মাহমুদ আহমদ

  ২১ জুলাই, ২০১৭

ধর্ম

সমাজ গঠনে বিশ্বনবী

হজরত রাসুল করিম (সা.) যে জামানায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সেই জামানার অবস্থা কেমন ছিল, সেই প্রেক্ষাপট সামনে রাখলেই কেবল তার (সা.) জীবনের ঘটনাবলির তাৎপর্য সত্যিকার অর্থে উপলব্ধি করা সম্ভব। চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে আরব ছিল একটি পরস্পরবিরোধী জাতিগোষ্ঠীর অন্যতম। তাদের মধ্যে বহু মারাত্মক পাপের প্রচলন ছিল। মদের প্রতি সাংঘাতিকভাবে আসক্ত ছিল আরবরা। মদের নেশায় বেহুঁশ হওয়া কিংবা মাতলামী করা তাদের কাছে কোনো দোষণীয় ব্যাপারই ছিল না, বরং তা ছিল প্রশংসার। কোনো অভিজাত ব্যক্তির আভিজাত্যের চিত্রসমূহের মধ্যে এই চিত্র থাকারও প্রয়োজন ছিল যে, তিনি তার বন্ধুবান্ধব ও পাড়া-প্রতিবেশীদেরকে জোর করে মদ খাওয়াবেন। ধনী ব্যক্তিদের জন্য জরুরি ছিল দিনে পাঁচবার মদের আসর বসানো এবং এ ধরনের আসর ছিল তাদের জাতীয় ক্রীড়া। জুয়া খেলাকে তারা বদান্যতা ও গৌরবের বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। যুদ্ধের সময় তারা জুয়ার মাধ্যমেই প্রয়োজনীয় টাকা-পয়সা সংগ্রহ করতেন। সেই যুগে নারীদের কোনো অধিকার ছিল না। কোনো কোনো জাতির মধ্যে পিতা কর্তৃক আপন কন্যাকে হত্যা করাটা সম্মানের বিষয় ছিল। সেই যুগে দাস প্রথা একটা সাধারণ ব্যাপার হিসেবেই মান্য হতো। তারা আশপাশের গোত্রের লোকজন ধরে এনে গোলাম বানিয়ে রাখতেন। গোলামদের কোনো হক বা অধিকার ছিল না। প্রত্যেক মালিক তার গোলামের সঙ্গে যেমন খুশি ব্যবহার করতেন। এতে কোনো প্রকার বাধ্যবাধকতা ছিল না। এমনকি হত্যা করলেও কেউ কোনো অভিযোগের সম্মুখীন হতেন না। দাসীদের সঙ্গে যৌনাচার মালিকদের জন্য বৈধ বলে স্বীকার করা হতো। দাসীদের সন্তানরাও গোলামরূপে গণ্য হতো। নিজের ঔরসজাত সন্তানের মা হলেও দাসী দাসীই থাকতেন।

উল্লিখিত প্রেক্ষাপটে জন্মগ্রহণ করেন মানবতার আদর্শ হজরত মুহাম্মদ (সা.)। বাল্যকাল থেকেই তার প্রকৃতিতে মানবের কল্যাণ করার বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। মানুষের লড়াই-ঝগড়ার মধ্যে তিনি কখনো নিজেকে জড়াতেন না। বরং লড়াই ও কলহ মিটিয়ে ফেলার চেষ্টাই করতেন।

খাতামান্নাবিইন হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর শিক্ষা দেখুন, একবার এক জিহাদের ময়দানে উসামা বিন যায়েদ (রা.)-এর সঙ্গে এক ব্যক্তির লড়াই হচ্ছিল। উসামা বিন যায়েদ লোকটিকে যুদ্ধে পরাস্ত করেন এবং হত্যা করতে উদ্যত হন। এমন সময় অবিশ্বাসী লোকটি সম্পূর্ণ কালেমা নয়, বরং এর প্রথমাংশ পাঠ করে ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দেন। তথাপি উসামা তাকে হত্যা করেন। ঘটনাটি হজরত রাসুল করিম (সা.)-এর কাছে রিপোর্ট করা হলে তিনি (সা.) উসামাকে ডেকে জিজ্ঞেস করেন, সে ইসলাম গ্রহণ করার পরেও তুমি তাকে কেন হত্যা করলে? উত্তরে উসামা বলেছিলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! সে তো প্রাণের ভয়ে ইসলাম কবুল করেছিল? হজরত রাসুল করিম (সা.) তখন বলেছিলেন, তুমি কি তার হৃদয় ফেড়ে দেখেছিলে যে, সে সত্যি সত্যিই ইসলাম গ্রহণ করেছিল, না প্রাণের ভয়ে এ কথা উচ্চারণ করেছিল? রাসল পাক (সা.) অতঃপর বলতে লাগলেন, কাল হাশরের ময়দানে আল্লাহ্র সামনে তুমি কী করে তোমার কাজকে সঠিক সাব্যস্ত করবে? হজরত রাসুল করিম (সা.) বলেন, যখন কালেমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ তোমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে, তখন তুমি কী করবে? রাসুল করিম (সা.)-এর এরূপ ভয়ানক অসন্তুষ্টি দেখে উসামা ভীষণ ঘাবড়ে যান আর হজরত রাসুল পাক (সা.) তখনো ওই কথাই বারবার বলছিলেন যে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ যখন তোমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে, তখন তুমি কী করবে? উসামা পরে বলেছিলেন, ‘হায়! আমি যদি এই ঘটনার পরে ইসলাম গ্রহণ করতাম’। এই ঘটনা এবং আরো নানা ঘটনা থেকে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, বলপূর্বক মুসলমান বানানো ইসলামী ‘জিহাদে’র উদ্দেশ্য কখনই ছিল না এবং সে যুগে বলপূর্বক কাউকে মুসলমান করাও হয়নি, কোনো যুদ্ধবন্দিকেও না। ইসলাম কখনো তরবারির দ্বারা প্রসার লাভ করেনি, ইসলাম প্রসার লাভ করেছে হজরত রাসুল করিম (সা.)-এর উন্নত আদর্শ, মানব প্রেম, তবলিগ ও ক্ষমার দৃষ্টান্তের মাধ্যমে।

হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, মহানবী (সা.) কখনো বিধবা ও অভাবী লোকদের সাহচর্যকে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখতেন না আর তাদেরকে এড়িয়েও চলতেন না। বরং তিনি তাদের অভাব মোচন করে দিতেন (মসনাদ দারেমি)। হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘হজরত রাসুল করিম (সা.) কখনো কাউকেও প্রহার করেননি-না কোনো মহিলাকে, না কোনো খাদেমকে, যদিও তিনি আল্লাহ্র রাস্তায় জিহাদ করেছেন। যদি তিনি কখনো কারো দ্বারা কষ্ট পেতেন তবুও তিনি তার প্রতিশোধ নিতেন না। কিন্তু যখন আল্লাহর বর্ণিত পবিত্র স্থানসমূহকে অপবিত্র করা হতো, তখন তিনি আল্লাহতায়ালার জন্য এর প্রতিশোধ নিতেন’ (মুসলিম)। হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বর্ণনা করেন, ‘রাসুল করিম (সা.) গোলামদের সঙ্গে আহার করতেন এবং গম ভাঙানোর সময় গোলামরা ক্লান্ত হয়ে পড়লে তিনি তাদের সাহায্য করতেন। বাজার হতে জিনিসপত্র ঘরে বহন করে নিয়ে যাওয়াকে তিনি হেয় মনে করতেন না। ধনী দরিদ্রের সঙ্গে একইভাবে মুসাফাহা (করমর্দন) করতেন। সর্বপ্রথম সালাম করতেন। তিনি কোনো নিমন্ত্রণকে অবজ্ঞা করতেন না, যদিওবা সেই নিমন্ত্রণ শুধু খেজুরের হতো। তিনি দুঃখীদের দান করতেন। তিনি কোমল হৃদয়ের অধিকারী ও দয়ালু ছিলেন। তার আচার-ব্যবহার উত্তম ছিল।’ (মিশকাত)।

আল্লাহতায়ালা মহানবী (সা.)-এর মাধ্যমে ন্যায়ের তুলাদ- তুলে ধরেন এবং ইনসাফ ও রহমতের শাসন কায়েম করেন। যার ফলে তিনি (সা.) ঘোষণা করলেন, কারো ওপরে আর জুলুম হবে না। ধর্মের ব্যাপারে কারো হস্তক্ষেপ থাকবে না, জবরদস্তি থাকবে না। নারী ও ক্রীতদাসের প্রতি যে জুলুম করা হচ্ছে, তা শেষ করা হবে এবং শয়তানের হুকুমতের স্থলে এক আল্লাহর হুকুমত প্রতিষ্ঠিত হবে। ঠিক এমনই হলো, জুলুম-অত্যাচারের রাজত্বের পর দলে দলে লোকেরা রাসুল করিম (সা.) এর আদর্শ দেখে ইসলাম গ্রহণ করতে লাগলেন। মুসলমানদের একের পর এক বিজয় হতে লাগল। মদিনার পৌত্তলিকরাও ইসলাম গ্রহণ করতে লাগলেন। ধীরে ধীরে মুসলমানদের অন্ধকার রজনি কেটে গেল, উদিত হলো নতুন সূর্যের, মক্কা মুসলমানদের অধীনে চলে এলো। অল্প দিনের মধ্যেই সারা আরবে ইসলামী পতাকা পত

পত করে উড়তে থাকল। এত অল্প সময়ে ইসলামের বিজয়ের পেছনে কোন শক্তি কাজ করেছিল? এর পেছনে হজরত রাসুল করিম (সা.)-এর মানব প্রেম ও দোয়ার বরকতেই ইসলামের বিজয় ও অন্ধকার যুগকে আলোকিত করেছিল। তাই আমরাও যদি মানবপ্রেমী হই, তাহলেই সমাজ থেকে সব অশান্তি দূর করা সম্ভব হবে। তাই আসুন না, অন্যের ক্ষতি করার চিন্তা বাদ দিয়ে মহানবীর আদর্শ অনুসরণ করে শান্তিময় সমাজ গড়ে তোলার কাজে এগিয়ে যাই।

লেখক : ইসলামী গবেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist