শফিকুল ইসলাম খোকন

  ২৪ জুন, ২০১৭

মতামত

স্বস্তির বাজেট না করের বোঝা

বাংলাদেশে এ মুহূর্তে কোন বিষয়টি সবচেয়ে আলোচিত বা সমালোচিত? উত্তরে অবশ্যই আসবে ‘বাজেট ভাবনা’। আবার যদি প্রশ্ন করা হয়, সরকারি ব্যাংকের অবস্থা কী? উত্তর আসবে খুবই নাজুক। সরকারি ব্যাংকগুলোর দিকে তাকালে এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে অন্যত্র যাওয়ার আর প্রয়োজন পড়ে না। তবে বাজেটের প্রশ্নে বলা যায়, ভ্যাট আর ভোট যেন মিলেমিশে একাকার। প্রতিটি ক্ষেতেই স্বস্তি আর অস্বস্তি থাকে। বাজেটের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নয়। বাজেট অবশ্যই হওয়া উচিত গণমুখী, জনগণের কল্যাণে। বর্তমান অর্থবছরের বাজেট নিয়ে সবপর্যায়ে আলোচনা-সমালোচনা দুটোই রয়েছে। উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে ১ জুন সংসদে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট পেশ করলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। পরদিন শুক্রবার প্রকাশিত সব পত্রিকার প্রধান সংবাদের শিরোনাম ছিল অনেকটা কাছাকাছি। ভেতরের খবরেও অমিলের চেয়ে মিল ছিল বেশি। মিডিয়ায় প্রকাশিত প্রায় প্রতিটি সংবাদে বলা হয়, দেশকে উন্নয়নের সড়কে এগিয়ে নিতে এ যাবৎকালের সর্ববৃহৎ বাজেট ঘোষণা করেছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার। বাজেটের আকার ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকা। বলা হয়, বাজেটে ব্যয় বেড়েছে। বাজেট বক্তৃতার শুরুতেই ছিল চমক। ‘উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ’ বলেছেন অর্থমন্ত্রী। সরকারের অগ্রাধিকার খাত হিসেবে যুক্ত হয়েছে অবকাঠামো ও মানবসম্পদ উন্নয়ন। রাজস্ব খাতে উচ্চ প্রবৃদ্ধির আকাক্সক্ষার সঙ্গে সামাজিক নিরাপত্তার বদলে এসেছে সামাজিক সুরক্ষার ভাবনা। ভ্যাটের প্রশ্নে অর্থমন্ত্রী ছিলেন চিম্বুক পাহাড়ের মতো অনড়।

জাতীয় সংসদে বাংলাদেশের ৪৬তম এ বাজেট ছিল বর্তমান সরকারের শেষ পূর্ণাঙ্গ বাজেট এবং আওয়ামী লীগ সরকারের ১৮তম বাজেট। আর বর্তমান অর্থমন্ত্রীর এটি ১১তম এবং টানা নবম উপস্থাপন। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের এই বাজেটের আকার দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকা, যা দেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ বাজেট। বাজেটের আগে ভ্যাট নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা বিতর্ক চললেও তা ১৫ শতাংশই ধার্য রয়েছে এবং ১ জুলাই থেকেই কার্যকর হবে। বরাবরের মতো এবারও সরকারি দল ও শরিকদের পক্ষ থেকে উপস্থাপিত বাজেটকে গণমুখী এবং অনান্য রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে গণবিরোধী বাজেট হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন উচ্চাভিলাষী। তবে অর্থমন্ত্রীর ঘোষণা মতো চলতি বছরের বাজেটও সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে যত বড় আকারের বাজেটই দেওয়া হোক না কেন, বাস্তবায়ন করতে না পারলে তা শুধু মুখরোচক আলোচনার খোরাক জোগাবেÑএমন ভাবনা অমূলক নয়। বাজেটের মাধ্যমে দেশের সীমিত সম্পদ দিয়ে প্রয়োজন মেটানোর পাশাপাশি কৌশলগত পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ পাওয়া যায়, কিন্তু এবারের বাজেটে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার শক্তি সঞ্চয়ের তেমন কোনো পথনির্দেশনা স্পষ্ট নয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

উন্নয়ন বাজেট বা এডিপিতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে যোগাযোগ ও অবকাঠামো উন্নয়নে। পদ্মা সেতু, মেট্রো রেল, পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ আটটি মেগা প্রকল্পে বড় বরাদ্দ থাকছে। বাড়ছে সামাজিক নিরাপত্তা নেটের আওতাও। এডিপিতে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ রয়েছে যোগাযোগ ও পরিবহন খাতে। এই খাতে বরাদ্দ ৪১ হাজার ৫৩ কোটি টাকা। এর পরই রয়েছে বিদ্যুৎ, শিক্ষা এবং বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি খাত। বাজেট নিয়ে এর আগে বিভিন্ন আলোচনায় ১৫ শতাংশ ভ্যাট আদায়ের বিষয়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল। ব্যবসায়ীরা ভ্যাটের হার কমানোর দাবি জানিয়ে আসছিলেন। অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরাও মনে করছেন, এতে দ্রব্যমূল্য অনেক বেড়ে যেতে পারে। উপস্থাপিত বাজেটে ১৫ শতাংশ ভ্যাটেরই প্রস্তাব করা হয়েছে। তার ওপর আছে ব্যাংকে আবগারি শুল্ক বাড়ানোর বিষয়টি, যা সাধারণ মানুষের কপালেও দুশ্চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে।

বিভিন্ন পত্রপত্রিকা বাজেট নিয়ে ব্যাপক লেখালেখি করেছে। পত্রপত্রিকায়ও বাজেট বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় আছে। বিশেষজ্ঞরাও এ বাজেট নিয়ে বিভিন্ন মতামত ব্যক্ত করেছেন। তাদের কেউ কেউ প্রস্তাবিত বাজেটে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ার পাশাপাশি মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা করেছেন। তাদের মতে, ব্যবসায়ীদের চাপের মুখে প্রস্তাবিত বাজেটে ভ্যাট আইনে অনেক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, যেটা ঠিক হয়নি। একইভাবে রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে ভ্যাটের ওপর নির্ভরশীলতা এই বাজেটের বড় চ্যালেঞ্জ বলেও মনে করছেন তারা। বাজেটে করপোরেট কর কমানো এবং শিক্ষা-প্রযুক্তি ও অবকাঠামো খাতে বরাদ্দ বাড়ানোয় সাধুবাদ জানানো হয়েছে। তারা বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটের ৭ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে এগিয়ে গেলে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যে এগিয়ে যাবে।

এ ব্যাপারে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ার পাশাপাশি মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা রয়েছে। আমরা চেয়েছিলাম এবারের বাজেট মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় কমাতে না পারলেও যেন ব্যয় না বাড়িয়ে দেয়। শিল্প খাত, কৃষি খাত, উৎপাদন খরচ যেন না বাড়িয়ে দেয়Ñযদি কমাতে না পারে। দুটোর একটিও এ বাজেটে রক্ষিত হয়নি। একটি সম্পূর্ণ অধ্যায় দেওয়া হয়েছে সুশাসন ও সংস্কারের ব্যাপারে কিন্তু গতানুগতিক একটি কথাও সুনির্দিষ্টভাবে নেই।’ (সূত্র : প্রতিদিনের সংবাদ, ২ জুন ২০১৭)। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও অর্থনীতিবিদ ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এ বাজেট বাস্তবায়নযোগ্য নয়। প্রস্তাবিত বাজেটে শুধু গাণিতিক হিসাবই প্রাধান্য পেয়েছে। বাজেটের যে গাণিতিক হিসাব রয়েছে, তা থেকে এবারের বাজেটও ভিন্ন কিছু নয়। এ বাজেট হচ্ছে সরকারের টাকা আয়ের বাজেট। সরকার টাকা আয় করবে আর সরকারই ভোগ করবে। বেসরকারি বিনিয়োগের কোনো ক্ষেত্র তৈরি হবে না। শিল্পের উন্নয়নে কোনো উদ্যোগ নেই। এক পোশাকশিল্পের ওপরই বাজেটে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এতে অন্য শিল্প গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। বিশাল বাজেটের জন্য সাধারণ মানুষের পকেট কেটে টাকা আদায় করা হবে। কিন্তু সাধারণ মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে বাজেটে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। এ বাজেট নিয়ে রাজনৈতিক দলের মিশ্র প্রতিক্রিয়ার শেষ নেই। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘এই বাজেট হলো লুটপাটের বাজেট। আওয়ামী লীগের চুরি করার বাজেট। অর্থমন্ত্রীও নিজে কিছুই করতে পারেন না। বাজেট তৈরি হয় শেখ হাসিনার কথামতো। শেখ হাসিনা যা চান বাজেট তাই। বাজেটোত্তর আলোচনা ও সমালোচনা এবং পক্ষে ও বিপক্ষে অনেক কথা চলছে সব পর্যায়ে। আবগারি শুল্ক নিয়ে আলোচনা সংসদ পর্যন্ত গড়ায়। ব্যাংকে আমানতের বিপরীতে আবগারি শুল্ক বাড়ানো যৌক্তিক নয় বলে মনে করেন সরকার ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা। তারা আবগারি শুল্ক প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন। সাংসদরা বলেন, সারা দেশে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। এ অবস্থায় জনগণের বিরুদ্ধে গিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক নয়। বিষয়টি নিয়ে অর্থমন্ত্রীকে জেদ না ধরার আহ্বান জানিয়েছেন তারা। ২০১৭-১৮ প্রস্তাবিত বাজেটকে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত নিজের জীবনের শ্রেষ্ঠ বাজেট হিসেবে উল্লেখ করলেও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ‘এটি দেশের সবচেয়ে সমালোচিত বাজেট।’ তারা বলছেন, এ বাজেট নিয়ে সবাই ‘ক্রিটিসাইজ’ করছে। এমনকি সংসদ সদস্যদের পাশাপাশি মন্ত্রীরাও ‘ক্রিটিসাইজ’ করছেন। এর আগে কখনো মন্ত্রীরা বাজেট নিয়ে এমন ‘ক্রিটিসাইজ’ করেননি। রাজধানীর একটি হোটেলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) আয়োজিত ‘সিপিডি বাজেট সংলাপ-২০১৭’তে অংশ নিয়ে এসব কথা বলেন বক্তারা।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist