মাহমুদ আহমদ

  ২৮ জুলাই, ২০১৭

ধর্ম

নারীর প্রতি উত্তম আচরণ

দিন দিন আমাদের স্বভাব চরিত্র কেমন জানি বদলে যাচ্ছে। সামান্য কিছুতেই যেন রেগে যাচ্ছি। পরিবারের সদস্যের সঙ্গে আচরণের ধরনও যেন পাল্টে গেছে। পিতা-মাতার খোঁজখবর তো করিই না আর স্ত্রীর গায়ে আঘাত করা তাও যেন কোনো বিষয়ই না। এ যুগেও কোনো কোনো স্থানে নারীদের সঙ্গে যে আচরণ করা হয় তাতে মনে হয় আমরা আবার সেই আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগে ফিরে যাচ্ছি। অথচ আল্লাহ পাকের কাছে নারী পুরুষের মর্যাদা ভিন্ন নয়। পবিত্র কোরআন মজীদে মহান আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘নিশ্চয় আমি তোমাদের কোনো কর্মনিষ্ঠ ব্যক্তির কর্মকে বিনষ্ট করব না, তা সে পুরুষ হোক বা নারীই হোক’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৯৫)। এই আয়াত থেকে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, সৃষ্টিকর্তার কাছে আমলের দিক থেকে সবাই সমান। সে পুরুষ হোক বা নারী, তাতে কিছু যায় আসে না।

একটু চিন্তা করুন, ইসলাম আবির্ভাবের পূর্বে নারীর মর্যাদা কেমন ছিল। পুরুষরা নারীদের সঙ্গে অবাধ মেলামেশা করত, রাতের বেলায় নারীদের নিয়ে মদ ও গান-বাদ্যের মহোৎসব করত। সে যুগে কন্যা সন্তানের জন্ম হওয়াকে তারা অমর্যাদাকর ও চরম লজ্জাস্কর মনে করত। নারীকে অস্থাবর সম্পত্তি জ্ঞান করা হতো। তাদের অধিকার বলতে কিছু ছিল না। কিন্তু মানবতার মুক্তির দূত হজরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.)-এর আবির্ভাবে নারীরা তাদের যথাযোগ্য সম্মান ও মর্যাদাপ্রাপ্ত হয়। আল্লাহতায়ালা তার (সা.) প্রতি অবতীর্ণ পূর্ণাঙ্গ ঐশীগ্রন্থ আল কোরআনে শিক্ষা দিলেন, ‘তারা তোমাদের জন্য একপ্রকারের পোশাক এবং তোমরাও তাদের জন্য এক প্রকারের পোশাক’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৮৭)। এখন দেখুন, পোশাকের কাজ কি? পোশাকের কাজ হচ্ছে নগ্নতাকে ঢাকা। তাই আল্লাহতায়ালা বলেছেন, তোমরা স্বামী-স্ত্রী অবশ্যই একে অপরের দোষ-ত্রুটি ঢেকে রাখবে। কেননা পোশাক সৌন্দর্য বৃদ্ধির কারণও হয়ে থাকে। এখানে নারী-পুরুষকে একে অপরের সহযোগী আখ্যায়িত করা হয়েছে।

অন্যত্র আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমাদের স্ত্রীগণ তোমাদের জন্য ক্ষেত্র স্বরূপ’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ২২৩)। একজন ভালো কৃষক যেভাবে সর্বদা নিজের মূল্যবান জমিনের হিফাজত করে, পরিশ্রমের মাধ্যমে জমিনের পরিচর্যা করে, জমিকে ক্ষতিকর পোকামাকড়ের হাত থেকে রক্ষা করে, তেমনিভাবে ইসলামের শিক্ষা হচ্ছে, পুরুষরা যেন জেনে রাখে নারীরা তোমাদের অমূল্য সম্পদ। সঠিকভাবে তাদের হিফাজত করা, তাদের ভালো-মন্দের দিকে দৃষ্টি রাখা এবং তাদের সঙ্গে উত্তম দাম্পত্য জীবনযাপন করতে যেন কোনো ত্রুটি না করে।

নারীদের প্রতি উত্তম আচরণের ব্যাপারে মহানবী (সা.) বিশেষভাবে দৃষ্টি রাখতেন। তিনিই (সা.) সর্বপ্রথম পৃথিবীতে নারীর উত্তরাধিকার কায়েম করেছেন। বস্তুত কোরআন করিমের মাঝেই ছেলেদের সঙ্গে মেয়েদেরও সম্পত্তির উত্তরাধিকার সাব্যস্ত করে দেওয়া আছে। একইভাবে মায়েদেরকে, স্ত্রীদেরকে, কন্যাদের এবং স্বামীদের সম্পত্তির এবং বিশেষ অবস্থায় বোনদেরকে ভাইদের সম্পত্তির উত্তরাধিকার সাব্যস্ত করা হয়েছে। ইসলামের পূর্বে পৃথিবীর বুকে আর কোনো ধর্মই এভাবে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেনি।

একইভাবে তিনি (সা.) নারীদেরকে তার সম্পদের নিরঙ্কুশ মালিকানা দান করেছেন। স্বামীর এই অধিকার নেই যে, স্বামী হওয়ার কারণে তিনি তার স্ত্রীর সম্পত্তিতে হস্তক্ষেপ করবেন। নারী তার সম্পদ খরচ করার ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা রাখেন। নারীদের আবেগ-অনুভূতির প্রতিও তিনি (সা.) যথেষ্ট খেয়াল রাখতেন। একবার নামাজ পড়ার সময় তিনি (সা.) একটি বাচ্চার কান্না শুনতে পেলেন। এ জন্য তিনি তাড়াতাড়ি করে নামাজ পড়ানো শেষ করলেন। পরে বললেন, একটি বাচ্চা কাঁদছিল, আমার মনে হলো, ওর মায়ের মনে নিশ্চয় কষ্ট হচ্ছে। কাজেই, আমি তাড়াতাড়ি নামাজ শেষ করলাম, যাতে বাচ্চাটার মা ওর খবর নিতে পারে’ (বোখারি, কিতাবুস সালাত)।

মহানবী (সা.) যখন কোনো সফরে যেতেন তখন মহিলারাও সঙ্গে থাকতেন, যার ফলে সকলকে তিনি ধীরে ধীরে চলতে বলতেন। একবার এরকম এক অবস্থায় যখন সৈনিকরা তাদের ঘোড়া ও উটগুলোকে লাগাম ঢিলা করে দিয়ে জোরে তাড়া করতে শুরু করল, তখন তিনি বললেন, ‘আরে করছো কি তোমরা! কাচের প্রতি খেয়াল রেখো! কাচের প্রতি খেয়াল রেখো! অর্থাৎ, করছো কি! মেয়েরাও তো সঙ্গে আছে। তোমরা যদি এভাবেই উট দাবড়াতে থাকো তাহলে তো ওই কাচগুলো ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে’ (বোখারি, কিতাবুল আদাব)।

যখন রাসুল করিম (সা.) এর ওফাতের সময় ঘনিয়ে এলো, তখন তিনি সব মুসলমানদেরকে একত্রে সমবেত করে যেসব অসিয়ত করেছিলেন, তার মধ্যে একটি কথা ছিল, ‘আমি তোমাদেরকে আমার শেষ অসিয়ত (উপদেশ) এই করছি যে, নারীদের সঙ্গে যেন সর্বদা উত্তম আচরণ করা হয়।’ তিনি এ কথাও প্রায়ই বলতেন যে, ‘যার ঘরে মেয়েরা আছে এবং সে তাদের লেখাপড়া শেখায়, এবং ভালোভাবে তরবিয়ত করে, খোদাতাআলা কেয়ামতের দিন তার জন্য দোজখ হারাম করে দেবেন’ (তিরমিযি শরিফ)।

সাধারণ আরবদের মধ্যে এটি রেওয়াজ ছিল যে, স্ত্রীলোকেরা যদি কোনো ভুল-ত্রুটি করত, তবে তাদেরকে মারধর করা হতো। হজরত রাসুল করিম (সা.) যখন বিষয়টা জানতে পারলেন, তখন তিনি বললেন, ‘নারীরা খোদাতায়ালার দাসী, তোমাদের নয়। তাদেরকে কখনোই মারধর করবে না।’ তিনি (সা.) আরো বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার স্ত্রীর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে না, কিংবা তাকে মারধর করে, তার সম্পর্কে আমি তোমাদেরকে বলে দিচ্ছি যে, সে খোদার দৃষ্টিতে সৎ বলে বিবেচিত হবে না।’ এ ঘোষণার পর নারীর অধিকার রীতিমতো প্রতিষ্ঠিত হয়। মহানবী (সা.) এর অনুগ্রহে প্রথমবারের মতো নারীরা স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করে। (আবু দাউদ, কিতাবুন নিকাহ)। হজরত মাবিয়া আল কুশায়বি (রা.) বলেছেন, ‘আমি রাসুল করিম (সা.) কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, হে আল্লাহর রাসুল! আমাদের ওপর স্ত্রীদের অধিকার কী?’ তিনি বললেন, ‘খোদা তোমাকে যা খেতে দিয়েছেন, তা তুমি তাকে খেতে দাও, খোদা তোমাকে যা পরতে দিয়েছেন তা তুমি তাকে পরতে দাও এবং তাকে থাপ্পর মেরো না, গালিও দিও না। এবং তাকে ঘর থেকে বের করে দিও না’ (আবু দাউদ)।

মহানবী (সা.) বলেছেন, নারীদেরকে পাঁজড়ের হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। তুমি যদি একবারে এটিকে সোজা করতে যাও, তবে ভেঙে ফেলবে। অর্থাৎ তাদের স্বভাবে কিছুটা বক্রতা রাখা হয়েছে। কিন্তু এটিই নারীদের সৌন্দর্য। তাদেরকে যদি একবারেই সোজা অর্থাৎ সংশোধন করার চেষ্টা করা হয় আর সে জন্য অশোভন ও কঠোর পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়, তবে সেটি কখনো সম্ভব হবে না। এভাবে সেই হাড় ভেঙে যেতে পারে, অর্থাৎ নারীরা বিগড়ে যেতে পারে। প্রেম-ভালোবাসা, সহনশীলতা ও পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের মাধ্যমে ধীরে ধীরে তাদের সংশোধন করতে হবে।

ইসলাম এমন একটি পবিত্র-ধর্ম, যা নারী-পুরুষ প্রত্যেকের অধিকার খুব সুন্দরভাবে সংরক্ষণ করে এবং একটি

সুন্দর সমাজ গঠনে নারী-পুরুষ উভয়ের অবদান রাখার কথা ঘোষণা করে। তাই এ কথা স্বীকার করতে হবে, ইসলামে মহানবী (সা.) নারীর যে মর্যাদা, অধিকার ও সম্মান প্রতিষ্ঠা করেছেন তা বিরল। একটি পরিবারে নারীর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সন্তানের লালন পালন, স্বামীর সেবা যতœ, সর্বোপরি একটি পরিবারকে আগলে রাখে একজন নারী। আল্লাহ্ আমাদের সকলকে নারীদের এ মর্যাদা উপলব্ধি করার এবং সেটি রক্ষা করার সৌভাগ্য দান করুন।

লেখক : ইসলামী গবেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist