ইফতেখার আহমেদ টিপু

  ২৬ জুলাই, ২০১৭

মরা খাল

মশক উৎপাদনের কারখানা

রাজধানী থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে একের পর এক প্রাকৃতিক জলাধার। গত ৩২ বছরে ঢাকা মহানগরী থেকে উধাও হয়ে গেছে ৩৯টি খাল। এর মধ্যে রয়েছে ধোলাইখাল। রাজধানীতে এ মুহূর্তে ১৫টি খাল থাকলেও এর চারটি লেক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে টিকে আছে। অন্যগুলো ভরাট-দখলে সঙ্কুচিত হয়ে নর্দমার আকৃতি পেয়েছে।

ঢাকা ওয়াসার হিসাবেই নগরীতে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত ৫৪টি খালের অস্তিত্ব ছিল। এসব খালের সংযোগ ছিল রাজধানী লাগোয়া প্রধান চারটি নদ-নদীর সঙ্গে। সূত্রাপুর লোহারপুল হয়ে বুড়িগঙ্গা, মোহাম্মদপুরের বছিলা হয়ে বুড়িগঙ্গা, উত্তরার আবদুল্লাহপুর হয়ে তুরাগ, উত্তরখান হয়ে তুরাগ, খিলক্ষেত ডুমনি হয়ে বালু ও মানিকনগর হয়ে শীতলক্ষ্যা নদীর সঙ্গে সংযোগ ছিল খালগুলোর। রাজধানীর এসব খাল ও অন্যান্য জলাশয় এখন বিস্মৃত অতীত মাত্র। আবদুল্লাহপুর খালটি হরিরামপুর, রানাভোলা, আবদুল্লাহপুর, উত্তরা, দলিপাড়া হয়ে বাউনিয়ায় তুরাগ নদীতে মিশেছে। রাস্তা ও রাজউকের প্লটের কারণে খালটি এরই মধ্যে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে এখন ছোট ছোট নালায় পরিণত হয়েছে। উত্তরা ৯ নম্বর সেক্টর অংশে লেকের উত্তর প্রান্ত দখল করা হয়েছে ময়লা ফেলে। উত্তরা ১০ নম্বর সেক্টরের দক্ষিণ পাশে বহমান খালটি এখন পুরোপুরি নর্দমা হিসেবেই ব্যবহৃত হচ্ছে। রাজধানীর পূর্বাঞ্চলের এক সময়ের সুবিখ্যাত মা-া খাল সবুজবাগ থেকে শুরু হয়ে মাদারটেক, দক্ষিণগাঁওয়ের পাশ দিয়ে বালু নদীতে মিশেছে। দীর্ঘদিন ধরে এটি ওই এলাকার পয়ঃনিষ্কাশনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। দখল-দূষণে অনেক আগেই সঙ্কুচিত হওয়া খালটি এখন ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। খাল বিল জলাশয় যথেচ্ছভাবে দখলের পরিণতিতে বর্ষা হলেই রাজধানীতে জলাবদ্ধতার অভিশাপ নেমে আসে। প্রাকৃতিক জলাশয়ের যে সামান্য অংশ টিকে আছে তা দখল ও দূষণের কারণে স্বাভাবিক অবস্থা হারিয়েছে বহু আগেই এবং তা মশক উৎপাদনের কারখানায় পরিণত হয়েছে।

জানা গেছে, কল্যাণপুর ‘চ’ খালও বেশ কিছু জায়গায় দখল হয়ে আছে। রামচন্দ্রপুর খালের ২০০ মিটার অংশেই ৩০ ফুট জায়গা ভরাট করে রাস্তা তৈরি করেছে সিটি করপোরেশন। এ খালের মোহাম্মদপুর শিয়া মসজিদসংলগ্ন স্থানে ৬০ ফুটের স্থলে ৩০ ফুট রয়েছে। খিলগাঁও-বাসাবো খালের খিলগাঁও ফ্লাইওভারসংলগ্ন ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুলের সামনেই আরেকটি ফলক। কিন্তু খিলগাঁও অংশ থেকে তিল্পাপাড়া পর্যন্ত খালের কোনো চিহ্ন চোখে পড়ে না। খাল ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে বেশ কিছু দোকান। এটি খিলগাঁওয়ের ভেতর দিয়ে বাসাবো হয়ে মা-া খালে গিয়ে মিশেছে। ওয়াসার নথিপত্রে খালটির প্রস্থ স্থানভেদে ১৬ থেকে ৩২ ফুট। বাস্তবে সেটা কোথাও পাওয়া যায় না। তিল্পাপাড়া থেকে আমানুল্লাহ সুপার মার্কেট পর্যন্ত খাল ভরাট করে কিছু স্থানে পাইপ ড্রেন তৈরি করা হয়েছে। উত্তরার দক্ষিণ আজমপুর থেকে শুরু হয়ে কসাইবাড়ী হয়ে মোল্লারটেক গিয়ে শেষ হওয়া কসাইবাড়ী খালটিকে সাধারণভাবে বোঝার উপায় নেই। ছোট একটি ড্রেনে পরিণত হয়েছে খালটি। এ খালটির দৈর্ঘ্য আট হাজার মিটার এবং প্রস্থ ১০-১২ মিটার আছে। খালের শুরুর দিকে দক্ষিণ আজমপুরের জামতলা নামক স্থানে প্রস্থে চার মিটার থাকলেও মোল্লারটেকে গিয়ে দুই মিটার হয়েছে। চলতি মাসের ১৬ তারিখ ডিএনসিসির সমন্বয় সভায় ঢাকায় জলাবদ্ধতার কারণ এবং রাজধানীর খালগুলোর বর্তমান অবস্থা নিয়ে একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সংস্থাটির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. শরীফ উদ্দিন। প্রতিবেদনে তিনি বলেন, মিরপুরের বাউনিয়া খাল মিরপুর এলাকার পানি নিষ্কাশনের প্রধান মাধ্যম। তবে মাটিকাটা সড়কের কালভার্টের কাছে খাল সাত ফুট হয়ে গেছে। ফলে পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কল্যাণপুর ‘খ’ খাল কাগজে-কলমে ৪০ ফুট হলেও অনেক জায়গায় খালের কোনো অস্তিত্ব নেই।

এ ছাড়া সরকারি নথিতে ৬০ ফুট প্রশস্ত বাসাবো খাল এখন ৩০ ফুট, রামচন্দ্রপুর খাল ১০০ ফুটের স্থলে ৬০ ফুট, মহাখালী খাল ৬০ ফুটের স্থলে ৩০ ফুট, দ্বিগুণ খাল ২০০ ফুটের বদলে ১৭০ ফুট, আবদুল্লাহপুর খাল ১০০ ফুটের বদলে ৬৫ ফুট, কল্যাণপুর প্রধান খাল ১২০ ফুটের বদলে স্থানভেদে ৬০ থেকে ৭০ ফুট, কল্যাণপুর ‘ক’ খালের বিশিল অংশে এখন সুরু ড্রেন, রূপনগর খাল ৬০ ফুটের স্থলে ২৫-৩০ ফুট, ইব্রাহিমপুর খালের কচুক্ষেতসংলগ্ন মাঝামাঝি স্থানে ৩০ ফুটের স্থলে রয়েছে ১৮ ফুট।

চলতি বর্ষা মৌসুমে রাজধানীতে জলাবদ্ধতার অস্বস্তিকর থাবা নাগরিকদের বুঝিয়ে দিয়েছে খালসহ প্রাকৃতিক জলাশয়ের বিলুপ্তি তাদের জন্য কী অভিশাপ সৃষ্টি করছে। জলাবদ্ধতার অবসান শুধু নয়, রাজধানীতে শ্বাস নেওয়ার মতো পরিবেশ বজায় রাখতে দখল হয়ে যাওয়া খালগুলো উদ্ধার ও তা পুনঃখননের উদ্যোগ নিতে হবে। ঢাকাকে দূষণমুক্ত করতে হলে সর্বাগ্রে এই খালগুলোকে পুনরুদ্ধার করে তাকে তার পুরনো জীবন ফিরিয়ে দিতে হবে। অন্যথায় এই নগরী অচিরেই একটি পরিত্যক্ত নগরীতে পরিণত হতে পারে। যা কখনই আমাদের কাম্য হতে পারে না।

লেখক : চেয়ারম্যান ইফাদ গ্রুপ

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist