এস এম মুকুল
দর্শন
তোমাদের মাদিবা আমাদের ম্যান্ডেলা
মাদিবাখ্যাত নেলসন ম্যান্ডেলা একটি নাম, একজন নেতা, একজন অসাধারণ মানুষ। বিশ্ব রাজনীতির নেতৃত্বে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী। কালো মানুষের নেতা, বঞ্চিত-শোষিত মানুষের নেতা, বিশ্বনেতাসহ অনেক অভিধায় অভিহিত করা যায় তাকে। কিন্তু তার প্রয়োজন পড়ে না, কারণ তিনি নিজেই এখন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম বিশেষণের একটি। সাত শ কোটি মানুষের মধ্যে তিনি একজনই ম্যান্ডেলা। বৈচিত্র্য, বৈপরীত্যের মাঝে ঐক্য স্থাপনে অসাধারণ নেতৃত্বের অনুপম উদাহরণ সৃষ্টি করে পৃথিবীর রাজনীতিকদের দেখিয়ে দিয়েছেন তিনি। রাষ্ট্রক্ষমতার মোহ, জনপ্রিয়তার দাপট এবং দলের নেতৃত্ব থেকে কিভাবে দূরে সরে যেতে হয় বিশ্ব রাজনীতিবিদদের সে শিক্ষার পথও দেখিয়েছেন তিনি। ধৈর্য ধারণের ক্ষেত্রে তিনি অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। নেতা নন মানুষ, মানুষ নন সেবক-তার এই জীবন দর্শন আজ বিশ্বে অনুসরণীয়। তিনিই পেরেছেন ১৯৯৯ সালে ক্ষমতায় পুনঃপ্রতিষ্ঠার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সরে দাঁড়াতে। ক্ষমতার বলয়ে না থেকে তিনি ঘুরে বেড়ালেন, বিশ্ব নেতাদের সঙ্গে বিনিময় করলেন তার রাজনৈতিক দর্শন আর আদর্শের মূলমন্ত্র। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৮ জুলাইকে ‘ম্যান্ডেলা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। বিশ্বব্যাপী স্বাধীনতার ক্ষেত্রে দক্ষিণ আফ্রিকার মহান নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৮ জুলাই ম্যান্ডেলার জন্মদিন বলে তার স্মরণে এ দিনটি বেছে নেওয়া হয়েছে।
নেলসন ম্যান্ডেলার জন্ম ১৯১৮ সালে। তার বাবা ছিলেন ইস্টার্ন কেপ প্রদেশের থেম্বো রাজকীয় পরিবারের কাউন্সিলর। বাবা নাম রেখেছিলেন রোলিহ্লাহ্লা ডালিভুঙ্গা মানডেলা। স্কুলের এক শিক্ষক তার ইংরেজি নাম রাখলেন নেলসন। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার আপামর মানুষের কাছে তিনি ছিলেন ‘মাদিবা’। তরুণ বয়সে নেলসন ম্যান্ডেলা চলে আসেন জোহানেসবার্গে, সেখানে তিনি আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের যুব শাখার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়েন দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে।
ম্যান্ডেলা নিজের আদর্শের প্রতি ছিলেন অবিচল আস্থাবান। দূরদর্শিতা, আত্মসংযম, একনিষ্ঠতা আর সংগ্রামের ধারাবাহিকতার মাধ্যমে তিনি নিজের জায়গা ঠিক করতেন। এ কারণে ম্যান্ডেলার নেওয়া জাতিগত সম্প্রীতির আদর্শ এখন অনেকের কাছেই অনুরণীয় হয়ে থাকবেন। সদা বিনয়ী ম্যান্ডেলা কখনই প্রশংসার ¯্রােতে গা ভাসাতেন না। নৈতিক আদর্শের প্রতি তার অটল অবস্থানকে আফ্রিকার সুউচ্চ পর্বত থাবানার চেয়ে দৃঢ়ত্ব হিসেবে তুলনা করেছেন কেউ কেউ। আবার রাজনৈতিক সংগ্রামে কৌশল গ্রহণের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন কোমলে আর কঠিনে মেশানো অসাধারণ নেতা। তার অদম্যতা তাকে ঐতিহাসিক রিভোনিয়া ট্রায়াল ও রোবেন দ্বীপে ২৭ বছর কারা নির্যাতনের পরও নীতি থেকে টলাতে পারেনি। তাই ক্ষমতাধর আফ্রিকান সাদারা কালো ম্যান্ডেলার অদম্য-অহিংসতার কাছে আত্মসমর্থন করতে বাধ্য হয়েছিল। ১৯৬৪ সালে
পাতানো বিচার চলার সময় ম্যান্ডেলার সেই উক্তিটা রীতিমতো বাণী হয়ে থাকবে-‘আমি শ্বেতাঙ্গদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে যেভাবে লড়েছি, কালোদের আধিপত্যের বিরুদ্ধেও একইভাবে লড়েছি।’
ম্যান্ডেলা খাপছাড়া চিন্তা করতেন না। সফল হোক বা না হোক, পরিকল্পনাগুলো লিখে রাখতেন। তার রাজনৈতিক কর্মকা- ছিল সুসংগঠিত। দক্ষিণ আফ্রিকায় শাসক গোষ্ঠীর চলমান অত্যাচার নির্যাতনের বিপক্ষে প্রতিবাদের মাধ্যমে আলোচনায় আসেন মাদিবা খ্যাত ম্যান্ডেলা। কালো মানুষদের সমঅধিকারের পক্ষে, বর্ণবাদের বিপক্ষে ক্রমাগত আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিবাদী কণ্ঠের প্রতীকী নাম পুরুষ হয়ে ওঠেন তিনি। পরিণতি হিসেবে ২৭ বছর কারাগারে বন্দি থেকে দুর্বিষহ জীবন কাটাতে হয়। ১৯৬২ সালে পাঁচ বছর ও ১৯৬৪ সলে যাবজ্জীবন দেওয়া হয় তাকে। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো জেলে গিয়েও স্বপ্নহারা হননি ম্যান্ডেলা। ১৯৯০ সালে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ক্ষমতায় গিয়ে বিরোধীদের ওপর সামান্যতমও প্রতিশোধ নিলেন না।
ম্যান্ডেলাকে বলা হয় মাস্টার কমিউনিকেটর। দেহের ভাষা থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানেও সিদ্ধহস্ত ম্যান্ডেলা কারাবন্দি থেকেও অনুসারীদের সঙ্গে আদর্শগত যোগাযোগ ঠিকই বজায় রেখেছেন। তিনি এমনি একজন নেতা, যিনি ১৯৬৪ সালে যাবজ্জীবন কারাদ- হওয়ার পর সারাবিশ্বে বর্ণবাদবিরোধী লড়াইয়ের প্রতীক হয়ে ওঠেন। ২৭ বছর কারাগারে অন্তরীণ থেকেও বর্ণবাদ আন্দোলনের প্রাণ হারাতে দেননি। অসীম ধৈর্য আর অপেক্ষায় মুক্তির রূপরেখা এঁকেছেন জেলখানায় বসে। স্বাধীনতার স্বাদ পেয়ে, ক্ষমতার অধরা শক্তি হাতের মুঠোয় পেয়েও এককালের নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে গেলেন না। প্রতিশোধ নিলেন না। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করলেন। রাষ্ট্র পরিচালনা করলেন দক্ষতার সঙ্গে। দেশটির অর্থনৈতিক আদল পরিবর্তনে বিশেষ ভূমিকা রাখলেন। ম্যান্ডেলা শিখিয়েছেন, দেশকে বিভক্ত রাখা নয়, তাকে ঐক্যবদ্ধ করাই সফল রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রমাণ। তারপর ১৯৯৯ সালে ক্ষমতায় পুনঃপ্রতিষ্ঠার
সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সরে দাঁড়ালেন। ঘুরে বেড়ালেন, বিশ্ব নেতাদের সঙ্গে, বিনিময় করলেন তার রাজনৈতিক দর্শন আর আদর্শের মূলমন্ত্র। এরপর ২০০৪ সালে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যাওয়ার ঘোষণা দিলেন। আর দুনিয়ার মানুষদের উদ্দেশে বললেন- ‘তোমরা আমাকে খোঁজ কর না, আমিই তোমাদের খুঁজে নেব।’
ম্যান্ডেলা কখনো নিজেকে আন্দোলনের প্রধান নেতা হিসেবে বিবেচনা করেননি। নেতৃত্বের কথা এলেই তিনি ‘আমি’ না বলে ‘আমরা’ শব্দটি ব্যবহার করতেন। তার আত্মজৈবনিক গ্রন্থ লং ওয়াক টু ফ্রিডমে ম্যান্ডেলা লিখেছেন, একজন নেতা হলেন মেষপালকের মতো। মেষের দল থাকবে সম্মুখে। যারা সবচেয়ে চতুর ও দ্রুত পথচলায় সক্ষম, মেষপালক তাদের সামনে এগোনোর পথ করে দেবে। অন্যরা তাকেই অনুসরণ করে চলবে, অথচ জানতেও পারবে না পেছন থেকে কে তাদের পরিচালিত করছে। তার বন্দিজীবনের রোবেন দ্বীপের কারাগারকে তিনি আখ্যা দিয়েছিলেন রোবেন ইউনিভার্সিটি হিসেবে। ম্যান্ডেলা তার জীবনীতে লিখেছেন, কারাগারে ম্যান্ডেলা ও তার সহবন্দিরা একটি চুনাপাথরের খনিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। কারাগারেও বর্ণভেদ প্রথা চালু ছিল। কৃষ্ণাঙ্গ বন্দিদের সবচেয়ে কম খাবার দেওয়া হতো। সাধারণ অপরাধীদের থেকে রাজনৈতিক বন্দিদের আলাদা রাখা হতো। রাজনৈতিক বন্দিরা সাধারণ অপরাধীদের চাইতেও কম সুযোগ-সুবিধা পেত। তাকে সবচেয়ে কম সুবিধাপ্রাপ্ত বন্দিদের তালিকায় রাখা হতো। ম্যান্ডেলা সত্তরের দশকে তার জীবনে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনাপঞ্জি নিয়ে স্মৃতিকথা লিখে প্লাস্টিক কন্টেইনারে ভরে জেলখানার বাগানে পুঁতে রাখেন পরবর্তীতে এ বিষয়টি কারা কর্তৃপক্ষের গোচরে এলে শাস্তিস্বরূপ তার কারা লাইব্রেরিতে পড়াশোনার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। তারপরও তিনি উদার ও আদর্শিক মানসিকতায় সারাবিশ্বের রাজনীতিকদের জন্য একটা উদাহরণ তৈরি করে গেছেন। ক্ষমতায় আসার পর নিজের দলবল নিয়ে পড়ে থাকেননি। সব
ধরনের মন-মানসিকতার লোকদের জড়ো করে তৈরি করতেন আলাপ ও তর্কের পরিবেশ। রাজনৈতিক দূরদর্শী এই মহান নেতা আদর্শ রাজনীতির পথ দেখিয়েছেন এই বলে যে, ‘তোমার প্রতিপক্ষের সঙ্গে যদি শান্তি চাও, তাহলে তার সঙ্গে একযোগে কাজ কর। দেখবে, সে শত্রু নয়, তোমার সহযোগীতে পরিণত হয়েছে।’
২০১২ সালের ডিসেম্বরে ৯৫ বছর বয়সে এই বিশ্বনেতা পিত্তথলির সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। আবার ২০১৩ সালের মার্চে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসাপাতালে যেতে হয়। জুন মাসের ৮ তারিখে ফুসফুসের সংক্রমণে আবারও হাসপাতালে ভর্তি হন। তখন থেকেই সারাবিশ্বের নজর তার পরিণতির দিকে। নির্যাতন, আন্দোলন, কারারুদ্ধতা, মুক্তি, ক্ষমতায়ন, সম্প্রীতির দেশ গঠন, ক্ষমতার মোহ ত্যাগ, জনগণের আড়ালে যাওয়ার মাঝ দিয়ে বিশ্ব রাজনীতির প্রবাদ পুরুষ
হয়ে ওঠা মানুষটি দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে পরলোকে
চলে যান ২০১৩ সালের ৫ ডিসেম্বর। ১০ ডিসেম্বর বিশ্বনেতারা তাকে সম্মান জানাতে একত্র হন এবং ১৫ ডিসেম্বর জন্মস্থান কুনু গ্রামে সমাহিত হন। নেলসন ম্যান্ডেলা, সবার প্রিয় মাদিবা চলে গেলেন। বিশ্বের মানুষদের জন্য রেখে গেলেন তার সারা জীবনের কীর্তি।
লেখক : বিশ্লেষক ও উন্নয়ন গবেষক
"