দিলীপ কুমার আগরওয়ালা

  ১৬ আগস্ট, ২০১৭

উন্নয়ন

সম্ভাবনার অপর নাম বাংলাদেশ

স্বাধীনতার পর যে দেশকে অভিহিত করা হতো তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে সেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে বিপুল বিক্রমে। গত ২০ বছরে অর্থনৈতিকভাবে মিরাকল ঘটিয়েছে এই দেশ। ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে দেখা হচ্ছে চীনেরও সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে। বিশ্বখ্যাত ফিন্যান্সিয়াল টাইমসসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদভাষ্যে বাংলাদেশকে দেখা হচ্ছে সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে। এক সময় যে দেশের কোনো ভবিষ্যৎ নেই বলে অবজ্ঞা করা হতো, সাড়ে চার দশক পর সে বাংলাদেশ প্রমাণ করেছে অন্ধকারাচ্ছন্ন নয়, এ দেশের সামনে অপেক্ষা করছে আলোর ঝলক। জিডিপিতে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জনের সাফল্য দেখাচ্ছে যেসব দেশ, বাংলাদেশের স্থান সে তালিকার উপরের দিকে। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এদিক থেকে ভারত বাদে অন্য সব দেশ পিছিয়ে। দরিদ্রতম দেশ থেকে ইতোমধ্যে মধ্যআয়ের দেশে পরিণত হয়েছে।

পাকিস্তান আমলে সামরিক বাহিনীতে বাঙালি সৈন্যদের সংখ্যা ছিল ১০ শতাংশের সামান্য বেশি। বলা হতো বাঙালিরা অসামরিক জাতি। যুদ্ধবিদ্যায় তারা অনভ্যস্ত। অথচ স্বাধীনতার পর জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীতে বাংলাদেশের সেনা সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। বিশ্বশান্তি রক্ষায় বাংলাদেশ জাতিসংঘের ভরসাস্থল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। স্বাধীনতার আগে বাংলাদেশের মানুষ বিদেশি পুরনো পোশাকের দিকে তাকিয়ে থাকত। সেই বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রফতানিকারক দেশ। প্রথম স্থানে অবস্থানকারী চীনের সবচেয়ে সক্ষম প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার আগে বাংলাদেশ ছিল ওষুধের ক্ষেত্রে প্রায় শতভাগ বিদেশনির্ভর। সেই বাংলাদেশ আজ প্রয়োজনীয় ওষুধের প্রায় শতভাগই তৈরি করছে। বিশ্বের অর্ধশতাধিক দেশে রফতানি হচ্ছে বাংলাদেশি ওষুধ। সিরামিক শিল্পে বাংলাদেশ এখন নন্দিত। স্বাধীনতার আগে বাংলাদেশে ছিল মাত্র দুটি কাগজ কল। সে সংখ্যা এখন ৯০টির কাছাকাছি। ৪৫ বছর আগে এ দেশে ছিল মাত্র একটি সিমেন্ট কারখানা। এখন সে সংখ্যা অন্তত ৫০টি। বাংলাদেশ থেকে জাহাজ রফতানি হচ্ছে ইউরোপীয় দেশগুলোতে। পদ্মা সেতুর মতো বিশাল প্রকল্প নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণের উদ্যোগ নিয়ে বাংলাদেশ দাতা সংস্থাগুলোকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে বাংলাদেশের এই অভ্যুদয় ঘটেছে দেশের পরিশ্রমী মানুষের অক্লান্ত শ্রমে।

সম্প্রতি জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ৪৫টি দেশ সম্পর্কে প্রকাশিতব্য মানবোন্নয়ন প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে তরুণদের দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশের ৪৯ শতাংশ মানুষের বয়স ২৪ বছর কিংবা তার নিচে। দেশের কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা ১০ কোটি ৫৬ লাখ বা মোট জনসংখ্যার ৬৬ শতাংশ। জনসংখ্যাতাত্ত্বিক এই অবস্থান বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সুবর্ণ সুযোগ এনে দিয়েছে। ইউএনডিপি বলছে, এ সুযোগ কাজে লাগাতে হলে আরো বেশি কাজের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে, শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। আর বিনিয়োগ বাড়াতে হবে উৎপাদনশীল খাতে। ইউএনডিপির পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী কর্মক্ষম জনসংখ্যা ১০ কোটি ৫৬ লাখ। অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ৬৬ শতাংশই কর্মক্ষম। আগামী ১৫ বছরে অর্থাৎ ২০৩০ সাল নাগাদ কর্মক্ষম জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ১২ কোটি ৯৮ লাখে, যা হবে মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ। দেশে বয়স্ক বা ৬০ বছরের বেশি বয়সী মানুষ ৭ শতাংশ। ২০৩০ ও ২০৫০ সালে তা বেড়ে দাঁড়াবে যথাক্রমে ১২ ও ২২ শতাংশে।

উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ এবং অর্থনীতিবিদদের মতে, চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে তরুণ জনগোষ্ঠীকে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে। বাংলাদেশের সামনেও সোনালি ভবিষ্যৎ হাতছানি দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সফল হবে কি না তা নির্ভর করছে সৃষ্ট সুযোগ কতটা কাজে লাগানো যাবে তার ওপর। বাংলাদেশের জন্য এ মুহূর্তে সমস্যা হলো জনগোষ্ঠীর এক বিরাট অংশ বেকার। যুব জনগোষ্ঠীর একটি অংশ অভিভাবকদের আয়ের ওপর নির্ভরশীল। যুবসমাজের কর্মসংস্থানের যথাযথ পদক্ষেপ যেমন দেশের উন্নয়ন নিশ্চিত করবে তেমনি এ ক্ষেত্রের ব্যর্থতা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। দেশের সোনালি ভবিষ্যতের স্বার্থেই কর্মসংস্থান সৃষ্টিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে গতি আনার উদ্যোগ নিতে হবে। দেশে শিক্ষিতের হার শতকরা ৭০ শতাংশের মতো হলেও মোট জনশক্তির প্রায় এক-তৃতীয়াংশই বেকার। যাদের অধিকাংশই শিক্ষিত, স্বল্প শিক্ষিত কিংবা অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন। প্রতিবছর বাংলাদেশে গড়ে গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছেন লক্ষাধিক, যাদের বেশির ভাগের কর্মসংস্থান হয় না। ফলে বাড়ছে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাও। পরিসংখ্যান মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা প্রায় দুই কোটি। এমনিতেই বিশ্ব মন্দা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার প্রেক্ষাপটে সারাবিশ্বেই কর্মসংস্থান সঙ্কুচিত হচ্ছে। দেশে কর্মসংস্থান যে হারে বাড়ছিল তা হ্রাস পেয়েছে নানা কারণে। তাই অনেকে শ্রম বেচতে বাইরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের নানা অস্থিরতার কুফল যেসব দেশ ভোগ করছে বাংলাদেশ তার অন্যতম। সারাবিশ্বে প্রায় দেড় কোটি বাংলাদেশি নাগরিক কর্মসংস্থানের কারণে বসবাস করছেন। এর মধ্যে মালয়েশিয়ায়ই রয়েছে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক। তাই বলা যায়, সার্বিক পরিস্থিতি যে কতটা ভয়াবহ তা সহজেই অনুমেয়। পরিস্থিতির অবনতি রোধে সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগ কোনোটাই মূলত কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। ফলে বৃহৎ এই জনগোষ্ঠী সম্পদ নয়, রাষ্ট্রের বোঝা হিসেবেই ভাবা হচ্ছে।

কিন্তু এই অবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হওয়া সঠিক হবে না। তাই অন্যের মুখাপেক্ষী না হয়ে সরকারের দেয়া সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগিয়ে আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। নিজেদের সম্পদ কাজে লাগিয়ে দেশেই কর্মসংস্থানের পথ খুঁজতে হবে। সময়টা তথ্যপ্রযুক্তির। তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারের ফলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষতা প্রদর্শনের সুযোগ পাচ্ছে এ দেশের যুবকরা। অনেকেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে কাজের ক্ষেত্র গড়ে তুলতে সক্ষম হচ্ছেন। ফলে সমাজে সম্ভাবনার ক্ষেত্র আরো সম্প্রসারিত হচ্ছে। আসলে যুবসমাজই হচ্ছে ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও নিরক্ষরতামুক্ত আধুনিক, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার প্রধান চালিকাশক্তি। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গড়তে দেশের এই বিশাল শক্তির উপযুক্ত ব্যবহার হওয়া দরকার। এরাই নিজেদের মেধা ও মনন শক্তি ব্যবহার করে নির্ধারণ করবে দেশের আগামী দিনের চলার পথ। তাই সমাজের এই সৃজনশীল ও উৎপাদনমুখী অংশকে উন্নয়নের মূলধারায় সম্পৃক্ত করতে হবে। এজন্য যুবসমাজের দক্ষতা ও কর্মক্ষমতা বাড়াতে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ এবং কর্মের জোগান দিতে হবে। যুবসমাজের অমিত সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। তাই প্রবাসে নয়, স্বদেশেই কর্মসংস্থান নিশ্চিতের ব্যবস্থা করতে হবে।

লেখক : পরিচালক, এফবিসিসিআই

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist