মো. কায়ছার আলী

  ২৫ জুন, ২০১৭

স্মরণ

তেভাগা ও একজন প্রবাদ পুরুষ

শেরেবাংলা, বঙ্গবন্ধু, দেশবন্ধু, নেতাজি, ভাসানী, বিশ্বকবি, জাতীয় কবি, পল্লীকবি, নোবেল জয়ী, শিল্পাচার্য, জ্ঞানতাপস, মাস্টারদা-এসব কারো নাম নয় উপাধি। ব্যক্তির চেয়ে কীর্তি যখন বড় হয়, তখন নামের চেয়ে উপাধিটাই বড় হয়ে যায়। নামে নয়, খেতাবেই তিনি সার্বজনীন হয়ে যান। একজন মানুষের নাম যা-ই থাকুক তিনি যে পদ-পদবিরই অধিকারী হন সেটা ছাপিয়ে যখন তার বীরত্ব, কৃতিত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব পদের গ-ি ছাড়িয়ে যায়, তখনই ওই জনপদের মানুষ খুশি হয়ে তাকে একটা বিশেষ বিশেষণে বা বিশেষ উপাধিতে ভূষিত করে। তিনি ওই বিশেষণে বা বিশেষ পদবিতেই পরিচিত হয়ে যান।

মানুষ সর্বজ্ঞ বা সর্বনিয়ন্তা নয়। একজন ব্যক্তি একাধারে অসংখ্য গুণের অধিকারী হতে পারে না। বরং এক-দুটি বিষয়ে পারদর্শী বা যশস্বী হতে পারে মাত্র। অর্জন না হলে দান হয় না, শ্রেষ্ঠ হয়ে উঠতে না পারলে শ্রেষ্ঠত্বের প্রকাশ সম্ভব নয়। মানুষকে জ্ঞানে-শক্তিতে, অর্থবিত্তে ও সৃজনশীলতায় বড় হতে হয়। সব মানুষের মাঝে সৈনিকের শক্তি নাও থাকতে পারে। আগে জ্ঞানী হয়ে তারপর জ্ঞান দান। বিওশালী হয়েই তো বিত্ত বিলানো যায়। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো মানুষের প্রয়োজনের সময় (দুঃখ ও দুর্ভিক্ষ) যদি বড় মানুষরা মানব কল্যাণে কাজ না করেন, তবে বিখ্যাত হওয়ার সুযোগ তাদের নাও আসতে পারে। অতি সংক্ষিপ্ত মানব জীবনে দ্বিতীয়বার সুযোগের অপেক্ষায় থাকাটা বোকামি।

কোনো কোনো বড় মানুষ পরিস্থিতির চাপে পড়ে ছোটখাটো ভুল করে সমালোচিত হন। এর অর্থ এই নয় যে, তিনি ছোট হয়ে গেছেন। বিভিন্ন ব্যক্তির মতাদর্শ বিভিন্ন হতে পারে। থিসিস থাকলে এন্টি থিসিস থাকবে, মত থাকলে মতান্তর বা ভিন্নমত থাকবে। এজন্য অন্যের নিন্দা করা বা তাকে ক্ষুদ্র ভাবা ঠিক নয়। যিনি বড়, তিনি তার মহত্ত্ব, বড় কর্ম, বড় আত্মত্যাগের জন্য বড়। বড়কে বড় বলেই মেনে নিতে হয়। কালজয়ী, কীর্তিমানরা মেধা, যোগ্যতা ও কীর্তি দিয়ে ইতিহাস গড়েছেন। তারা নিজ দেশের সীমানা ছাড়িয়ে নিজেকে নিয়ে গেছেন সারা বিশ্বে।

তেভাগা আন্দোলনের প্রাণপুরুষ, বাংলার কমিউনিস্ট অঙ্গ-সংগঠন কৃষক সমিতির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, আলোচিত রাজনীতিবিদ, ত্যাগী পুরুষ হাজী মোহাম্মদ দানেশ (তথ্য সূত্র-পত্রপত্রিকা, ইন্টারনেট এবং কালাম ফয়েজি রচিত শ্রেষ্ঠ বাঙালি গ্রন্থ)। উত্তরবঙ্গই ছিল তেভাগা (তিন ভাগ জমির মালিক, কৃষক বা শ্রমিক এবং উৎপাদন খরচ) আন্দোলনের সূতিকাগার। উত্তরবঙ্গে এই আন্দোলনের উদ্ভব হওয়ার কারণ ছিল উত্তরবঙ্গ বরাবর জোতদার প্রধান তথা জোতদার শাসিত এলাকা। যারা এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং শত সহস্র বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে আন্দোলনকে সার্থকতার উদ্দিষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে নেওয়ার মরণপণ সংগ্রাম করেন সেই নেতার অধিকাংশই ছিলেন উত্তরবঙ্গবাসী। তারা হলেন দিনাজপুরের হাজী মো. দানেশ, গুরুদাস তালুকদার, বরদা চক্রবর্তী, রূপনারায়ণ রায়, হেলেকেতু সিং প্রমুখ বিপ্লবী নেতারা ছিলেন আন্দোলনের স্বাপ্নিক রূপকার। তার মধ্যে তেভাগা আন্দোলনের সর্বাধিক ত্যাগী ও তেজস্বী নেতারূপে হাজী মো. দানেশের নামটি ‘প্রবাদ পুরুষে’ পরিণত হয়।

দুই কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের জনক হাজী মোহাম্মদ দানেশ ১৯০০ সালের ২৭ জুন দিনাজপুর জেলার বোচাগঞ্জ থানার সুলতানপুর গ্রামে এক বড় জোতদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। নিজ গ্রামে শৈশবে লেখাপড়ায় হাতেখড়ি হলে সেতাবগঞ্জ থেকে প্রবেশিকা, রাজশাহী কলেজ থেকে আইএ এবং বিএ পাস করেন। পরবর্তীতে ভারতের উত্তর প্রদেশে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে এমএ এবং আইনে বিএল ডিগ্রি লাভ করেন। ঠাকুরগাঁও আদালতে প্রথম উকিল হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে দিনাজপুর এসএন কলেজে ইতিহাসের অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষকতা করেন। এক পর্যায়ে দিনাজপুর জেলা আদালতে আইন ব্যবসা আরম্ভ করেন। কৃষক বর্গা চাষি, ভাগ চাষি, ক্রান্তি চাষিদের ওপর জমিদার ও জোতদারের সীমাহীন অত্যাচার দেখে শিশু বয়সে মোহাম্মদ দানেশের মানসিক চিন্তায় বিপ্লব ঘটে। তিনি ছাত্র জীবনেই কৃষকের ওপর অত্যাচারের প্রতিকার কল্পে কৃষক আন্দোলনে আকৃষ্ট হন। হাজী দানেশ ১৯৩৮ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিউনিস্ট পার্টির অঙ্গসংগঠন কৃষক সমিতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন এবং কৃষক আন্দোলন সংগঠিত করেন। তার নেতৃত্বে দিনাজপুর জেলায় টোল আদায় বন্ধ ও জমিদারি উচ্ছেদের দাবিতে কৃষক আন্দোলন জোরদার হয় এবং আন্দোলনকালে তিনি কারাভোগ করেন। নীলফামারী জেলার ডোমারে ১৯৪২ সালে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় কৃষক সম্মেলনে অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন হাজী দানেশ। সম্মেলনের পরপরই তিনি গ্রেফতার হন এবং দীর্ঘদিন কারাভোগ করেন। বর্গাচাষিদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে তিনি উত্তরবঙ্গে তেভাগা আন্দোলন সংগঠিত করেন।

তেভাগা আন্দোলনের প্রস্তুতি পর্বে দাবি ছিল : ১. উৎপন্ন ফলের তিন ভাগের দুই ভাগ চাই। ২. জমিতে চাষির দখল স্বত্ব দিতে হবে। ৩. শতকরা সাড়ে বারো ভাগের বেশি অর্থাৎ মণকরা ধানের পাঁচ সেরের বেশি সুদ নেই। ৪. হরেক রকমের আবোয়ারসহ বাজে কোনো কর আদায় করা চলবে না। ৫. রসিদ ছাড়া কোনো আদায় নেই। ৬. আবাদযোগ্য সব পতিত জমি আবাদ করতে হবে। ৭. জোতদারের পরিবর্তে ভাগচাষিদের খোলানে ধান তুলতে হবে। তারা তিনটি স্লোগান নিয়ে এগিয়ে ছিলেন। (ক) নিজ খোলানো ধান তোল। (খ) আধা নয় তেভাগা চাই। (গ) কর্জ ধানে সুদ নাই। ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলা, তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার দুর্গাপুর থানার বাহের খালী গ্রামের রাসমনি, দিনাজপুরের কৌশলা কার্মায়নী, যশোদা রানী, ঠাকুরগাঁয়ের রানীশংকৈলের ভা-ারিয়া, দিনাজপুরের ঠুমনিয়ার সুরমা সিং, সুকুর চাঁদ, নবাবগঞ্জের রামচন্দ্রপুরের জমিদার বাড়ির রাজবধূর নেতৃত্বে নাচোলের সাঁওতাল, মুড়িয়াল সর্দার, রাজবংশী মাহাতো হিন্দু-মুসলিম সব সম্প্রদায়ের বর্গাচাষিরা অস্তিত্বের প্রশ্নে একাত্ম হয়েছিলেন। এ আন্দোলন বিস্তার লাভ করে বেশিরভাগ ভাবপ্রবণ কোচ রাজবংশী ও সাঁওতাল আদিবাসীদের মধ্যে। তারাই ছিল বেশির ভাগ শোষিত ও বঞ্চিত সম্প্রদায়। নেতাদের উসকানিতে যখন থেকে জোতদারের সম্মতি ব্যতিরেকে কাটা ধানের পুঞ্জ জোতদারের খামারের পরিবর্তে আধিয়ারে নিজ নিজ বাড়ির উঠানে তোলা শুরু হয় এবং মাড়াই ধান তিন ভাগ করে দুই ভাগ নিজের জন্য রেখে বাকি ভাগ জোতদারদের দেওয়া শুরু হয় তখনই জোতদার শ্রেণির কলিজায় আঘাত পড়ে। কিন্তু জোতদারদের পক্ষে কিছু করার উপায় ছিল না সমবেত ক্রুদ্ধ আধিয়ারগণের উত্থানের বিরুদ্ধে। তখন এগিয়ে আসে ব্রিটিশ শাসন।

তেভাগা আন্দোলনের ফলে ইংরেজ সরকার দলন নীতির পথে অগ্রসর হয়। রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ হাজার উত্তেজিত কৃষক-শ্রমিক-জনতার ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দেন। ফলে কমপক্ষে পঁয়ত্রিশ জন নিহত এবং বহু মিছিলকারীর আহত হওয়ার মধ্য দিয়ে তেভাগা আন্দোলনের প্রথম সশস্ত্র পর্বটি সংঘটিত হয়। ১৯৫০ সালে সংঘটিত দ্বিতীয় পর্বে সরকার নাচোলের ১২টি গ্রাম আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়। অসংখ্য রমণীকে বলাৎকার করা হয়, গুলি চালিয়ে নির্বিচারে হত্যা করা হয়, ইলা মিত্র গ্রেফতার ও নির্যাতনের শিকার হন। তবে এ আন্দোলন বিফলে যায়নি। ১৯৫০ সালে পূর্ববঙ্গ অধিগ্রহণ, প্রজাতন্ত্র ও প্রজাস্বত্ব আইন প্রণয়নে প্রভাব বিস্তার করেছিল তেভাগা আন্দোলন। আর এই আন্দোলনের প্রবাদ পুরুষ হাজী দানেশ জেল জুলুম অত্যাচার সহ্য করে সর্বমোট ২৮ বছর কারাগারের অভ্যন্তরে থেকেছেন। সব সময় দেশের মানুষের কথা চিন্তা করে গেছেন। কোনো প্রকার লোভ লালসার ফাঁদে তিনি পা দেননি। তিনি তার বংশধরদের জন্য কিছুই রেখে যেতে পারেননি। তার জীবনের মূল মন্ত্র ছিল শোষণমুক্ত ‘কৃষক শ্রমিকরাজ’ কায়েম করা। কৃষকের স্বার্থের বিরুদ্ধে তিনি কোনো সময়েই আপস করেননি। তিনি সংসদ সদস্য হয়েও ট্রেনে তৃতীয় শ্রেণিতে যাতায়াত করেছেন এবং সেভাবেই ভ্রমণ ভাতা গ্রহণ করেছেন। এই নিবেদিত নেতা ১৯৮৬ সালের ২৮ জুন তদানীন্তন পিজি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন।

লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist