রেজাউল করিম খান

  ১০ আগস্ট, ২০১৭

মতামত

খবর নেই ‘নিজস্ব সংবাদদাতা’র

সংবাদপত্রের এক অপরিহার্য অনুষঙ্গ ‘নিজস্ব সংবাদদাতা’। কবে, কোথায় প্রথম সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়েছিল, সেই গবেষণায় না গিয়েও ধারণা করি, তখনো নিজস্ব সংবাদদাতা ছিল; এখনো আছে। বর্তমানে ‘নিজস্ব সংবাদদাতা’ ও ‘মফস্বল সংবাদদাতা’ সমার্থকরূপে গণ্য হয়। যারা শহর থেকে দূরে অর্থাৎ গ্রামে অবস্থান করেন এবং সেখান থেকে ঢাকায় খবর পাঠান তারাই নিজস্ব বা মফস্বল সংবাদদাতা। এক সময় কলকাতা থেকে প্রকাশিত পত্রিকায় দেখা গেছে, কলকাতা থেকে পাঠানো নিজস্ব সংবাদদাতার খবর। তবে সেই সংবাদদাতা আর এই সংবাদদাতা মোটেও এক নয়। কোনো কোনো সংবাদপত্রের পাতায় এরা ‘নিঃসঃ’ হয়ে গেছে। পত্রিকা, টিভি, অনলাইন ও রেডিও কর্তৃপক্ষ এদের আদর করে বলে, ‘আমাদের প্রতিনিধি’ বা ‘আমাদের সহকর্মী’। খবর সংগ্রহ ও লিখে তা প্রধান অফিসে পাঠানোই এদের প্রধান কাজ।

চাকরি বটে! তবে শখের। ছাত্র জীবনে কারো দেখাদেখি, কারো উৎসাহে, সাংবাদিকের দৃশ্যমান ক্ষমতার প্রভাব দেখে, রোমাঞ্চিত হয়ে এক দিন লিখতে শুরু করেছিল যে কিশোরটি, পরবর্তীকালে তারই নাম হয় নিজস্ব সংবাদদাতা। তবে তিনি সংবাদদাতা হিসেবে নিজের পরিচয় দিতে পছন্দ করেন না। তার পরিচয় সাংবাদিক। আর এটিকেই কালক্রমে অনেকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। অবশ্য অনেক মফস্বল সাংবাদিক তার মেধা, দক্ষতা, সততা ও যোগ্যতা বলে উচ্চতর অবস্থানে যেতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, অধিকাংশেরই তেমনটি হয় না।

দীর্ঘদিন থেকে সংবাদপত্রের পাশাপাশি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ও অনলাইন পত্রিকায় মফস্বল সাংবাদিকরা কাজ করছেন। কাজ করার জন্য তাদের তেমন কোনো যোগ্যতার প্রয়োজন হয় না। কিসের ভিত্তিতে তারা নিয়োগ পান, সে বিষয়টি পরিষ্কার জানা না গেলেও রাজনৈতিক বিবেচনা, আর্থিক যোগাযোগ, মিডিয়া হাউস সিন্ডিকেট, আত্মীয়তা ও প্রভাবশালীদের সুপারিশ এ ব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা রাখে। মালিক কর্তৃপক্ষ মফস্বল সাংবাদিকদের সাধারণত নিয়োগপত্র দেয় না। দেওয়া হয় পরিচয়পত্র। এ ক্ষেত্রে ওই সাংবাদিক কিছু লিখতে পারুক বা না পারুক, তাতে কিছু এসে যায় না। একজনের লেখা অন্য একজন লিখে দিলেও ক্ষতি নেই। শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে পারে না, বদখত চেহারার এমন লোকজনকেও টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক বানানো হয়। এর বিনিময়ে তাকে কোনো বেতন-ভাতা দিতে হয় না। দেওয়া হয় সামান্য কিছু সম্মানী। তাও সবাইকে নয়। কিন্তু দায়িত্ব দেওয়া হয় অনেক। সংবাদ ও ছবি পাঠানো ছাড়াও বিজ্ঞাপন সংগ্রহ ও পত্রিকার প্রচার বৃদ্ধির বাধ্যবাধকতা থাকে। এমতাবস্থায় বেচারা মফস্বল সাংবাদিক তার নিজের ও সংসার খরচের জন্য এদিক-সেদিক কিছু করতেই পারেন।

খুব কমসংখ্যক সাংবাদিক অফিস-আদালত থেকে সরকারি বিজ্ঞাপন পান। তবে ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী-এমপি, রাজনৈতিক দলের বড় নেতা, পুলিশ, ঠিকাদার, মাদক ব্যবসায়ী, দুর্নীতিপরায়ণ সরকারি কর্মকর্তা ও কতিপয় জনপ্রতিনিধি সময়ে সময়ে বা নিয়মিতভাবে সাংবাদিকদের নগদ কিছু দিয়ে থাকেন। পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলের সুনাম এবং সাংবাদিকের দাপট ও দক্ষতার ওপর টাকার পরিমাণ নির্ধারিত হয়। অনেকে সংবাদ সম্মেলন ও প্রশংসামূলক বিশেষ প্রতিবেদন লেখার জন্য টাকা পান। এসব খবর প্রচারের জন্য প্রধান অফিসের ‘বস’দের কিছু দিতে হয়। মাঝেমধ্যে আম-লিচু-মিষ্টিও পাঠাতে হয়।

মনে পড়ে, ১৯৮৮ সালে বন্যার সময় ২৭ আগস্ট রাতে উত্তরাঞ্চলের এক জেলায় নৌকাডুবিতে ১৩ জনের মৃত্যু হয়। স্থানীয় সাংবাদিকরা গভীর রাতে খবরটি জানতে পারেন। কিন্তু কিছুই করার নেই। তখন ঢাকায় খবর পাঠানো সহজ ছিল না। বাংলাদেশ টেলিভিশনের জেলা সংবাদদাতা খবরটি শোনার পর ছটফট করতে থাকেন। এদিকে বিছানায় তার সন্তান সম্ভবা স্ত্রী। কিন্তু তার মাথায় এক চিন্তা। কিভাবে ছবিসহ সংবাদটি নিয়ে টেলিভিশন ভবনে পৌঁছানো যায়। রাতে ভালো ঘুম হয় না। ভোর না হতেই ছুটলেন ক্যামেরাম্যানের বাড়ি। তাকে সঙ্গে নিয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে। এক ঘণ্টার মধ্যে ছবি ও সংশ্লিষ্টদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হলো। বই আকারের ক্যাসেট। তখন পাঠানো হতো কুরিয়ার ডাকে। পরদিন তা প্রচার হতো। কিন্তু ওই সংবাদদাতা দেরি করলেন না। নিজেই ক্যাসেট নিয়ে ছুটলেন ঢাকায়। রাত ৮টার সংবাদে ধরাতে হবে। গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছলেন বিকেল সাড়ে ৫টায়। তখন বৃষ্টি হচ্ছে মুষলধারায়। রাস্তায় পানি জমে গেছে। লোকাল বাস চলাচল বন্ধ। রামপুরা যাওয়া প্রায় অসম্ভব। অনেক চেষ্টায় এক বেবিট্যাক্সি চালককে রাজি করানো গেল। অবশেষে সন্ধ্যা ৭টায় পৌঁছলেন টেলিভিশন ভবনে। বার্তা বিভাগে আগেই জানানো হয়েছিল। ওরা ক্যাসেটটি নিলেন। সংবাদদাতা ওখানে বসেই খবর লিখে দিলেন। অতঃপর আর দেরি না করে বাড়ি ফেরার পথ ধরলেন। ভোরে বাড়ি ফিরে শুনলেন স্ত্রী হাসপাতালে। শঙ্কায় উত্তেজনায় ছুটে গেলেন স্ত্রীর শয্যাপাশে। দেখলেন, ঘুমন্ত নবজাতকের শান্ত ¯িœগ্ধ উজ্জ্বল শাদা মুখ। আরো শুনলেন, রাতের ৮ ও ১০টার সংবাদে তার দেওয়া খবর ছবিসহ প্রচার হয়েছে। আনন্দে তখন কি ওই সংবাদদাতার চোখের পাতা ভিজে গিয়েছিল? ঝরেছিল কি দুই ফোঁটা অশ্রু? না, সেই খবর জানা যায়নি। তবে সরকার পরিবর্তনের পর বাংলাদেশ টেলিভিশনের ওই সংবাদদাতাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল বলে আমরা শুনেছিলাম।

বেশ কিছুকাল থেকেই মফস্বল সংবাদ বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে। তবে কোন মিডিয়ায় কী পরিমাণ মফস্বল সংবাদ প্রচার হচ্ছে বা হয়েছে তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। এ-সংক্রান্ত সরকারি জরিপ হয়েছে বলে আমার জানা নেই। বেসরকারি কিছু হয়েছে বটে, তবে তা রাজধানীকেন্দ্রিক। এ কথা বলা যায়, দেশে সংবাদপত্র পাঠকের সংখ্যা কমছে। বাড়ছে টিভি দর্শক-শ্রোতার সংখ্যা। টিভি-পত্রিকার আয়ের প্রধান উৎস বিজ্ঞাপন। যার প্রচার সংখ্যা শীর্ষে বা দর্শকপ্রিয়তা বেশি, বিজ্ঞাপনদাতারা তার প্রতিই আকৃষ্ট হয়। সংবাদপত্রের সিংহভাগ পাঠক ও টিভি দর্শক ঢাকায় থাকেন। তারা সকলেই কোনো না কোনো জেলার বাসিন্দা। নিজের জেলার একটি বিশেষ সংবাদ তাদের আলোড়িত করে। যেমন বগুড়ার সংবাদ বা সিলেটের ঘটনায় ঢাকায় মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলন ও সভা-সমাবেশ হয়। এই সংবাদগুলো কোন্ পত্রিকা বা টিভিতে কত ভালোভাবে প্রচার হয়েছে তা পাঠক ও দর্শক-শ্রোতারা আলোচনা করেন। এ ক্ষেত্রে দক্ষ, মেধাসম্পন্ন মফস্বল সাংবাদিকরা দেশবাসীর কাছে দৃষ্টান্ত ও প্রশংসিত হতে পারেন। এর আগে অনেকে হয়েছেনও। তবে কর্তৃপক্ষকে ওই সংবাদদাতার সকল প্রকার প্রাপ্য সুবিধা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এই কাজ সরকার করবে বলে মনে হয় না। বর্তমানে খুন-ধর্ষণসহ সহিংস ঘটনার পাশাপাশি সাংবাদিক হয়রানি ও খুনের ঘটনাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এর অধিকাংশই ঢাকার বাইরে। অর্থাৎ মফস্বলে। সাংবাদিকরা একদিকে যেমন ৫৭ ধারার শিকার হচ্ছেন, অপরদিকে তুচ্ছ কারণে তাদের পেটানো, এমনকি হত্যা করা হচ্ছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র জানিয়েছে, ২০১৬ সালে সারাদেশে নির্যাতন, হয়রানি, হত্যার হুমকি, সন্ত্রাসী হামলা প্রভৃতির শিকার হয়েছেন ১১৭ সাংবাদিক। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১৬ বছরে ২৮ সাংবাদিক খুন হয়েছেন। নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২ হাজার ৭৬১ জন। এসব খুন-নির্যাতনের অধিকাংশ ঘটনার পেছনে ছিল রাজনীতি। যে কারণে সঠিক তদন্ত ও বিচার হচ্ছে না।

অতীতে বাংলাদেশের বড়মাপের সাংবিধানিক পদের এক কর্মকর্তা তার দফতরে সেদিন নতুন খবর নেই মন্তব্য করতে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘কোনো খবর নাইরে ভাই।’ কথাটি পরবর্তী কিছুদিন রঙ্গরসের খোরাক হয়েছিল। সেই কথাটিই মফস্বল সাংবাদিকদের ফের বলি, ‘তোমাদের জন্য কোনো খবর নাইরে ভাই।’

রোদ-গরম-ঘামে সিদ্ধ হয়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, বন্যার পানিতে দাঁড়িয়ে যে মানুষটি খবর সংগ্রহ করে, তার নাম নিজস্ব সংবাদদাতা। রাজনৈতিক নেতা ও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের সতর্কবাণী যার প্রতি; ক্যাডার, সন্ত্রাসীদের রক্তচক্ষু কঠোর চাউনি যার প্রতি, তিনিই মফস্বল সাংবাদিক। তাদের না আছে বেতন, না বাহন। শখ আর নেশার ঘোরে ওরা ছুটে চলে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। কান পাতলে হয়তো শোনা যাবে স্বগতোক্তি, ‘আহা! আমাকে অন্তত ওই তালগাছটার চূড়ায় উঠতে দাও, সেখানে বসে আমি মদ খাব আর মাতলামোর মধ্যেই আমি ভুলে যাব ভুলে যাব ভুলে যাব, আমিও একজন মানুষ, আমার জন্যই এইসব।’

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist