নুরউদ্দিন আহসান

  ২৬ জুলাই, ২০১৭

মতামত

বন্যা ও আমাদের রাজনীতি

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। তবে বর্তমান সময়ে নদীমাতৃক কি না তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কেননা নদীর প্রাণ হলো পানি, যা আজ নেই বললেই চলে। নদী তার প্রাণবায়ু হারিয়ে মরতে বসেছে। প্রশ্ন হলো, কেন আজ প্রবহমান নদীগুলোর এই পরিণতি? বিষয়টি অনেকের কাছে দিবালোকের মতো পরিষ্কার। প্রতিবেশী দেশ ভারতের কারণেই আজ শত শত নদী বিলীন হয়ে যাচ্ছে। আর আমাদের উদাসীনতাও এর জন্য কম দায়ী নয়। এছাড়া ফারাক্কা বাঁধের কথা কে না জানে। ভারতের ইচ্ছার ওপরই নির্ভর করে পানি পাওয়া না পাওয়ার বিষয়টি। শুধু ফারাক্কাই নয়, ৫৩টি নদীতে বাঁধ দিয়ে ভারত আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে আমাদের ন্যায্য পানি লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। আবার অতিরিক্ত বর্ষা, বন্যা বা পাহাড়ি ঢলের কারণে যদি তাদের পানি বেড়ে যায় তখন নিজেদের নিরাপদ রাখতে সকল বাঁধের মুখ খুলে দিয়ে বন্যায় ভাসিয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশের নি¤œাঞ্চল। এবার ভারতের গজলডোবা ব্যারাজের অধিকাংশ গেইট খুলে দেওয়ার কারণে তিস্তার পানি বেড়েছে, ডুবেছে শত শত বাড়ি, গ্রাম ও জনপদ। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আসাম ও অরুণাচলÑএই দুই প্রদেশের বন্যার পানি নেমে আসছে বলেই দেশে নদীর পানির বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যে নদীগুলোতে কিছু দিন পূর্বেও মানুষ হেঁটে পার হতো। ধান চাষ করত। গরু-ছাগল চরাত। সেখান আজ পানি আর পানি।

সিলেট দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি বলেছে, ৮৬টি উপজেলার ৫৫টি ইউনিয়নে দীর্ঘ মেয়দি বন্যা দেখা দিয়েছে। ৪ হাজার ৩০০ হেক্টর আউশ ধান ও ৩৫ হেক্টর আমন ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শুধু যে সিলেট জেলায় তা নয়, এমন করে প্রায় বারটি জেলায় আরো বেশি পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে যে পরিমাণ ক্ষতি আমাদের হয়ে যাচ্ছে তা কি সহজেই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব? কেননা কিছু দিন পূর্বে হাওরে হয়ে গেল স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা। ক্ষতিগ্রস্ত হলো হাজারো পরিবার। উৎপাদিত কৃষিপণ্যের মধ্যে ধানের ক্ষতি হয়েছে প্রায় দশ লাখ টন। একইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মাছ ও অন্যান্য ফসল। যার ক্ষতচিহ্নগুলো মানুষ এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে। এই ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে না উঠতেই রাতের গভীরে পাহাড়ধসে ঝরে গেল ১৬২টি তাজা প্রাণ। স্বাভাবিক কারণেই মনে হতে পারে, আমরা এই চলমান ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারব কি না। অসম্ভবের কিছু নেই। যদি আমাদের সৎ ইচ্ছা থাকে, তাহলেই সম্ভব। এ ব্যাপারে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আলোচ্য জেলাগুলোতে ৩০০ টন চাল ও ৫১ লাখ টাকা ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। এই বরাদ্দের বাইরেও এখনো প্রতিটি বন্যাপ্রবণ জেলায় ৫০ টন চাল ও ৫ লাখ করে টাকা দেওয়া হবে। যদিও এই বরাদ্দ, যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে সে তুলনায় খুবই অপ্রতুল। তবুও ‘নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো।’ তবে, এখানে একটি বড় ধরনের প্রশ্ন থেকে যায়। আর তা হলো যে মানুষগুলোর জন্য এই লাখ টাকা বরাদ্দ করা হলো তাদের হাতে কি এই টাকা পৌঁছবে? নাকি টেবিল ঘুরে আসতে না আসতেই শেষ হয়ে যাবে! প্রশাসনের যদি সৎ ইচ্ছা থাকে, তাহলে সঠিক সময়ে সঠিক ক্ষতিগ্রস্তদের হাতে তুল দেওয়া সম্ভব। নচেৎ অচেনা কোনো রাঘববোয়ালের হাতে পড়ে সব হারানোর সম্ভাবনাও কম নয়। সম্প্রতি পঞ্চগড়ে ৭৩১ বস্তা ত্রাণের চাল জব্দ করা হয়েছে। যা দিয়ে এই হতদরিদ্র মানুষের এক বেলা খাবারের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু আমাদের মধ্যে থাকা কিছু মানুষের লোভের কারণে সেই চাল এই মানুষগুলো পর্যন্ত পৌঁছায়নি। এবারো এমন অভিযোগ রয়েছে, ত্রাণ পেতে হলে ঘুষ দিতে হচ্ছে।

মানুষ মানুষের বিপদে এগিয়ে আসবে তার ব্যথায় ব্যথিত হবে। তার কষ্টে কষ্ট অনুভব করবে। এটাই মানুষের ধর্ম। সব ধর্মেই মানব সেবার কথা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সময় বদলেছে। বদলে গেছে নীতিকথা। মানুষের জন্য মানুষ নয়, দলীয় লোকের জন্য দলীয় লোক ব্যথিত হচ্ছেন। তার কষ্টে নেতার হৃদয়ে কষ্ট অনুভব হয়। অন্য কারো জন্য নয়। যেখানে জীবন বাঁচানোর জন্য এক মুঠো ভাত আর এক টুকরো শুকনো খাবারের আশায় দিনের পর দিন মানুষগুলো চেয়ে আছে। যখন শুনে কোনো ত্রাণসামগ্রী এসেছে খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায় বানভাসী মানুষগুলো। সেখানেও যদি আমাদের এই রাজনীতির কাদা ছোড়াছুড়ির কারণে দরিদ্র মানুষগুলোকে বলির পাঁঠা হতে হয়। তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে, কোন সভ্য সমাজে আমরা বসবাস করছি। প্রশ্ন জাগতেই পারে, রাজনীতি আগে না মানুষ আগে। একটা কথা মনে রাখা দরকার, এই মনুষগুলোই আমাদের ক্ষমতায় যাওয়ার প্রধান উৎস। নেতারা প্রতিশ্রুতি দেন, ‘আমি সর্বদা আপনাদের পাশে থাকব। সমাজ সেবায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করব।’ কিন্তু আজ যারা নির্বাচিত হয়েছেন তারা তাদের দেয় প্রতিশ্রুতি পালন করছেন না। প্রতিশ্রুতি দেওয়ার সময় কি কেউ বলেছেন, তিনি শুধু দলীয় লোকদের সেবা করবেন? যদি তা না হয় তাহলে কেন ত্রাণ বিতরণের সময় শুধু দলীয় লোকদের প্রতি সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। আজ আমরা ক্ষমতা হাতে পেয়ে কতটা নিচে নেমেছি! এই নিচে নামার নামই কি রাজনীতি? এটাই কি আমাদের সুস্থ রাজনীতির উপমা! আবারও প্রমাণ হলো মানুষ তার নিজ স্বার্থের জন্য কাঁদে, কষ্টে ব্যথিত হয়। যদিও সবাই এক নয়। আজ আমরা ত্রাণ বিতরণের নামে ফটোসেশন নিয়ে ব্যস্ত। যদিও এর পেছনে অনেক দূরদর্শিতা কাজ করছে। কেননা এই ত্রাণ বিতরণের ফটোসেশন দিয়ে নেত্রীর মনজয় করে আগামী নির্বাচনের মনোনয়নটা ধরা যায়। সে লক্ষ্যেই যেন চলছে সব কার্যক্রম। আমাদের মনে রাখা দরকার, যে মানুষগুলো এই বন্যার কবলে পড়েছে তারা অধিকাংশই দিনমজুর। অন্যের জমিতে চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে। খুব সহজেই অনুমান করা যায় মানুষগুলো খুব তাড়াতাড়ি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে না। এ জন্য প্রতিটি বিত্তমান মানুষের উচিত নিজ উদ্যোগে হোক কিংবা কোনো সংস্থার ব্যানারে হোক, এই হতদরিদ্র মানুষের পাশে এসে দাঁড়ানো। এখানে সবচেয়ে বেশি যে জিনিসগুলো প্রয়োজন তা হলো বিশুদ্ধ পানি, শুকনো খাবার এবং প্রয়োজনীয় মেডিসিন। আর গর্ভবতী মা ও শিশুর জন্য বিশেষ কোনো ব্যবস্থা করা। এটা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। আর সরকারের উচিত তাদের জন্য সাহায্য অব্যাহত রাখা।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist