মীর আব্দুল আলীম

  ২৭ জুলাই, ২০১৭

মাদক

বাহ্ ...ভালোই তো! ‘ইয়াবা বার’

রাজধানীতে এবার ‘ইয়াবা বার’। বাহ্...ভালোই তো! এমন শিরোনামের খবরও আমাদের পড়তে হলো। খবরে প্রকাশ, রাজধানীর বেশ কয়েকটি এলাকায় তৈরি হয়েছে মাদক বিক্রির স্পট। এসব জায়গায় ইয়াবা সেবনের জন্য নির্দিষ্ট রুম ভাড়াও দেওয়া হচ্ছে। স্থানীয়ভাবে এগুলোকে ইয়াবা বার বলে আখ্যা দিচ্ছেন কেউ কেউ। ‘ইয়াবা’ হালের মাদক সা¤্রাজ্যে অন্যতম উচ্চারিত শব্দ। মাদকের এ মরণ থাবায় প্রাণ যাচ্ছে ছোট-বড়, তরুণ-তরুণী, এমনকি কর্মজীবী নারী এবং গৃহিণীদের। এ নেশাকে ঘিরেই তৈরি হয়েছে ইয়ার বার। প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে ইয়াবা তৈরি হয়। তা প্রতিদিন আমাদের দেশে এনে বিক্রি করে একশ্রেণির মানুষ। এতে একদিকে তারা কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে, অন্যদিকে আমাদের যুবসমাজ ইয়াবা আসক্ত হয়ে পড়ছে। ইয়াবার প্রসারতা এতই বেড়েছে যে, প্রধানমন্ত্রী ইয়াবার বিয়য়ে সম্প্রতি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। মাদক সেবনের কুফল সম্পর্কে মাঝেমধ্যেই মহাসমারোহে আলোচনা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম হয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে বিপুল অর্থ ব্যয় করা হয়। বিভিন্ন এনজিও মাদক সেবনে নিরুৎসাহিত করতে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। মাদক পাচার, বহন ও ব্যবহারের বিভিন্ন শাস্তির বিধান রয়েছে। তবু মাদকের ব্যবহার কমেনি। বরং ফেনসিডিল, গাঁজা, হেরোইন, ইয়াবা, প্যাথেডিনের ব্যবসা রমরমা হচ্ছে। নারী, পুরুষ উভয় শ্রেণির মধ্যে মাদক সেবনের প্রবণতা বাড়ছে। ঘুমের ওষুধ, হেরোইন, গাঁজা, এমনকি কুকুর মারার ইনজেকশন সেবন করছে মাদকসেবীরা। বিষ শরীরে ঢুকিয়ে নেশা করার মতো অভ্যাসও গড়ে উঠছে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে।

প্রশাসন নির্বিকার। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন সবই জানে। তারা জানে কোথায় মাদকদ্রব্য বিক্রি হয়, কোথা থেকে আসে আর কারাই বা বিক্রি করে। কিন্তু মাদক ব্যবসায়ীদের ধরা তো দূরের কথা, সংশ্লিষ্টরা এর পাড় ঘেঁষেও দাঁড়াতে রাজি নয়। সময়মতো মাসোহারা পেলেই তারা তুষ্ট থাকেন। মাদকের প্রসারতায় আমাদের সরকারের সম্মতি আছেÑএ কথা বলার সুযোগ নেই, তবে সরকারে কর্তাবাবুদের ম্যানেজ হয়ে যাওয়ার কারণে মাদক কারবারিরা প্রতিদিন দেশে মাদকে সয়লাব করে দিচ্ছে। ভারতের সীমান্তে অসংখ্য ফেনসিডিলের কারখানা আছে। সেখানেও এই একই ব্যবস’া। পার্শ্ববর্তী দেশগুলো আমাদের দেশে মাদকের বাজার তৈরি করে নিয়েছে। মাদক ব্যবসার সঙ্গে দেশের অনেক রাঘববোয়াল জড়িত। তাই ওদের টিকিটিও ছোঁয় না কেউ।

মাদক নির্মূলে পুলিশের দায়িত্বটা একটু বেশি। আজকাল পত্রপত্রিকাতে যা দেখছি তাতে মাদক নির্মূলের চেয়ে পুলিশ মাদকের লালন করছে বেশি। পুলিশের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসায়ীদের সহায়ত করা, কোথাও কোথাও পুুলিশ নিজেরাই মাদক বিক্রে করার মতো ঘৃণ্য অপরাধ করছে। মাদক যেন আজ মুড়ি-মুড়কির মতো দেশময় ছড়িয়ে পড়েছে। পত্রিকার সূত্র মতে, দেশে বছরে ২৫ হাজার কোটি টাকার মাদক কেনাবেচা হয়। মাদক গ্রহণকারীর সংখ্যা কত তার সঠিক পরিসংখ্যান কারো কাছে নেই। সরকার বলছে, ৫০ লাখ; কিন্তু বেসরকারি সূত্রমতে, ৭০ লাখেরও বেশি। তবে আমরা ধারণা করতে পারি, এর সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি। এদের অধিকাংশই যুবক-যুবতী ও তরুণ-তরুণী। গৃহকর্তা-গৃহবধূও আছে। মাদক গ্রহণকারীর ৮০ ভাগের বয়স ১৫ থেকে ৩৫ বছর। বিশ্বের নেশাগ্রস্ত দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭ম। এর ভয়াল থাবা বিস্তৃত হয়েছে শহর হতে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত। বিভিন্ন মাদকের মরণ নেশায় প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছে ৮-১০ বছরের শিশু হতে শুরু করে নারী এমনকি বৃদ্ধরাও। ২০০২ সালে দেশে মাদক অপরাধীর সংখ্যা ছিল ৬ শতাংশ। বর্তমানে তা ২০ শতাংশের বেশি।

বর্তমান বাংলাদেশে মাদকের বাজার বেশ জমজমাট। চারপাশে মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও লাওস নিয়ে গঠিত ‘গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল’। ভারত, নেপাল ও তিব্বতের সীমান্তবর্তী অঞ্চল নিয়ে ‘গোল্ডেন ওয়েজ’ এবং পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও ইরানের সীমান্তবর্তী অঞ্চল নিয়ে ‘গোল্ডেন ক্রিসেন্ট’ বাংলাদেশকে ঘিরে ফেলেছে। ফলে বাংলাদেশ বিশ্বের বৃহত্তম মাদক উৎপাদক ও ব্যবসায়ীদের থাবার মধ্যে অবস্থান করছে। বাংলাদেশকে ঘিরে প্রতিবেশী দেশের সীমান্তে গড়ে উঠেছে হাজার হাজার ফেনসিডিলের কারখানা। সংঘবদ্ধ চক্র মিয়ানমার হতে কক্সবাজার দিয়ে সারা দেশে সুকৌশলে ছড়িয়ে দিচ্ছে ইয়াবা। নতুন নেশা ইয়াবার ফাঁদে জড়িয়ে পড়ছে তরুণ সমাজ। বিশেষ করে স্কুল- বিশ্ববিদ্যালয়গামী ছেলেমেয়েরা। ফেনসিডিল, হেরোইন, ইয়াবার কোনোটি দেশে উৎপাদিত না হলেও তা পাওয়া যাচ্ছে যত্রতত্র। সামাজিক সমস্যা ছাপিয়ে এটি যেন গত দু’দশকে পারিবারিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে।

বর্তমান সমাজ জীবনে মাদকের ব্যবহার সবাইকেই উদ্বিগ্ন করেছে। এর বিষাক্ত ছোবল অকালে কেড়ে নিচ্ছে অনেক প্রাণ। অনেক সম্ভাবনাময় তরুণ-তরুণী হচ্ছে বিপথগামী। এ থেকে পরিত্রাণের আশায় ১৯৯০ সালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন (১৯৯০ সালের ২০নং আইন) প্রণীত হয়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ ও মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনকল্পে ওই আইন ১৯৯০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি প্রণয়ন করা হয়। ওই আইনের ২(ঠ) ধারায় মাদকের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। সে মতে, মূলত অপিয়াম পপি বা তৎনিঃসৃত আঠালো পদার্থ; আফিম; আফিম থেকে উদ্ভূত মরফিন, কোডিন, হেরোইন ইত্যাদি এবং এগুলোর ক্ষারগুলো; শতকরা ০.২ শতাংশের অধিক মরফিনযুক্ত যেকোনো পদার্থ, কৃত্রিম উপায়ে তৈরি আফিমের সমধর্মী দ্রব্য যথাÑপেথিডিন, হাইড্রোমরফিন, ডিমেরাল, বেটাপ্রোডাইন ইত্যাদি, কোকা পাতা এবং তা থেকে উদ্ভূত সব দ্রব্য, কোকেন এবং ০.১ শতাংশের অধিক কোকেনযুক্ত যেকোনো পদার্থ অথবা কোকেনের যেকোনো ক্ষার, চরস, হাশিশ, গাঁজা গাছ, গাঁজা, ভাং গাছ, ভাং, গাঁজা বা ভাং সহযোগে প্রস্তুত যেকোনো পদার্থ, অ্যালকোহল এবং ০.৫ শতাংশের অধিক এলকোহলযুক্ত যেকোনো পদার্থ, রেক্টিফাইড স্পিরিট এবং তৎসহযোগে যেকোনো ওষুধ বা তরল পদার্থ, বিয়ার, বারবিচুয়েটস, তাড়ি, পচুই, মেথিলেটেড স্পিরিট ইত্যাদি দ্রব্য মাদক হিসেবে পরিচিত। ভারতে তৈরি ফেনসিডিল সিরাপ আমাদের দেশে মাদক হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এই সিরাপের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান আফিম থেকে উদ্ভূত কোডিন, এই কারণেই ফেনসিডিল সিরাপ সেবন করলে মাদকতা আসে। তাই ফেনসিডিল সিরাপ মাদক হিসেবে পরিচিত। অ্যালকোহল ব্যতীত অন্য কোনো মাদকদ্রব্যের চাষাবাদ, উৎপাদন, প্র্রক্রিয়াজাতকরণ, বহন, পরিবহন, আমদানি-রফতানি, সরবরাহ, ক্রয়-বিক্রয়, ধারণ, সংরক্ষণ, গুদামজাতকরণ, প্রদর্শন, প্রয়োগ ও ব্যবহার ওই আইনের ৯ ধারায় নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিংশ শতাব্দীর নবম দশকে (১৯৮১ থেকে ১৯৯০ সাল) বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে মাদকের ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ে। ওই সময় বিদেশ থেকে আসা মাদক সম্পর্কিত অপরাধের বিচার করা হতো ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন অনুসারে। সেখানে শুধু শুল্ক ফাঁকি দিয়ে চোরাইপথে আমদানি নিষিদ্ধ পণ্য দেশে নিয়ে আসা বা নিজ হেফাজতে রাখার অপরাধেই আসামির বিচার হতো। জনজীবনে ব্যাপক ক্ষতিসাধনকারী এই মাদকসংক্রান্ত অপরাধ দমনের জন্য ওই আইন পর্যাপ্ত ছিল না। তাই মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ এবং মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনকল্পে ১৯৯০ সালে ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন’ প্রণয়ন করা হয়। ১৩৯৬ বঙ্গাব্দের ১৯ পৌষ মোতাবেক ১৯৯০ সালের ২ জানুয়ারি তারিখ থেকে এ আইন কার্যকর হয়। কিন্তু ২০ বছরেরও অধিককালের পথপরিক্রমায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রিত হয়নি। এর ব্যবহার এবং প্রসার বেড়েই চলেছে।

একটি প্রজন্ম ধ্বংস হওয়ার আগে আমাদের সবার দায়িত্ব হবে দেশ থেকে মাদক নির্মূল করা। এজন্য দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, এমপিসহ সবাইকে যে যার জায়গা থেকে মাদকের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে। হুঙ্কার দিতে হবে দেশ থেকে মাদক নির্মূল করার। আমরা বিশ্বাস করি, রাষ্ট্রের চেয়ে মাদক সিন্ডিকেট মোটেও শক্তিশালী নয়। রাষ্ট্র চাইলে দেশের মাদক প্রসারতা কমতে বাধ্য। আর রাষ্ট্র তা প্রমাণ করে দেখাবে, এ প্রত্যাশা রইল।

লেখক : সাংবাদিক, গবেষক ও কলামিস্ট।

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist