-কষ্ট লাঘবে সহায়ক হতে পারে।
লেখক : ইসলামী গবেষক ও কলামিস্ট
"