এস এম মুকুল
দ্রোহী
দুরাচারের স্বপ্ন : মাই সেকেন্ড হোম
বাংলাদেশের মানুষের অনেক টাকা। কথাটা কি ঠিক? না ঠিক নয়। কথাটি হওয়া উচিত- বাংলাদেশের কতিপয় মানুষের অঢেল অর্থ রয়েছে। যে পরিমাণ অর্থ তারা নানান তর্কিত পথে কামিয়েছে তাতে তাদের ১০ প্রজন্ম বসে খেলেও শেষ হবে না। এমন অঢেল অর্থের বাহারি খবর আমরা পেয়ে থাকি সুইস ব্যাংকে অর্থ জমার উপাত্ত এবং অর্থ পাচারের কাহিনির মাধ্যমে। বলতে দ্বিধা নেই এই শ্রেণির বাঙালিরা দেশে অর্থ কামিয়ে দেশে অর্থ রাখাকে নিরাপদ মনে করে না। এমনকি তারা দেশে অবস্থানের বিষয়েও শঙ্কিত। যে কারণে তারা মালয়েশিয়াকে সেকেন্ড হোম হিসেবে বেছে নিয়েছে। এরা কখনই রাষ্ট্রের পক্ষশক্তি নয়, এদেরকে রাষ্ট্রদ্রোহী বললেও হয়তো বেশি বলা হবে না।
কেন মানুষ মালয়েশিয়াকে সেকেন্ড হোম হিসেবে বেছে নিচ্ছে আগে সেই প্রশ্নটির উত্তর খোঁজা দরকার। তার উত্তরও অনেক রকম হতে পারে। যেমন- অতি ধনে গাত্রদাহন মেটাতে বিলাসিতা, অবৈধ অর্থ আড়াল করে আখের গোছানো অথবা দেশের মাটিকে নিরাপদ মনে না করা। গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটির তথ্যমতে, বৈশ্বিক অর্থ পাচারে বাংলাদেশ ২৬তম অবস্থানে আছে। আমদানি পণ্যের অতিমূল্য ও রফতানি পণ্যের কম মূল্য দেখানোর কায়দায় ২০০৪ সালে পাচার হয়েছিল ৩৩৫ কোটি ডলার। ২০১৩ সালে তা বেড়েছিল ৮৩৬ কোটি ডলারে। বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর অর্থ পাচার বাড়ছে। বড় ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদরা পাচার করছেন কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়াসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। মধ্যম মানের রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আমলা ও কালো টাকার মালিক অর্থপাচার করছেন দুবাই, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও ভারতে। তারা সেখানে বাড়ি কেনা, জমি কেনা, আবাসিক হোটেল ব্যবসা, কারখানা স্থাপনের পাশাপাশি ব্যাংকগুলোতেও নগদ অর্থ রেখে দিচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাজ্যের লন্ডন, কানাডাসহ ইউরোপ-এশিয়ার বড় বড় শহরে বাংলাদেশিদের আলিশান বাসাবাড়ির যেন অন্ত নেই। এসব দেশে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের পাঁচতারা হোটেল ব্যবসা, গার্মেন্ট কারখানা, ওষুধ শিল্পসহ নানা খাতে বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে। শীর্ষ রাজনীতিবিদ, ব্যাংকার ও
আমলারা দেশ থেকে টাকা পাচার করে বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। এই মানসিকতার বাঙালিরা বিদেশ ভ্রমণে গিয়ে সেখানে থাকেন, কিন্তু এসব ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে পাচার করা অর্থ দেশে ফেরত আনার উদ্যোগ নেওয়া হয় না। এ কারণেই ব্যাপক কড়াকড়ির মধ্যেও দেশ থেকে অর্থ পাচার কমছে না, বরং বাড়ছে।
‘মালয়েশিয়ায় দ্বিতীয় নিবাস গড়ার কর্মসূচি মালয়েশিয়া মাই সেকেন্ড হোমে (এমএম২এইচ) অংশগ্রহণের তালিকায় তৃতীয় শীর্ষ অবস্থানে বাংলাদেশিরা। ভালোমন্দ দিক নিয়ে বিতর্ক থাকলেও খবরটির চমৎকারিত্ব আছে বৈকি। মালয়েশিয়ার নিউ স্ট্রেইটস টাইমসের খবরে জানা গেছে, ৩ হাজার ৫৪৬ বাংলাদেশি মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম গড়েছেন। এই কর্মসূচির আওতায় ২০০২ সাল থেকে এই বছর পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় দ্বিতীয় বাড়ি বা সেকেন্ড হোম গড়ার অনুমতি পেয়েছেন ১২৬টি দেশের ৩৩ হাজার ৩০০ মানুষ। বলা হচ্ছে, সেকেন্ড হোম গড়ার পুরো টাকার জোগান এসেছে পাচার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। ভাবতে অবাক লাগে দেশের লাখো মানুষ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শ্রম ও মেধা খাটিয়ে বৈদেশিক মুদ্রায় সমৃদ্ধ করছে বাংলাদেশকে। তার পুরো উল্টো কাজটি করছে দেশের অভ্যন্তরে থাকা একশ্রেণির মানুষ। তারা অবৈধ পথে উপার্জন করে দেশের বাইরে সেই টাকা পাচার করছেন অবলীলায়। বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, প্রচলিত নিয়মে দেশ থেকে সেকেন্ড হোম করার জন্য অর্থ নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) বলছে, গত বছর অর্থ পাচারের ৩২টি ঘটনা ধরা পড়েছে এ ইউনিটের তদন্তে, যার মধ্যে মালয়েশিয়ায় অর্থ পাচারের ঘটনাও আছে। এই অর্থ পাচারের আচার যদি বন্ধ করা যেত তাহলে এই টাকা দিয়ে দেশে বড় বড় আধুনিক শহর, উপশহর, শিল্প-কলকারখানা গড়ে তোলা সম্ভব হতো। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়াই দেশের বাইরে টাকা নেওয়া হয়েছে। আইনগতভাবে এভাবে এ টাকা নিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বলা হচ্ছে, হুন্ডির মাধ্যমে দেশ থেকে পাচার হওয়া প্রায় সাড়ে ৪২ হাজার কোটি
টাকায় মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম বা দ্বিতীয়
আবাসস্থল গড়া হয়েছে। আরো ৪ হাজার ৮০৪ জন সেকেন্ড হোমের আবেদন করে অপেক্ষায় রয়েছেন। তথ্য উপাত্ত বলছে, সেকেন্ড হোমের আবেদন করতে হলে মালয়েশিয়ার মুদ্রায় পাঁচ লাখ রিঙ্গিত বা বাংলাদেশি টাকার অঙ্কে প্রায় এক কোটি টাকা আগে জমা দেখাতে হয়। এ হিসাবে আরো প্রায় পাঁচ
হাজার কোটি টাকা চলে গেছে। অর্থাৎ পাচার হয়েছে ৪৭ হাজার কোটি টাকা।
জনশ্রুতি আছে, এদেশের সমৃদ্ধির বারো আনাই খেয়ে ফেলে দুর্নীতি। সরকারি কাজে দুর্নীতির অত্যাচারে নীতিবানদের চরম দুর্দশার শেষ নেই। বেসরকারি খাতেও এ রোগ ছড়িয়ে গেছে ক্যানসারের মতো। আমাদের সরকারগুলোর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, স্বেচ্ছাচারিতা আর ক্ষমতার অপব্যবহারে কলুষিত হয়ে দেশ দুর্নীতির ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। নীতিভ্রষ্টতা রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে ছড়িয়ে গেছে সর্বসাধারণের মাঝে। ফলে ধ্বংস হয়েছে সব প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে চলছে নিয়ম ভাঙার মহোৎসব। মিডিয়া বলছে, বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের অঢেল গোপন অর্থ আছে ক্যারিবীয় অঞ্চলের ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডসে। বলা হয়েছে, ওই দ্বীপাঞ্চলে অর্থ আমানতকারীর তালিকায় বাংলাদেশের কমপক্ষে ২০ জন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালী রাজনীতিকের নাম আছে। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক বা সুইস ব্যাংকগুলোয় বাংলাদেশিদের গচ্ছিত টাকার কথা নাইবা বললাম।
ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) তথ্যমতে, বাংলাদেশ থেকে ২০১৪ সালে প্রায় ৯১১ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। টাকার অঙ্কে যা প্রায় ৭২ হাজার ৮৭২ কোটি টাকা। আমদানি-রফতানির সময়ে পণ্যের প্রকৃত মূল্য গোপন করার মাধ্যমেই এই অর্থের বড় অংশ পাচার করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। আমাদের দেশে বাজেট এলেই আলোচিত বিষয়ে পরিণত হয় কালো টাকা। অথচ কালো টাকার বলয়ে আবর্তিত আমাদের পুরো সমাজ ব্যবস্থা। মন্ত্রী, সাংসদ থেকে শুরু করে সব স্তরের জনপ্রতিনিধি, আমলা, ব্যবসায়ীদের মাঝে কালো টাকার সাদা বেশধারী মানুষের সংখ্যা কম নয়। বিগত ৪৫ বছরে তারা ফুলেফেঁপে আজ বটবৃক্ষে পরিণত হয়েছে। এই বৃক্ষ বলয়ের মধ্য দিয়েই আমাদের দেশে প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে তৈরি হচ্ছে কালো টাকা। সমাজ এমনকি রাষ্ট্রযন্ত্রকে প্রভাবিত করছে এই টাকা।
পত্রিকান্তরে জানা গেছে, মালয়েশিয়ায় মাই সেকেন্ড হোম প্রকল্পের মতো কানাডায়ও বেগমপাড়া নামে নতুন কেন্দ্র গজিয়ে উঠেছে। এ ছাড়া ব্রিটেন, হংকং, সিঙ্গাপুরেও আছে বাংলাদেশের বিনিয়োগ। কালো হোক, ভালো হোক অবৈধ পথে
দেশের টাকা বাইরে যাবে কেন। অর্থনীতির জটিল হিসাব ছাড়াই বলা যায়- যে হারে, যে পরিমাণে টাকা পাচার হচ্ছে, দেশের মাটিতে যদি সেই টাকা বিনিয়োগের সুযোগ থাকত, তাহলে মালয়েশিয়ার মতো উন্নত দেশ হতে আমাদের সময় লাগত মাত্র ১০ বছর।
লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক ও উন্নয়ন গবেবষক
"