রায়হান আহমেদ তপাদার

  ০৯ আগস্ট, ২০১৭

আন্তর্জাতিক

ভেনিজুয়েলা সংকট নেপথ্যে

ভেনিজুয়েলার বিক্ষোভের বর্তমান এ পরিস্থিতি ২০১৪ সালের ভয়াবহ ও রক্তক্ষয়ী আন্দোলনকেও হার মানিয়েছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর কট্টর সমালোচক অর্গানাইজেশন অব আমেরিকান স্টেটসের পরিচালক লুইস আলমাগরো বলেন, তারা জনগণকে নির্যাতন ও হত্যা করছে। এ পরিস্থিতি অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ বুধবার (আজ) ভেনিজুয়েলার সংকট নিয়ে আলোচনা করবে বলে নিউইয়র্কের কূটনীতিকরা জানিয়েছেন। নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর ক্ষমতা বাড়ানোর প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে গত ১ এপ্রিল বিক্ষুব্ধ বিরোধীরা ভেনিজুয়েলার রাস্তায় নেমে আসেন। সশস্ত্র সহিংসতার জন্য সরকার ও বিরোধীরা একে অপরকে দোষারোপ করে আসছে। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা এক বিবৃতিতে জানান, পশ্চিমাঞ্চলীয় পেদরাজা শহরে বিক্ষোভ চলাকালে এক কিশোরের মাথায় গুলি লাগার পর তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান সে। সান অ্যান্টোনিও ডি লোস আল্টোস ও তাচিরা নগরীতে বিক্ষোভ চলাকালে একদল লোক এসে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়লে ওই কিশোরের মাথায় গুলি লাগে। এ ছাড়া ৩১ ও ৩৩ বছর বয়সী আরো দুজন গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। কেন্দ্রীয় ডানপন্থি বিরোধী দলের সমাজতান্ত্রিক নেতা মাদুরোকে খাদ্য ও ওষুধের ঘাটতির জন্য দোষারোপ করেছে।

ভেনিজুয়েলার বামপন্থি সরকারকে উৎখাত করতে মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের চক্রান্ত এখন ভয়ানক আকার ধারণ করেছে। আইনসম্মত এবং গণতান্ত্রিক পন্থায় রাজনীতি করার বদলে দেশটির উগ্র ডানপন্থি রাজনৈতিক শক্তিগুলো এখন নাশকতার পথ বেছে নিয়েছে। চলছে ঢালাও বোমাবাজি, খুন, অপহরণ ও গুপ্তহত্যা। দেশটিতে একটি দীর্ঘস্থায়ী অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করার জন্য সা¤্রাজ্যবাদ সেখানে ঠান্ডা মাথায় নানাবিধ সংকট সৃষ্টি করেছে। একুশ শতকের বিপ্লবী, লাতিন আমেরিকার কিংবদন্তি নেতা হুগো শ্যাভেজের উদারতার সুযোগকে অপব্যবহার করে আজ নিজের দেশকেই বেচে দিতে উদ্যত হয়েছে দেশটির গণবিরোধী চক্র। আজ সে আগুনে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে ভেনিজুয়েলার আমোদপ্রিয়, নিরীহ সাধারণ মানুষ। একে একে দেশটির বিভিন্ন প্রদেশে সন্ত্রাসের বিষ ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে ১৯৯৯ সালে শ্যাভেজের নেতৃত্বে ভেনিজুয়েলার রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছিল এক বামপন্থি সরকার। তারপর দীর্ঘ ১৪ বছর টানা ক্ষমতায় থেকে দেশ পরিচালনা করে সেই বাম সরকার। ২০১৩ সালের ৫ মার্চ ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান হুগো শ্যাভেজ। এরপর নির্বাচনে জিতে আবারও রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে শ্যাভেজের দল। শ্যাভেজের সহযোদ্ধা নিকলাস মাদুরো হন দেশটির রাষ্ট্রপতি। ক্ষমতায় আসার আগে ও পরে শ্যাভেজকে যেমন নানা চক্রান্ত মোকাবিলা করে টিকে থাকতে হয়েছে। একই পরিস্থিতি আজ মাদুরোর বেলায়ও।

গত ১ সেপ্টেম্বর রাজধানী কারাকাসে এক সমাবেশ করে তারা যেকোনো মূল্যে কারাকাস দখলের ঘোষণা দেয়। সেসঙ্গে ডিসেম্বরের আগেই রাষ্ট্রপতির অপসারণের জন্য গণভোট দাবি করে। ডানপন্থি বিরোধী দলগুলোর নির্বাচন নিয়ে এ তড়িঘড়ির আসল কারণ হলো, দেশটির সংবিধানে এ নিয়ে বেশ কিছু জটিলতা আছে। ভেনিজুয়েলার বর্তমান সংবিধান মতে, যদি আগামী ১০ জানুয়ারির আগে এ গণভোট অনুষ্ঠিত হয়, আর তাতে মাদুরো হেরে যান; তাহলে নতুন করে দেশটিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। আর যদি সেটা আগামী ১০ জানুয়ারির পর অনুষ্ঠিত হয় এবং মাদুরো হেরে যান; তাহলে দেশটির উপরাষ্ট্রপতি আগামী ২০১৯ সাল পর্যন্ত দেশ পরিচালনা করবেন। এরপর তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নেবেন। ভেনিজুয়েলার বামবিরোধী রাজনৈতিক শক্তি তাই কোনো ঝুঁকির মধ্যে যেতে চায় না। সে কারণে তারা এ বছরের মধ্যেই মাদুরোর নেতৃত্বাধীন বামপন্থি সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরাতে চায়। ২০০২ সালে মার্কিন মদদে যেভাবে দেশটির নানা অপশক্তি এবং সিআইএ মিলে শ্যাভেজের বিরুদ্ধে ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থান করেছিল, এখনো সেই একই প্রচেষ্টা চলছে। যার অংশ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সংবাদপত্র এবং করপোরেট মিডিয়াসমূহ ভেনিজুয়েলার বামপন্থি রাজনৈতিক শক্তি এবং তাদের সরকার সম্পর্কে নানা বানোয়াট ও মিথ্যা সংবাদ প্রচার করছে। দেশটিতে চলমান ভয়াবহ খাদ্য সংকটকে নিয়ে চলছে ঢালাও মিথ্যাচার।

অন্যদিকে ভেনিজুয়েলার খাদ্যশস্য ও আটা-ময়দার মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ৬২ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে পোলার করপোরেশন নামে দেশটির একটি প্রাইভেট কোম্পানি। এই কোম্পানি আবার রাজনৈতিকভাবে মার্কিন লবির ঘনিষ্ঠ। তারাই আজ দেশটির নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজারে অস্বাভাবিক অবস্থার সৃষ্টি করেছে। ফলে কালোবাজারে চড়া দামে সব কিছু পাওয়া গেলেও সেসব এখন সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। এই কালোবাজারির টাকাতেই দেশটিতে সন্ত্রাস ও নাশকতার জন্ম দেওয়া হচ্ছে। ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন প্রকার মাদক। যাতে সেখানকার যুবসমাজ সহজেই বিপথগামী হয়। যার কিছু আলামতও এখন সেখানে দেখা যাচ্ছে। গত সপ্তাহেই বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক এবং সেনাবাহিনীর ইউনিফর্মসহ ডানপন্থি পপুলার উইল পার্টির বেশ কিছু কর্মী গ্রেফতার হয়। মার্কিনের সেবাদাস হিসেবে পরিচিত এ সন্ত্রাসী রাজনৈতিক গোষ্ঠীর নেতা হলো লিওপল্ডো লোপেজ এবং তার স্ত্রী। সন্ত্রাস ও নাশকতার দাগি অপরাধী হিসেবে এই লিওপল্ডো লোপেজের বেশ পরিচিতিও আছে। তার সম্পর্কে এ সপ্তাহের শুরুতেই চিলির বামপন্থি কর্মী এবং চিলির বিশিষ্ট বামপন্থি নেতা সালভাদর আলেন্দের নাতি পাবলো আলেন্দে বলেছেন, লিওপল্ডো লোপেজ একজন অপরাধী। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, বামপন্থি সরকার উৎখাতের নামে সা¤্রাজ্যবাদ ভেনিজুয়েলার রাজনীতিকে কি পরিমাণ দুর্বৃত্তায়িত করেছে। অপরদিকে ভেনিজুয়েলার অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক না গলাতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো।

ভেনিজুয়েলা সংকটের ব্যাপারে মার্কিন সরকারের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে বলে হুশিয়ারি দিয়েছেন আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি। লাতিন আমেরিকার এ দেশটির অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে কেরি বলেছেন, কারাকাস সরকারের উচিত সরকারবিরোধীদের সঙ্গে আবার আলোচনায় বসা। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রকে লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপমূলক নীতি থেকে সরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। রাশিয়ার চ্যানেল আরটিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ট্রাম্পকে উদ্দেশ করে মাদুরো বলেন, প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে থাকতে চায় ভেনিজুয়েলা। যুক্তি মেনে চলার এবং ভেনিজুয়েলার সরকারের প্রতি আগ্রাসী নীতি পরিহার করার আহ্বান জানান তিনি। তার এই আহ্বান মেনে নেওয়া হবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন মাদুরো। পাশাপাশি এ আহ্বানে সাড়া দেওয়া না হলে এবং পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করলে কি হবে, সে ব্যাপারেও হুশিয়ারি উচ্চারণর করে মাদুরো বলেন, শোচনীয় পরিস্থিতিতে বলিভিয়ার বিপ্লব অস্ত্র তুলে নেবে এবং দেশটির সীমান্তজুড়ে একই পতাকার নিচে যুদ্ধ শুরু করবে।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist