পঞ্চানন মল্লিক

  ১৫ আগস্ট, ২০১৭

জলজট

‘উল্টো রাজার দেশ’

রাস্তাঘাটে হাঁটু সমান কিংবা কোথাও কোথাও গলা সমান পানি। জলমগ্ন গাড়ি, মোটরসাইকেল, রিকশা। ডুবু-ডুবু ভ্যানে দাঁড়ানো যাত্রী, পত্র-পত্রিকার ছবিতে বা বাস্তবে দেখছি অহরহ। কখনো কখনো রাস্তায় চলছে নৌকাও। এ যেন সুকুমার রায়ের উল্টো রাজার দেশ। তবে কল্পনায় নয়, বাস্তবে এটি দেখা যাচ্ছে এখন। আসলে রাস্তাঘাটে জলাবদ্ধতা চারপাশের বন্যা এখন মানুষের জন্য বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিচ্ছে। লোকজনের চলাচলে যেমন সমস্যা হচ্ছে তেমনি বাড়ি থেকে বের হওয়াও মুশকিল হয়ে পড়ছে। পানিবন্দি হয়ে পড়ছে মানুষ। জলের অভিশাপে ধুঁকছে সদা সর্বদা। জলজটে রাজধানী ঢাকার চিত্র সবচেয়ে বেশি নাজুক। শহরে কর্মের তাগিদে প্রতিদিন মানুষকে ছুটে চলতে হয় একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে। যাতায়াত করতে হয় অফিস আদালতে। পরিবহন করতে হয় নানা জিনিসপত্র ও পণ্য সামগ্রী। তাছাড়া ব্যাপকসংখ্যক লোককে রিকশা, ভ্যান, অটোরিকশা, টেম্পো, মাইক্রো কার, স্কুটারসহ বিভিন্ন যানবাহন চালিয়ে জীবিকা উপার্জন করতে হয়। জমে থাকা পানিতে অসুবিধা হচ্ছে সবারই। দেখা দিচ্ছে যানজট। মানুষের চলাচল ও জীবিকা অর্জনের অন্তরায় জীবনে ডেকে আনছে চরম দুর্ভোগ। সুখ-ভোগের অন্তরায় হিসেবে অনেকে দায়ী করছেন শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্থাকে। কেউ কেউ পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার অকার্যকারিতাই মূল কারণ বলে ভাবছেন। এ ছাড়া অপরিকল্পিত নগরায়ণ, সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলোর উন্নয়নকাজে পরস্পর সমন্বয়হীনতা, যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা ফেলা, পলিথিন ও ময়লা-আবর্জনা জমে ড্রেন বা পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়া, বর্ষা মৌসুমে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, ফ্লাইওভার নির্মাণ, অতিবৃষ্টি, অধিক ঘনবসতি ইত্যাদিও উঠে আসছে কারণের তালিকায়। কিন্তু এগুলোকে মূল কারণ বলা কতটুকু যুক্তিসংগত। সংকীর্ণ, অপরিকল্পিত, অপর্যাপ্ত, অদূরদর্শিতার ফল ইত্যাদি বলে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের গায়ে যতই কাদা লেপুন না কেন মূল রোগ কি ল্যাবরেটরিতে ধরা পড়ছে? সরু ড্রেন তো অতীতেও ছিল, তখন কি এমন জবুথবু ডুবেছে নগর? তখন ঢাকার প্রশস্ত খালগুলো ছিল বর্ষায় পানি ধারণের উপযুক্ত আধার। খাল দিয়ে পানি গিয়ে পড়ত বুড়িগঙ্গায়। খাল ও এর শাখা প্রশাখা ছিল জালের মতো বিস্তৃত। কোথায় গেল সেই খালগুলো? আমরাই মেরে ফেলেছি, দখল করেছি। এখন সেখানে নির্মিত হয়েছে সংকীর্ণ বক্স কালভার্ট। যার পেটে প্রতিনিয়ত ময়লা আবর্জনার চর্বি জমে বন্ধ হচ্ছে প্রবাহ।

ধরা যাক সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে শহরের অলিতেগলিতে লাগসই গভীর ও প্রশস্ততর ড্রেনসমূহ তৈরি করা হলো, কিন্তু ড্রেন বেয়ে জল গিয়ে দাঁড়াবে কোথায়? ঢাকার আশপাশের নদ-নদীতে কি আগের মতো সেই গভীরতা আছে? বুড়িগঙ্গা বুড়ি হয়েছে সেই কবে। দখলে, দূষণে ছেয়ে গেছে শীতালক্ষ্যা, তুরাগ, বালু ও বুড়িগঙ্গা। আমরা কি একবারও ভেবেছি এর পরিণাম কী হতে পারে? এগুলো শহরের জন্য পানিবদ্ধতার কতটা কারণ হতে পারে! আমাদের ভালো মন্দের ব্যাপারে আমরাই যদি সচেতন না হই, আকাশ থেকে দৈত্য এসে তো আর আমাদের সব সমস্যার সমাধান করে দেবে না, কিংবা সমস্যার উত্তরণ ও পরিত্রাণের পথ বাতলে দেবে না। আলাউদ্দীনের আশ্চর্য প্রদীপ হয়তো কেউ পেয়েছিল, কিন্তু আমরা সেই প্রদীপ নেভাতে ওস্তাদ। যদি তাই না হবে, তা হলে আমরা কেন নদী-নালা, খাল-বিল এভাবে হত্যা করছি? নদী-নালার দেশ বাংলাদেশ। নদী না থাকলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য কিভাবে রক্ষা পাবে? নদীর প্রাণবায়ু ফুরালে হুমকির মুখে পড়বে আমাদের অস্তিত্ব। কারণ নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদীর ওপর রয়েছে মানুষের বহুলাংশে নিভর্রতা। অবশ্য নদী ভরাটের দুটি কারণ রয়েছে। একটি হলো মনুষ্যসৃষ্ট, অন্যটি প্রাকৃতিক। প্রাকৃতিক কারণের মধ্যে রয়েছে ভারত কর্তৃক ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের ফলে এদেশে ব্যাপকভাবে নদীনালা ভরাট হচ্ছে। কিন্তু ভরাট হওয়া নদী পুনর্খননের উদ্যোগ না নিয়ে সেগুলো হরিলুটের মতো দখল হচ্ছে, এটি কিন্তু এক ধরনের বর্বরতা! এটি আমাদের পরিবেশ ও জীবনযাত্রাকে চরমভাবে বিপর্যস্ত করছে। যার ফল আমরা ইতোমধ্যে টের পাচ্ছি। রাজধানীর মতো সারাদেশ আজ পানিতে নিমজ্জিত হচ্ছে।

এর থেকে বেরিয়ে আসার কোনো পথই কি আর খোলা নেই? উত্তরটা খুবই ছোট এবং সহজ। আমাদের অসুস্থ নৈতিকতায় পরিবর্তন আনতে পারলেই সম্ভব। আশা করি, এর বেশি বলার প্রয়োজন নেই।

লেখক : কবি ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist