এস এম মুকুল

  ২৫ জুন, ২০১৭

প্রতিবেশ

তালগাছ আমার

আজ চাঁদ দেখা গেলে আগামীকাল ঈদ। ধনী-গরিব নির্বিশেষে বিশ্ব মুসলিমের জন্য ঈদ আনন্দের বার্তা বয়ে আনে। ঈদ আনন্দের হলেও এবার এর বাংলা বানান নিয়ে সবার মধ্যে বিব্রতকর পরিস্থিতির জন্ম হয়েছে। ‘ঈদ’ আর ‘ইদ’ বানানরীতি নিয়ে ভাষারীতিতে রীতিমতো ভীতি ঢুকিয়ে দিয়েছে বাংলা একাডেমি। ঈদ বানানটি আগের মতোই ‘দীর্ঘ-ঈ-দ ঈদ’ নাকি ‘হ্রস্ব-ই-দ ইদ’ হবে-এই নিয়ে সরগরম বাংলা ভাষাবিদ থেকে ফেসবুকার পর্যন্ত। নিজের কাছেও খটকা লাগে, বানান নিয়ে এমন তেলেসমাতি করার কী কারণ আছে। যুগ যুগ ধরে চলে আসা বানানরীতি পরিবর্তনে এখন জনমনে বানান ভুলের ভীতি ঢুকে গেছে। শব্দের বানান পরিবর্তনের মতো কিছু না করে বরং বাংলা একাডেমি নতুন নতুন বাংলা শব্দ উদ্ভাবনে গবেষণা করতে পারত। তা না করে কেন যে এই বানান বিভ্রাটে জাতিকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে তা ঠিক বোধগম্য নয়। তবে ঈদ শব্দটির বানান আর যাই হোক ঈদের আনন্দের যেন একটুও কমতি না হয় সেটাই প্রত্যাশিত।

কথায় বা তর্কে জিত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রচলিত কথা-‘তালগাছটি আমার’। অর্থাৎ জোর করে জিত নেওয়া কিংবা তালগাছের ন্যায় নিজ বাক্যে অনড় থাকাকে বোঝায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তালগাছ কবিতার কথা ছোটবেলায় পড়েছি-‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে/সব গাছ ছাড়িয়ে/উঁকি মারে আকাশে...।’ তালগাছ প্রাকৃতিক শোভার অনন্য উপাদান। সারি সারি তালগাছের সৌন্দর্যের কথা ভাবতেই ভালো লাগে। তালগাছে শিল্পী পাখি বাবুইয়ের বাসা ঝুলে থাকা আর বাতাসে দোল খাওয়া নয়নকাড়া মনোরম দৃশ্য। আমার আজকের লেখার বিষয় তালগাছ। কথায় জিতের তালগাছ, দেখার তালগাছ আর ছবি কিংবা কবিতার তালগাছ ছাড়িয়ে তার উপকার, বহুমাত্রিক ব্যবহার আর তালগাছপ্রেমীদের গর্ব করার কীর্তির কথাই জানাব পাঠকদের। হঠাৎ করেই বজ্রপাতের পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাওয়ায় বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা ও ঝুঁকি বেড়েছে। বিশ্বে বজ্রপাতের কারণে মৃত্যুর ঘটনায় বাংলাদেশের নাম শীর্ষে উঠে এসেছে। আর এ কারণেই গুরুত্বহীন তালগাছের গুরুত্বও বেড়ে গেছে। তালগাছ বজ্র নিরোধক হিসেবে কাজ করে। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, গ্রামেগঞ্জে প্রচুর পরিমাণে তালগাছ ও নারিকেল গাছ থাকলে বজ্রপাতে মৃত্যুহার কমানো সম্ভব। শক্ত মজবুত গভীরমূলী বৃক্ষ বলে ঝড়-তুফান, টর্নেডো, বাতাস প্রতিরোধ এবং মাটি ক্ষয় রোধে তাল গাছের ভূমিকা অনস্বীকার্য। জনমনে প্রচলিত আছে, আগে বজ্রপাত হলে তা তালগাছ বা অন্য কোনো বড় গাছের ওপর পড়ত। আর বজ্রপাতের বিদ্যুৎ রশ্মি গাছ হয়ে তা মাটিতে চলে যেত। এতে জনমানুষের তেমন ক্ষতি হতো না। ভালো খবরটি হলো বজ্রপাতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধে দেশব্যাপী তালগাছের চারা রোপণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যেই সরকারি উদ্যোগে ১০ লাখ তালগাছের চারা রোপণ করা হয়েছে। শুধু সৌন্দর্যের দিক দিয়ে নয়, তালগাছ আমাদের অনেক উপকারে আসে। বাংলাদেশের সব স্থানে কম-বেশি তালগাছ চোখে পড়ে। তবে ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, গাজীপুর, রাজশাহী ও খুলনা অঞ্চলে ভালো তাল উৎপাদন হয়। প্রায় সব ধরনের মাটিতে তালগাছ জন্মে। তালের রস শরীরের জন্য বেশ উপকারী। তাল পাকা ও কাঁচা দু’ভাবেই তাল খাওয়া যায়। তালের রস দিয়ে তৈরি হয় তাল মিশ্রি। ছোটবেলায় দেখতাম তালমিশ্রি ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বরেন্দ্র অঞ্চলে গরমের তীব্রতা অনেক বেশি থাকায় বেশিরভাগ বাড়ি গরম ও জলবায়ু সহনশীল মাটি দ্বারা তৈরি হয়। মাটির বাড়ি তৈরিতে মূল উপাদান মাটির পরেই তালগাছের প্রয়োজন হয়। তালগাছের কাঠ ঘুণ পোকা ধরে না এবং শক্ত ও দীর্ঘস্থায়ী। তাই মাটির বাড়ির তীর, রূইয়াসহ বিভিন্ন কাজে তালগাছ বহুল ব্যবহৃত। তালগাছের কাঠের গোড়ার অংশ দিয়ে ডিঙি নৌকা তৈরি, ঘরের খুঁটি, আড়া, রুয়া, বাটাম, কৃষকের লাঙলের ঈষ তৈরি করা হয়। একটি তালগাছ উচ্চতায় ২০-২৫ মিটার হয়ে থাকে এবং ১৪০-১৫০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে।

এবার জানব তালগাছপ্রেমীদের কীর্তিকথা। প্রকৃতির শোভা সুরক্ষায় সড়কের পাশে তালগাছ লাগিয়ে সবার দৃষ্টি কেড়েছেন নড়াইলের লোহাগড়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক ও মুক্তিযোদ্ধা আল মাহমুদ ইরোজ স্যার। ১৯৮৫ সালে ইরোজ স্যার উপজেলার রাস্তার পাশে সারিবদ্ধভাবে তিন হাজার তালের বীজ রোপণ করলে দুই হাজার গাছ বাঁচে। ২০০১ সালে দুই হাজার বিচিতে এক হাজার তিনশত গাছ, ২০১৩ সালে ১৫ হাজার বিচিতে আট হাজার গাছ বড় হতে থাকে। ধারাবাহিকভাবে বাড়ি বাড়ি থেকে তালের বীজ সংগ্রহ করে প্রতিবছরই নড়াইল লোহাগড়া, লহুড়িয়া, কুন্দশী, পাচুড়িয়া, ইতনা-ধলইতলা, কাশীপুর, রাজপুর, কালনা, ও কুন্দশী-মঙ্গলহাটা সড়কসহ নড়াইল লোহাগড়া উপজেলার বিভিন্ন সড়কের পাশে কম-বেশি করে লাগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। পরিবেশপ্রেমী এই মহান শিক্ষক ব্যাংকে স্ত্রীর সঞ্চিত এক লাখ টাকাও তালগাছ লাগানোর পেছনে খরচ করেন। তিনি নিজ হাতে যতœসহকারে গাছ লাগান এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করেন।

আরেকটি খবর জানা গেছে তালগাছপ্রেমী কয়েক যুবককে নিয়ে। তালগাছের সুদিন ফিরিয়ে আনতে যশোরের কয়েক যুবক ব্যতিক্রমী এক উদ্যোগ নিয়েছেন। যার নেতৃত্বে রয়েছেন জেলার মনিরামপুর উপজেলার শ্যামকুড় ইউনিয়নের হাসাডাঙা গ্রামের উদ্যমী যুবক নাঈম রেজা। এই যুবক পৃথিবীর বৃহত্তম তালের সারি গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রায় ৪০ কিলোমিটার সড়কের ধারে তালের আঁটি রোপণ করেছেন। জানা গেছে, ২০১৪ সালের প্রথম মনিরামপুর উপজেলার চিনেটোলা বাজার এলাকার ফকিরের রাস্তা থেকে রাজগঞ্জ পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার রাস্তার দু’পাশে ছয় হাজারের বেশি তালের আঁটি রোপণের মাধ্যমে এই যাত্রা শুরু করেন তারা। ২০১৫ সালে নিজ গ্রাম হাসাডাঙা থেকে কেশবপুরের মধ্যকুল এলাকা পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার রাস্তার পাশে ছয় হাজার তালের আঁটি রোপণ করেন। ২০১৬ যশোর-রাজগঞ্জ-সাতক্ষীরা ৭৫ কিলোমিটার সড়কের দুই পাশে ১২ কিলোমিটারের বেশি অংশে ছয় হাজার তালের আঁটি লাগানো সম্পন্ন হয়েছে। রাস্তার বাকি অংশে লাগানোর কাজও অব্যাহত আছে। তালগাছপ্রেমী নাঈম রেজার সহযোগিতায় আছেন তার বন্ধু সরোয়ার হোসেন, আব্দুল্লাহ আল মামুন, আশিকুর রহমান, সোহেল রানা।

জানা গেছে, এই যুবকরা রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়কের দু’পাশে গহের আলীর তালগাছের সারির ওপর প্রতিবেদন দেখে উদ্বুদ্ধ হন। নওগাঁ জেলার ভিমপুর ইউনিয়নের শিকারপুর গ্রামের শতোর্ধ্ব বয়সী বৃদ্ধ গহের আলীর তালগাছ লাগানোর খবর ৩০ জানুয়ারি ২০০৯ ইং জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদির মাধ্যমে দেশবাসী জানতে পারে। ভিক্ষুক বৃদ্ধ গহের আলীর সামর্থ্য নেই অন্য ফলদ বা দামি বনজ গাছের চারা কেনার। তিনি চাল-ডাল আর তালের আঁটি ভিক্ষে হিসেবে সংগ্রহ করে আঁটি পুঁতে দেন সরকারি রাস্তার দুই পাশে। প্রখর রোদে পথচারীদের কষ্টের কথা চিন্তা করে গহের আলী তালগাছ লাগানোর কাজ শুরু করেন। রাজশাহী নওগাঁ মহাসড়কের ভিমপুর ইউনিয়নের দুই পাশে দাঁড়িয়ে আছে যে তালগাছগুলো তার সবই গহের আলীর লাগানো। ইত্যাদিতে প্রচারের পর সেই বছরেরই ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে তিনি প্রথমবারের মতো জাতীয় পরিবেশ পদক-২০০৯ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে গ্রহণ করেন। ২৭ ডিসেম্বর ২০১০ সালে তিনি বার্ধক্যজনিত রোগে মৃত্যুবরণ করেন। মানুষ ইচ্ছা করলে সমাজ ও দেশকে কতভাবেই না দিতে পারে। গহের আলী, ইরোজ স্যার এবং নাঈম রেজার মতো হয়তো আরো অনেকেই নিভৃতে এমন সামাজিক কাজ করে চলেছেন। জলবায়ুর পরিবর্তনে আবহাওয়ার বিপর্যয়ে প্রকৃতির নির্দয় প্রতিশোধ বজ্রপাত থেকে জানমাল রক্ষা এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় আসুন নিজ দায়িত্বে সবাই তালগাছ রোপণ করি।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist