রায়হান আহমেদ তপাদার

  ১৭ জুলাই, ২০১৭

পর্যালোচনা

প্যারিস চুক্তি বনাম মার্কিন প্রেসিডেন্ট

বিশ্বব্যাপী জলবায়ুকে সব প্রাণীর বিকাশের অনুকূলে রাখার লক্ষ্যে ২০১৫ সালে প্যারিসে ১৯৫টি দেশ যে মতৈক্যে পৌঁছেছিল সে সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কী সিদ্ধান্ত নেবেন তা সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছিল। সবার আশা ছিল প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পৃথিবীব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের উন্নয়ন ও কল্যাণমুখী ভূমিকার পটে প্যারিস মতৈক্যের প্রতিকূলে কোনো সিদ্ধান্ত দেবেন না। সেই সন্ধ্যা যখন রাত্রির গভীরতায় হারিয়ে যাচ্ছিল তখন টিভিতে চিত্রায়িত হলো ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্র প্যারিস মতৈক্য থেকে বের হয়ে যাবে। যুক্তরাষ্ট্র ট্রাম্পের ঘোষণা অনুযায়ী এই মতৈক্যে স্থাপিত দায়িত্ব ও কর্তব্যাদির বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষার্থে নতুনভাবে আলোচনায় প্রবৃত্ত হবে। এই কাঠামোর ওপর ১৯৯৭ সালে জাপানের কিউটো নগরে ১৯২টি দেশ পৃথিবীব্যাপী জলবায়ুর বিরূপ পরিবর্তন মোকাবিলা করার লক্ষ্যে গৃহীতব্য কার্যক্রম বিষয়ে একটি (কিউটো) প্রটোকলের মোড়কে একমত হয়েছিল। ২০০৫ সালে কিউটো প্রটোকলে নির্ধারিত কার্যক্রমে স্বাক্ষরকারী দেশসমূহ কর্তৃক তা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া বলবৎকৃত হয়। কিউটো প্রটোকলকে ভিত্তি করে ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর প্যারিসে জলবায়ুবিষয়ক মতৈক্য বা চুক্তিতে ১৯৫টি দেশ উপনীত হয়। প্যারিস মতৈক্য অনুযায়ী সব সদস্য দেশ মূলত- এক. যথাসম্ভব সবুজ জ্বালানির উৎস উদ্ভাবন ও গ্রহণ, দুই. জলবায়ুর পরিবর্তনকারক কার্বন-ডাই অক্সাইডের বায়ুম-লে নির্গমন কমানো, তিন. পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়া সীমিতকরণ এবং চার. অনিবার্য জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলার জন্য উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশসমূহের সহযোগিতা প্রসারণ বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছে। ২০১৬ সালের ৪ নবেম্বর ৫৫টি দেশ যারা সাম্প্রতিককালে পৃথিবীর বায়ু ম-লে শতকরা ৫৫ ভাগ কার্বন-ডাই-অক্সাইড উৎসারণ করে এসেছে, তারা প্যারিস মতৈক্যকে অনুসমর্থনের ভিত্তিতে চুক্তিতে উন্নীত করে।

এই চুক্তির প্রেক্ষিত ও লক্ষ্য হিসেবে বলা হয়, ২০২০ সালের মধ্যে বায়ুম-ল উৎসারিত কার্বন-ডাই অক্সাইড চূড়ান্ত বা শেষ সহনীয় সীমায় নিয়ে আসা সম্ভব হবে এবং এর সঙ্গে ও পরে প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট দেশসমূহ যথাযথ পদক্ষেপ নিয়ে ২০৫০ সালের মধ্যে এই নিঃসরণের মাত্রা ১৯৯০ সালের মাত্রা থেকে ন্যূনতম শতকরা ৫০ ভাগ নামিয়ে নিয়ে আসবে। এবং শতাব্দীর শেষে তা শূন্যের কোঠায় কিংবা তার চাইতে নিচে নামিয়ে আনার জন্য সব দেশ তাদের প্রচেষ্টা প্রযুক্ত করবে। নিঃসরণ কমিয়ে আনার জন্য সংশ্লিষ্ট দেশসমূহ কার্বন নিঃসরণধর্মী সকল কর্মকা- ও উৎপাদনের ওপর করারোপ করবে এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির

উৎপাদন ও ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব, কর রেয়াত ও

সহায়তা দেবে। অন্যদিকে ৩০ মে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঘোষণা করেন যুক্তরাষ্ট্র প্যারিস চুক্তিতে অনুসমর্থন

দেবে না। এবং তার ভাষায় সেই অসম চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র বেরিয়ে আসবে। সেখানে উপস্থিত বাংলাদেশ ও

কানাডার সাংসদরা উৎকণ্ঠার সঙ্গে শুনলেন ট্রাম্প বলেছেন, তাকে প্যারিসের নয় পিটাসবার্গের জনগণ ভোট দিয়ে

প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেছেন। পিটাসবার্গ হলো যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান কয়লা আহরণ ও ব্যবহারের তথা কার্বন নিঃসরণের উৎস। এই পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাম্প আগে থেকেই বলে এসেছিলেন যে প্যারিস চুক্তিতে উপনীত হওয়ার প্রক্রিয়ায় যথার্থভাবে সংশ্লিষ্ট বৈজ্ঞানিক তথ্য ও উপাত্ত বিচার বিবেচনা করা হয়নি এবং ওই চুক্তিতে উল্লিখিত যুক্তরাষ্ট্রের কর্তব্য বা দায় বিষয়ে অসম চাপ দেওয়া হয়েছে। এর আগে ২০১২ সালে ট্রাম্প বলেছিলেন, পৃথিবীর উষ্ণায়নবিষয়ক উৎকণ্ঠা চীন যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদনকে চীনের সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতায় নামিয়ে আনার উদ্দেশ্যে প্রচার করেছিল। অপরদিকে নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিটজ ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রকে দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার পথে একটি বড় পদক্ষেপ বলে নিন্দা করেছেন। তেমনি আয়ারল্যান্ডের সাবেক প্রেসিডেন্ট মেরি রবিনসন বলেছেন, ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রকে একটি দুর্বৃত্ত রাষ্ট্রে পরিণত করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট পরিবেশবাদী আল গোর প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে আসাকে দায়িত্বহীন ও অসমর্থনীয় পদক্ষেপ বলে অভিহিত করেছেন। বেলজিয়ামের প্রধানমন্ত্রী চার্লস মিচেল এ ক্ষেত্রে ট্রাম্পের সিদ্ধান্তকে একটি নির্দয় পদক্ষেপ বলে অভিহিত করেছেন। জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতেরেস ট্রাম্পের সিদ্ধান্তকে একটি বড় আশা ভঙ্গের কারণ বলে অভিহিত করেছেন। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত তাকে আশাহত করেছে বলে জানিয়েছেন। জার্মানির চ্যন্সেলর অ্যাঞ্জেলা মারকেল, যিনি কিউটো প্রটোকল স্থিরিকরণে সফল ভূমিকা পালন করেছিলেন, ট্রাম্পের প্যারিস চুক্তি থেকে সরে যাওয়ায় হতাশা ব্যক্ত করেছেন। প্যারিস মতৈক্য বা চুক্তি পৃথিবীর মাত্র দুটি দেশ সিরিয়া ও নিকারাগুয়া সমর্থন বা সই করেনি। সেই প্রেক্ষিতে জাতিসংঘে কর্মরত বেশ কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূতরা যুক্তরাষ্ট্র উপরোক্ত পদক্ষেপ নিয়ে নিজকে সিরিয়া ও নিকারাগুয়ার মতো দুর্বল এবং পথভ্রান্ত দেশের পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে বলে মন্তব্য করেছেন। (নিউইয়র্ক টাইমস, জুন ২,২০১৭)। গত ৭ জুলাই জার্মানির হামবুর্গে জি-২০ এর শীর্ষ সম্মেলনের আগে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাকরন ও পরিবেশমন্ত্রী নিকোলাস হোলট ট্রাম্পের প্রত্যাহারমূলক সিদ্ধান্তের বিপরীতে প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী তারা জলবায়ু দূষণ রোধ করার জন্য দৃঢ় ও ব্যাপক পদক্ষেপ নেবেন বলে ঘোষণা করেছেন। একই দিনে বিশ্ব জলবায়ু দূষণ সীমিতকরণের ক্ষেত্রে প্রতিবাদ জানিয়ে বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তিসম্পন্ন দেশসমূহের নেতৃত্বের কাছে জলবায়ু দূষণ প্রতিরোধের দাবি জানিয়েছেন হাজার হাজার জনগণ। অপরদিকে জি-২০ ভুক্ত দেশের মধ্যে ১৯টি যুক্তরাষ্ট্রের এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার বিরোধিতা করেছে। এরূপ বিরোধিতা বা মতের অনৈক্য অর্থনৈতিক

উন্নয়ন ও বাণিজ্য প্রসারণে ওই জোটের প্রভাব ও কার্যক্রম ক্ষুণœ করবে। চীন, ইউরোপ, ভারত ও অন্যান্য দেশে

যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক উদ্ভাবিত জলবায়ুর বিরূপতা নিবারণমূলক প্রযুক্তি রফতানি ব্যাহত হবে।

অন্যদিকে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে ২৫টি সংরক্ষিত এলাকায় গণঅংশগ্রহণভিত্তিক কার্যক্রম বাস্তবায়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। যথাযথ পরিবেশ রক্ষণের জন্য বাংলাদেশ সরকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশক্রমে জলবায়ু দূষণ প্রতিরোধে বিশেষ তহবিল সৃষ্টি করেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নীতি হিসেবে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দারিদ্র্যকে পরিবেশ দূষণের মূল কারণ হিসেবে বিবেচনা করে সব দিক থেকে বাসযোগ্য দেশ অর্জনের জন্য দারিদ্র্যবিমোচনের ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। তা ছাড়া প্যারিস চুক্তি থেকে ট্রাম্পের প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিকূলে কতিপয় প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেবে-যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক প্যারিস চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসা চুক্তিটির সমাপ্তি ঘটাবে না, দুর্বল করবে; কিন্তু এর ফলে পৃথিবীব্যাপী জলবায়ুর বিরূপতা প্রতিরোধ করার কার্যক্রম ব্যাহত হবে এবং ফলত বিশ্বের উন্নয়ন ও কল্যাণ সাধনে যুক্তরাষ্ট্রের যে ভূমিকা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ক্রমান্বয়ে উজ্জ্বলতর হয়ে এসেছিল তা নিষ্প্রভ ও সমর্থনহীন হয়ে যাবে। সম্মেলনের শেষ দিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া বাকি ১৯টি অংশগ্রহণকারী দেশ প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের অনুকূলে সমর্থন ব্যক্ত করেছে। আর ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাকরন প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়ন সুসংহত করার জন্য ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে পরবর্তী জলবায়ু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে বলে ঘোষণা করেছেন। ট্রাম্পের প্যারিস চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আলোচনাধীন সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীরা সমর্থন করেননি। ডুপন্ট, হেউলেট পেকার, প্যাসিফিক গ্যাস অ্যান্ড ইলেকট্রিক, টেসলা ও একসনের মতো সামনের সারির বাণিজ্যিক ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানসমূহ প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাহারের প্রতিবাদ করেছেন। আপেলের মুখ্য নির্বাহী টিম কুক প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে আসা সমর্থন করেননি। টেসলার মুখ্য নির্বাহী এলন মাস্ক এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ট্রাম্পের উপদেষ্টা পরিষদ থেকে পদত্যাগও করেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কতিপয় অঙ্গরাজ্য ক্যালিফোর্নিয়া, নিউইয়র্ক, ম্যাসাচুসেটস ট্রাম্পের প্যারিস চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসা সত্ত্বেও তাদের নিজ নিজ রাজ্যে প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী তাদের করণীয় কাজগুলো করে যাবে বলে ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে। এই দশকে পৃথিবীব্যাপী জলবায়ু দূষণ প্রতিরোধ করতে সোচ্চারিত দাবির অনুগামী প্রযুক্তি উদ্ভাবন, উদ্ভাবিত প্রযুক্তির সংশোধন এবং বায়ু দূষণধর্মী বিনিয়োগ পরিহার, তরল পদার্থদির খ-ায়ন, খনিজ আহরণ, এমনকি খামার ব্যবস্থাপনা ও পশু পালনের ক্ষেত্রে কার্বন নিঃসরণ সীমিতকরণের পদক্ষেপ ব্যক্তি উদ্যোগের আওতায় ব্যাপকভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নেওয়া হয়েছে এবং হবে বলে জানা গেছে। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জরিপে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৭০ শতাংশ জনগণ প্যারিস চুক্তির অনুকূলে সমর্থন জানিয়েছেন। প্যারিস চুক্তির বিধান অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় চার বছর লাগবে চুক্তিটি থেকে বেরিয়ে আসতে। বলা হয়েছে, চার বছর পর যদি ট্রাম্প পুনর্নির্বাচিত না হন তাহলে নতুন প্রেসিডেন্ট চুক্তিটিতে ফিরে যেতে পারবেন। সমকালীন পরিপ্রেক্ষিতে ধারণা করা যেতে পারে যে, প্যারিস চুক্তি সম্পর্কিত ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র ব্যক্তি-উদ্যোগ এবং অঙ্গরাজ্যসমূহের সমর্থনীয় কর্মকা-ের ভিত্তিতে জলবায়ু ও পরিবেশ দূষণকল্পে কার্যক্ষম পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হবে।

লেখক : গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist