ফয়জুন্নেসা মণি

  ২২ জুলাই, ২০১৭

নতুন খাবার

স্পিরুলিনা

স্পিরুলিনাকে প্রোটিনের অন্যতম উৎস হিসেবে বিবেচনা করা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন স্পিরুলিনাকে খাদ্যের বিকল্প হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। সাধারণ খাদ্য হিসেবে তো বটেই নানা রোগ নিরাময়ে মূল্যবান ভেষজ হিসেবে দেশে-বিদেশে স্পিরুলিনার প্রচুর চাহিদা। প্রতি ১০০ গ্রাম স্পিরুলিনায় প্রায় ৩৭৪ কিলোক্যালরি শক্তি রয়েছে। শুষ্ক স্পিরুলিনাতে রয়েছে ৬০-৭০ শতাংশ অত্যন্ত উচ্চশ্রেণির কোলেস্টেরল মুক্ত প্রোটিন, যা মানবদেহের ভারসাম্যতায় অপরিহার্য পুষ্টির উৎস। এ ছাড়াও এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, লৌহ, প্রয়োজনীয় ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেট, বিটা ক্যারোটিন, ক্যালসিয়াম, আয়রন, জিংক, ভিটামিন বি১, বি২, বি৩, বি৬, ভিটামিন কে এবং ভিটামিন ডি।

নাম তার স্পিরুলিনা : স্পিরুলিনা এক প্রকার অতি ক্ষুদ্র নীলাভ সবুজ শৈবাল। এটি সাধারণত পানিতে জন্মে। প্রোটিন, ভিটামিন ও মিনারেলস সমৃদ্ধ প্রকৃতির আশ্চর্য খাবার স্পিরুলিনা। বর্তমানে কৃত্রিম জলাধারে এর বাণিজ্যিক উৎপাদন হচ্ছে। অণুবিক্ষণ যন্ত্র ছাড়া এই শৈবালকে খালি চোখে দেখা যায় না। শুধু সাধারণ খাদ্য হিসেবে নয় রোগ নিরাময়ে মূল্যবান ভেষজ হিসেবে দেশে-বিদেশে স্পিরুলিনার প্রচুর চাহিদা।

স্পিরুলিনা আবিষ্কারের গল্প : একবার ইউরোপের কিছু গবেষক আফ্রিকার এক এলাকায় গিয়েছিলেন গবেষণার জন্য কিছু ডাটা সংগ্রহ করতে। তারা দেখতে পেলেন এলাকার লোকজন বেশ স্বাস্থ্যবান এবং সুস্থ। আশ্চর্যই হলেন, কীভাবে সম্ভব! কারণ সেখানে এমন কোনো পুষ্টিযুক্ত খাবার ছিল না। গবেষকরা তাদের খাবার তালিকা অনুসন্ধানে এমন কিছু খুঁজে পেলেন সবুজ শ্যাওলা বা স্পিরুলিনার তথ্য। এই খাবার মানুষকে সুস্থ ও সবল রাখে। জানা যায়, আফ্রিকার ‘শাদ’ নামক হ্রদ এলাকায় উপজাতীয়দের কাছে এটি অতি পরিচিত। তারা প্রায় ১০০ বছর ধরে স্পিরুলিনা খেয়ে আসছে। তারা এ সবুজ খাদ্যকে ‘দিহে’ বলে থাকে। বিজ্ঞানীরা চার দশকেরও আগে এই আশ্চর্য পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ ও রোগ প্রতিরোধক স্পিরুলিনাকে পরিচিত করেছেন। যার ফলে বিশ্বের প্রায় ৩০টি দেশের মানুষ নিয়মিত এটি খাচ্ছে।

স্পিরুলিনায় যা আছে : স্পিরুলিনাতে আছে উচ্চমাত্রার বিটা ক্যারোটিন এবং আরো ১০টি ক্যারোটেনয়েডের বিপুল ভা-ার, যা বিভিন্ন ধরনের ক্যানসার ও টিউমারের বৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করে। স্পিরুলিনায় ইনস্যুলিন হরমোন নিঃসরণে সাহায্য করার কারণে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে। স্পিরুলিনা অন্ত্রে হজম শক্তি, রোগজীবাণু থেকে রক্ষা ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, এইডস প্রতিরোধে সহায়ক। স্পিরুলিনাতে হৃদরোগ, ব্রেনস্ট্রোকের ঝুঁকি হ্রাস পায় এবং উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে। ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য সম্মেলনে স্পিরুলিনাকে আগামী দিনের সেরা খাদ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তাছাড়া জাতিসংঘ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা শিশুদের জন্য এটিকে নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য বলে সুপারিশ করেছে। জার্মানি ও ভারত থেকে প্রকাশিত জার্নালে দেখানো হয়েছে, সামান্য কয়েক গ্রাম স্পিরুলিনা সেবনে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়, মানুষের হজম শক্তি বাড়ায় এমনকি চোখের রোগের সংক্রমণ হ্রাস পায়।

বাংলাদেশে স্পিরুলিনা : আমাদের জন্য আশার কথা হলো এই স্পিরুলিনা দিন দিন বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হচ্ছে। এছাড়াও বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর) থেকে প্রকাশিত জার্নালে দেখা যায় বাংলাদেশের জলবায়ু স্পিরুলিনা উৎপাদনে জন্য বেশ সহায়ক এবং এদেশের আবহাওয়ায় সারাবছর বিপুল পরিমাণ স্পিরুলিনা চাষ করা সম্ভব। বাংলাদেশে বিসিএসআইআরের ফর্মুলা ও তত্ত্বাবধানে শৈবাল স্পিরুলিনা থেকে বিশেষ উপায়ে ট্যাবলেট তৈরি করা হচ্ছে।

স্পিরুলিনার গুণ ও ব্যবহার : বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের বিশেষজ্ঞদের মতে, স্পিরুলিনার গুণাগুণ অনেক। নিয়মিত সেবনে দৈনন্দিন পুষ্টি চাহিদা পূরণ করে- পুষ্টিহীনতা, রক্তশূন্যতা, রাতকানা, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, আলসার, বাত, হেপাটাইটিস ও ক্লান্তি দূর করে। স্পিরুলিনায় আছে প্রচুর পরিমাণে উদ্ভিজ্জ আমিষ। প্রায় ৬০-৬৩ শতাংশ, যা কি না মাছ বা মাংসের চাইতে ৩-৪ গুণ বেশি। স্পিরুলিনা শরীর থেকে বের করে দেয় দিনের পর দিন জমে ওঠা ক্ষতিকর সব টক্সিন। এটি পরিশ্রম করার ক্ষমতা বাড়ায় এবং নিয়ন্ত্রণে রাখে শরীরের ওজন। বর্তমানে স্পিরুলিনা ট্যাবলেট বা রুটি, আলু ভর্তা, নুডলস, শরবত, হালুয়া ইত্যাদিতে স্পিরুলিনা মিশিয়ে নানা জাতীয় স্পিরুলিনা সমৃদ্ধ খাবার তৈরি করে বাজারজাত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে খাবার তৈরি করার সময় অবশ্যই পরিমাণ অনুযায়ী স্পিরুলিনা মেশাতে হবে। বর্তমানে স্পিরুলিনা যুক্ত পাউরুটি, স্পিরুলিনা পানীয় বাজারে পাওয়া যাচ্ছে।

আর্সেনিক মুক্তিতে স্পিরুলিনা : জরিপ তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৬৪টি জেলার টিউবওয়েলের পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক পাওয়া গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, পাঁচ কোটি লোক আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করায় তাদের স্বাস্থ্য হুমকির সম্মুখীন বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ডাক্তার এবং বিসিএসআইআরের বিজ্ঞানীরা ৬০ জন রোগীর ওপর স্পিরুলিনা নিয়ে গবেষণা চালিয়ে দেখেন, প্রতিদিন ৯-১০ গ্রাম করে স্পিরুলিনা খাওয়ালে ৪-৬ মাস পর রোগীর আর্সেনিকজনিত চর্মরোগ (আর্সেনিকোসিস) সম্পূর্ণরূপে উপশম হয়। যেহেতু এখন পর্যন্ত আর্সেনিকের কোনো ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি সেক্ষেত্রে স্পিরুলিনা সেবন করে আর্সেনিকমুক্ত থাকাটা সত্যিই আমাদের জন্য বিরল সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে।

লেখক : কবি ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist