ড. জহির উদ্দীন মাহমুদ

  ২২ জুন, ২০১৭

ইতিহাস

অবরুদ্ধ বায়তুল মোকাদ্দাস

বায়তুল মোকাদ্দাস হচ্ছে ইসলামের প্রথম কেবলা এবং মক্কা মোকাররমা ও মদিনা মোনাওয়ারার পর তৃতীয় পবিত্র স্থান। হজরত রাসুলে কারিম (সা.) মক্কার মসজিদুল হারাম, মদিনার মসজিদে নববী ও বায়তুল মোকাদ্দাস মসজিদের উদ্দেশে সফরকে বিশেষভাবে সওয়াবের কাজ হিসেবে উল্লেখ করেছেন, যা অন্য কোনো মসজিদ সম্পর্কে করেননি। হিজরতের পর বায়তুল মোকাদ্দাস ইসলামের প্রথম কিবলা। বায়তুল মোকাদ্দাস দুনিয়ার জন্য অসংখ্য ভূখ-ের মতো কোনো সাধারণ ভূখ- নয়। এ পবিত্র ঘর থেকেই শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) মিরাজে গমন করেছিলেন।

বায়তুল মোকাদ্দাস মসজিদ এবং তার আশপাশের এলাকা বহু নবীর স্মৃতিবিজড়িত। এই পবিত্র নাম শুধু একটি স্থানের সঙ্গে জড়িত নয়, বরং এই নাম সব মুসলমানের ইমান ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এখানে রয়েছে অসংখ্য নবী-রাসুলের মাজার। অহি ও ইসলামের অবতরণস্থল এ নগরী নবীদের দ্বীন প্রচারের কেন্দ্রভূমি। তাই এ পবিত্র নগরীর প্রতি ভালোবাসা প্রতিটি মুমিনের হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত।

হজরত ইব্রাহিম (আ.) কাবাঘর নির্মাণের ৪০ বছর পর হজরত ইয়াকুব (আ.) জেরুজালেমে আল আকসা মসজিদ নির্মাণ করেন। অতঃপর হজরত সোলায়মান (আ.) এই পবিত্র মসজিদের পুনর্নির্মাণ করেন। ৬৩৮ ঈসায়ী সালে দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.)-এর খেলাফতকালে পুরো বায়তুল মোকাদ্দাস এলাকা মুসলমানদের দখলে আসে। ১০৯৬ সালে খ্রিস্টান ক্রুসেডাররা সমগ্র সিরিয়া ও ফিলিস্তিন দখল করে নেওয়ার পর বায়তুল মোকাদ্দাস মসজিদের ব্যাপক পরিবর্তন করে একে গির্জায় পরিণত করে। এরপর ১১৮৭ সালে সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবী জেরুজালেম শহর মুসলমানদের অধিকারে নিয়ে আসেন। সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর হাতে পরাজিত হওয়ার পর খ্রিস্টশক্তি পিছু হটলেও ইহুদি চক্র বায়তুল মোকাদ্দাসের প্রতি লোলুপ দৃষ্টি রাখে। তারা ফিলিস্তিন থেকে শুরু করে সুদূর মদিনা পর্যন্ত সারা মুসলিম এলাকা নিয়ে বৃহত্তর ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র করে।

তারা তাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য তুরস্কের তৎকালীন শাসক সুলতান আবদুল হামিদের নিকট ফিলিস্তিনে জমি কেনার অনুমতি চায় এবং এর বিনিময়ে তারা তুরস্কের সকল বিদেশি ঋণ পরিশোধ করে দেবে বলে অঙ্গীকার করে। সুলতান তাদের এ ষড়যন্ত্রমূলক প্রস্তাব মানেননি। তা সত্ত্বেও ইহুদিরা গোপনে জমি কিনতে থাকে। ১৯১৭ সালে ইংরেজরা ফিলিস্তিনে প্রবেশ করে ও ১৯২০ সালে সেখানে পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে এবং স্যার হার্বাট স্যামুয়েল নামক একজন ইহুদিকে সেখানে ব্রিটিশ কমিশনার নিযুক্ত করে। এই জমি কেনায় বহিরাগত ইহুদিদের জন্য ফিলিস্তিনের দুয়ার খুলে যায়। সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা ইহুদিবাদী উগ্র সংস্থাগুলোকে ফিলিস্তিনে বসবাস ও জমি কেনার জন্য কোটি কোটি ডলার প্রদান করে। ফলে অল্পদিনের মধ্যে বহু সংখ্যক ইহুদি ফিলিস্তিনে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করে। ইহুদিদের সংখ্যা বাড়তে থাকার কারণে আরব মুসলমানদের সঙ্গে দাঙ্গা-হাঙ্গামা প্রতিদিনের ঘটনায় পরিণত হয়।

অবশেষে ব্রিটিশ সরকার ফিলিস্তিনকে আরব ও ইহুদিদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। যার ফলে ১৯৪৮ সালের ১৫ মে বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে ফিলিস্তিনে অবৈধ ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর ইহুদিরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে এবং মুসলমানদের নির্বিচারে হত্যা করতে থাকে। তাদের অত্যাচারে জর্জরিত আরবরা জীবন বাঁচাতে দলে দলে দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। এ সত্ত্বেও তখনও বায়তুল মোকাদ্দাস মুসলমানদের দখলে ছিল। কিন্তু আরবদের দুর্বলতার মুখে ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের মাধ্যমেও তা উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ফিলিস্তিনের নির্যাতিত জনগণ দীর্ঘদিন ধরে তাদের আবাসভূমি ও আল-কুদ্স (বায়তুল মোকাদ্দাস) উদ্ধারের জন্য রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের সংগ্রামে দিশেহারা হয়ে ইসরায়েল ফিলিস্তিনের মধ্যে ভাঙন ধরানোর জন্য ফিলিস্তিনের একটি ক্ষুদ্র অংশে সীমিত স্বায়ত্তশাসনের কথা বলে কিছু সংখ্যক নেতাকে বিভ্রান্ত করেছে। তথাকথিত শান্তি আলোচনার সুযোগে তারা একে একে ফিলিস্তিনের প্রকৃত সংগ্রামী নেতাদের হত্যা করে চলছে এবং ফিলিস্তিনের নতুন নতুন এলাকা দখল করে ইহুদি বসতি সম্প্রসারণ অব্যাহত রেখেছে। এমনকি ফিলিস্তিনে মানবিক ত্রাণসহায়তা পৌঁছাতে পর্যন্ত তারা বাধাদান করছে। ২০১০ সালে তুরস্ক সব বিভিন্ন দেশের ত্রাণসামগ্রীসহ জাহাজবহর ফ্লেটিলায় আক্রমণ চালিয়ে তারা ২০ জন বেসামরিক ত্রাণকর্মীকে হত্যা করেছে। এ বছরও বিভিন্ন ত্রাণবহরকে তারা বাধাদান অব্যাহত রেখেছে। পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিবর্গ ও ইহুদিবাদী চক্র শুধু ফিলিস্তিনের মুসলমানদের ওপরই তাদের নির্যাতন সীমাবদ্ধ রাখেনি। তারা বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্রুসেড শুরু করেছে।

জালিম ইহুদিবাদীদের রুখতে এবং আল-আকসা মুক্ত করতে হলে বিশ্বের মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে সব ধরনের প্রচেষ্টা চালাতে হবে। ১৯৭৯ সালে ইরানে সংঘটিত ইসলামী বিপ্লবের নেতা ইমাম খোমেনি আল-আকসা মসজিদকে মুক্তির লক্ষ্যে সমগ্র মুসলিম উম্মাহকে প্রতিবছর রমজানের শেষ শুক্রবারকে আল কুদ্স দিবস হিসেবে পালনের আহ্বান জানান এবং সেই থেকে বিশ্বে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।

আসুন, রমজানের শেষ শুক্রবার (২৭ রমজান, ১৪৩৮ হিজরি, ২৩ জুন ২০১৭) আল-কুদ্স দিবসে আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে শপথ নিই, যত দিন না আমরা প্রথম কিবলা আল-আকসায় নির্বিঘেœ নামাজ পড়তে পারব, ফিলিস্তিনি ভাইবোনেরা তাদের মাতৃভূমির পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করবে, ততদিন আল-কুদ্স পুনরুদ্ধারের এ সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist