এস আর শানু খান

  ২৯ মে, ২০১৭

রোজা

সিয়াম সাধনা যুগে যুগে

ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের ওপর প্রতিষ্ঠিত। হাদিসের ভাষায় ‘ইসলামের বুনিয়াদ পাঁচটি জিনিসের ওপর’ (বুখাার ও মুসলিম শরিফ)। ইসলামের পাঁচটি বুনিয়াদ যথাক্রমেÑকালেমা, নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত। কালেমা ও নামাজের পরেই রোজা বা সিয়ামের স্থান। বাংলা ভাষায় কেউ কেউ সিয়ামের সমার্থক শব্দ হিসেবে রোজা শব্দটিকে ব্যবহার করলেও আসলে রোজা ফারসি শব্দ। সিয়াম আরবি শব্দ। যার অর্থ বিরত থাকা। শরিয়তের ভাষায় সিয়াম হলো কতিপয় বিশেষ শর্তসাপেক্ষ বিশেষ কিছু বিষয় থেকে নির্দিষ্ট সময়ে বিশেষভাবে বিরত থাকা।

সিয়াম সাধনা প্রতিটি নর-নারীর ওপর ফরজ। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেছেন, ‘হে ঈমানদারগণ তোমাদের ওপর সিয়ামকে ফরজ করা হয়েছে যেমনটা ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্বপুরুষদের ওপর।’ উপরোক্ত আয়াত থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, শুধু আখেরি নবীর উম্মত হজরত মুহাম্মদ (সা.) ও তার উম্মতের ওপরই নয়, বরং পূর্ববর্তী সব নবী ও তাদের উম্মতের ওপর সিয়ামকে ফরজ করা হয়েছিল।

যির ইবনে হুবাইশ (রা.) বলেন, একদা আমি রাসূলুল্লাহর (সা.) এক বিশিষ্ট সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদকে (রা.) আইয়্যামে বীয (চান্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখকে আইয়্যামে বীয বলে) সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, আল্লাহ সুবানাহু ওয়া তায়ালা আদমকে (আ.) একটা ফল খেতে নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু আদম (আ.) সেই ফল খেয়ে জান্নাত থেকে দুনিয়ায় নেমে আসতে বাধ্য হন। সে সময় তার শরীরের রং কালো হয়ে যায়। নবীর এমন দুর্দশা দেখে ফেরেস্তারা কেঁদে কেঁদে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করলেন, ‘হে আল্লাহ! আদম তোমার প্রিয় সৃষ্টি। তুমি তাকে জান্নাতে স্থান দিয়েছিলে, আমাদের দ্বারা সিজদাও করালে আর একটা মাত্র ভুলের জন্য তার দেহ কালো করে দিলে?’ জবাবে আল্লাহ সুবানাহু ওয়া তায়ালা আদমের (আ.) নিকট ওহী পাঠালেন। ‘তুমি চান্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোজা রাখ।’ আদম (আ.) তাই করলেন। ফলে তার দেহের রং আবার উজ্জ্বল হয়। আর এজন্যই এ দিনকে আইয়্যামে বীয বা উজ্জ্বল দিন বলা হয়। এছাড়াও আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহও (সা.) ঘরে এবং বাইরে (সফরে) আইয়্যামে বীযে কখনো সিয়াম না করে থাকতেন না। (নাসায়ী, মিশকাত ১৮০ পৃষ্ঠা)।

হযরত নূহকে (আ.) দ্বিতীয় আদম বলা হয়ে থাকে। নূহ (আ.)-এর যুগেও সিয়াম ছিল। নবী করীম (সা.) বলেন, নূহ ইয়াওমুল ফিতর ও ইয়াওমুল আযহা ব্যতীত সারা বছর সিয়াম পালন করতেন। (ইবনে মাজাহ ১২৪)।

মূসার (আ.) আসমানী কিতাবধারী বিখ্যাত নবী ছিলেন দাউদ (আ.)। হজরত দাউদের (আ.) যুগেও সিয়ামের প্রচলন ছিল। প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় সিয়াম হচ্ছে দাউদের (আ.) সিয়াম। তিনি এক দিন পর এক দিন সিয়াম পালন করতেন। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ১৭৯ পৃষ্ঠা)।

কোরানে আছে হজরত ঈসার (আ.) যখন জন্ম হয় তখন মা মরিয়মকে জন্ম নিয়ে জিজ্ঞেসা করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি করুণাময়ের উদ্দেশ্যে মানতের সিয়াম রেখেছি। আজ আমি কোনো মানুষের সঙ্গে মোটেই কথা বলব না।’ (সুরা মারইয়াম ১৯:২৬)।

এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, ঈসা নবীর আমলেও সিয়াম ছিল। এভাবে যুগের পর যুগ পূর্ববর্তী নবীদের ওপর সিয়াম ফরজ ছিল। অবশেষে আখেরি জামানার নবী, বিশ^নবী আহম্মদ মোস্তফা মুহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে পুরো রমজান মাসে সিয়াম পালন করাকে ফরজ করা হয়। আল্লাহ সুবানাহু ওয়া তায়ালা পবিত্র কোরানের সূরা বাকারার ১৮৫ নম্বর আয়াতে ঘোষণা করেন, ‘তোমাদের মধ্যে যে কেউ এ (রমজান) মাস পাবে সে যেন অবশ্যই সিয়াম সাধনা করে।’ দ্বিতীয় হিজরির শাবান মাসে এ আয়াত অবতীর্ণ হয় এবং তার পরের মাস রমজান থেকে উম্মতে মুহাম্মদীয়ার ফরজ সিয়াম চালু হয়।

ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনÑ হুজুরে পাক (সা.) এরশাদ করেন, ‘ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি বস্তুর ওপর রাখা হয়েছে; এ কথা স্বীকার করা যে, আল্লাহ ব্যতীত আর কোনো মাবুদ নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর বান্দা ও রাসূল, সালাত কায়েম করা, জাকাত প্রদান করা, হজ সম্পাদন করা ও রমজানে সিয়াম পালন করা। (বুখারী শরীফ হাদিস নাম্বার ৮, মুসলিম শরীফ হাদিস নাম্বার ১৬)।

রোজার রাতে স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস জায়েয করা হয়েছে, তারা তোমাদের পরিচ্ছদ এবং তোমরা তাদের পরিচ্ছদ। আল্লাহ জানেন যে তোমরা নিজেদের প্রতি অবিচার করেছিলে। অতঃপর তিনি তোমাদের প্রতি ক্ষমাশীল হলেন এবং অপরাধ ক্ষমা করলেন। কাজেই এখন তোমরা তাদের সঙ্গে সহবাসে লিপ্ত হতে পার এবং আল্লাহ যা তোমাদের জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন তা কামনা কর। (সূরা বাকারা ২.১৮৭)

পরিশেষে, আদম (আ.) থেকে ঈসা (আ.) পর্যন্ত সব উম্মতের জন্য সিয়ামের যে নির্দেশ ছিল উম্মতে মুহাম্মদীয়াদের ওপর সেই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি এ উম্মতের জন্য আল্লাহ সুবানাহু ওয়া তায়ালা মেহেরবানী করে পূর্ববর্তী উম্মতের তুলনায় সিয়ামের নির্দেশ সহজ করে দিয়েছেন। তাই এই উম্মত যদি রমজান মাসে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে অপরাধ ক্ষমা করিয়ে নিতে না পারে, তাহলে তাদের চেয়ে অভাগা আর কে হতে পারে!

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে তাঁর দেওয়া নির্দিষ্ট বিধিনিষেধ সঠিকভাবে মেনে চলার ও সিয়াম পালনের তওফিক দিন। আমীন।

লেখক : কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist