এস এম মুকুল
সমাজের আয়না
চকচক করলেই সোনা হয় না
কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসার গল্পটি বেশ প্রচলিত থাকলেও এবার ধর্ষক খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে এলো সোনা কাহিনি। দ্য রেইন ট্রি হোটেলে ধর্ষণ কাহিনির নেপথ্যে আপন জুয়েলার্সের মালিক-পুত্র দুজনই যেমন ফেঁসে গেলেন, তেমনি উন্মোচিত হলো দেশের সোনা ব্যবসার কারসাজিও। কথায় আছে চকচক করলেই সোনা হয় না, আবার খাদ ছাড়াও সোনার অলঙ্কার হয় না। সোনার ব্যবসাটি পুরো মাত্রায় বিশ্বাসের ওপর নির্ভরশীল। তাই এখানে গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণার ঘটনা খুবই প্রাসঙ্গিক। আশ্চর্যের বিষয় হলো, দেশে অবৈধ ও চোরাচালাননির্ভর সোনার ব্যবসা সম্পর্কে হঠাৎ করেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
‘সোনা সোনা সোনা লোকে বলে সোনা সোনা নয় ততো খাঁটি,/বলো যত খাঁটি তার চেয়ে খাঁটি বাংলাদেশের মাটি রে-আমার জন্মভূমির মাটি।’ জন্মভূমির মাটি সত্যিই সোনার চেয়েও খাঁটি। জন্মভূমি খাঁটি হলেও সোনার ব্যবসায় সততা এবং দেশপ্রেমে এই সোনা ব্যবসায়ীরা কতটুকু খাঁটি সে প্রশ্ন থেকেই যায়। সোনার চেয়েও খাঁটি দেশের মাটিতে যে হারে সোনার চোরাচালান উদ্ধার করা হয় তা দিয়ে এই স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশটাকে মুড়িয়ে দেওয়া যেত কি না, তাও ভেবে দেখার বিষয়। এ কথা আমরা সবাই জানি, ঢাকার শাহজালাল ও চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দরে প্রায়ই বিপুল পরিমাণ সোনা আটক হলেও চোরাচালানকারী হোতাদের কখনই ধরা পড়তে দেখা যায় না। সোনা চোরাচালান সংক্রান্ত সংবাদ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দু-একটি ব্যতিক্রম ঘটনা ছাড়া সোনা বহনকারীরাও ধরা পড়েছে তেমন খবরও নেই। পুরো ব্যাপারটাই রহস্যময়। গল্প আছে, এই দুই বিমানবন্দরের কাস্টমস বিভাগে ক্লিনার থেকে কর্মকর্তারা বছর দুয়েকের মধ্যেই কোটিপতি হয়ে যায়। হামেশাই এমন অভিযোগ শুনতে পাওয়া যায় যে, চোরাচালানকারীদের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থার কিছু অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশ অনেকটাই ওপেন
সিক্রেট। জেনে রাখুন, কাস্টমস অ্যাক্ট অনুযায়ী আটককৃত সোনার ১০ শতাংশ পুরস্কার হিসেবে পায় উদ্ধার অভিযান পরিচালনাকারী কাস্টমস ও সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দারা। সোনা চোরাচালান সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আসামিসহ
সোনা উদ্ধার হলে আটককৃত সোনা মামলার আলামত হিসেবে রক্ষিত থাকার কারণে উদ্ধারকারী দল ১০ শতাংশ পুরস্কারের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। আর এই পুরস্কার প্রাপ্তির জন্য পরিষ্কারভাবে কাস্টমস ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা সোনা আটক করলেও তার বাহক কিংবা মালিককে ধরেন না। অবাক করা বিষয় হলো, প্রতিবছর বিভিন্ন সংস্থা যে পরিমাণ সোনা আটক করে তার ১০ গুণের বেশি সোনা নাকি অবৈধ পথে দেশে ঢুকছে। চোরাচালানের এই সোনার একটি অংশ বাংলাদেশে বাকি সোনা বিভিন্ন পথে ভারতসহ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে পাচার হয়।
সোনা বা গোল্ড একটি মৌল পদার্থ। যা মূলত গাঢ় হলুদ, নরম ও অত্যন্ত ঘন ধাতু। সোনার লাতিন নাম ধঁৎঁস, যার অর্থ দীপ্তপূর্ণ বস্তু। বিশ্বের বৃহত্তম বাণিজ্যিক উপাদান হিসেবে সোনা বিবেচিত। একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি-অবনতিও সোনার ওপর নির্ভর করে। এ কথা অনেকেরই জানা আছে, সোনা মজুদের ওপর নির্ভর করে একটি দেশের মুদ্রার মূল্য নির্ধারণ করা হয়। দেশে দৈনিক ১০ কোটি টাকার সোনার বাজার যার বার্ষিক চাহিদা প্রায় ২১ টন। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, দেশে মোট সোনার সামগ্রী তৈরিতে ৬০ শতাংশ তৈরি হয় নতুন সোনায় আর ৪০ শতাংশ পুরনো সোনা ব্যবহৃত হয়। পৃথিবীতে উৎপন্ন সোনার প্রায় তিন-চতুর্থাংশ অলঙ্কারে ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও ইলেকট্রনিক শিল্পে ১০-১৫ শতাংশ বাদ বাকি সোনা ওষুধ ও দন্ত চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়ে থাকে। পৃথিবীর যেসব দেশে বেশি সোনা মজুদ রয়েছে তাদের মধ্যে এক নম্বরে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সে দেশে ৮ হাজার ১৩৩ টন সোনা মজুদ আছে। দ্বিতীয় স্থানে জার্মানি ৩ হাজার ৩৮৪ টন, তৃতীয় স্থানে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএফএম), এরপর রয়েছে ইতালি, ফ্রান্স, রাশিয়া, চীন, সুইজারল্যান্ড। অস্ট্রেলিয়া বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম সোনা উৎপাদনকারী দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সোনার খনির দেশ। তবে এক শ বছরেরও বেশি সময় আগে, বিশ্বের সর্ববৃহৎ সোনা উৎপাদনকারী দেশ ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর দুই হাজার টনের বেশি সোনা উত্তোলন করা হয়। বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতি সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ১০ হাজার সোনার দোকান রয়েছে। বর্তমানে দেশে সোনা ক্রয়-বিক্রয়ের বড় বাজার রাজধানীর পুরান ঢাকার তাঁতীবাজার। তাঁতীবাজার এলাকায় ব্যবসায়ীরা সাধারণ মানুষদের কাছ থেকে কোনো ধরনের কাগজপত্র ছাড়াই সোনা কেনেন। এই সোনাই আবার সারা দেশের ব্যবসায়ীরা ক্রয় করেন, যা চলে যায় দেশের বিভিন্ন এলাকায়। ঢাকার বড় বড় জুয়েলারি প্রতিষ্ঠানও তাঁতীবাজার এলাকা থেকে সোনা কিনে নেয়।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, চোরাই পথে আনা সোনায় নির্ভর করে চলছে দেশের সোনা ব্যবসা। দেশে অদ্ভুত উপায়ে আসছে সোনা। অনেক ঘটনার একটি হলো শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এক যাত্রীর কাছ থেকে আনুমানিক ৬০ লাখ টাকার ১২টি সোনার বার উদ্ধার করা হয় যার ওজন ১ কেজি ২০০ গ্রাম। হাঁটাচলায় অস্বাভাবিকতা দেখে তার শরীর এক্স-রে করা হলে পায়ুপথে তিনটি অস্বাভাবিক পুঁটলি দেখা যায়। তারপর শুল্ক গোয়েন্দাদের উপস্থিতিতে পায়ুপথে বিশেষ কায়দায় লুকানো তিনটি কনডমের ভেতরে চারটি করে মোট ১২টি সোনার বার পাওয়া যায়। অবিশ্বাস ব্যাপার হলো, মানুষ জীবনের কত বড় ঝুঁকি নিয়ে সোনার চালানে জড়িত। বাংলাদেশে সোনার
চাহিদার বড় অংশ পূরণ হয় যাত্রীদের ব্যাগেজে আনা সোনায়। প্রবাসীরা বা সাধারণ যাত্রীরা দেশে আসার সময় যে পরিমাণ সোনা নিয়ে আসেন তার প্রায় অর্ধেকই বিক্রি করে দেন। এনবিআরের হিসাবে, ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি খুলে হিসাব মতো রাজস্ব পরিশোধ করে বৈধভাবে সোনা আমদানি করে ব্যবসা করলে সরকারি কোষাগারে বছরে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা জমা হওয়ার কথা। সোনার মতো সম্ভাবনাময় খাতে রমরমা ব্যবসা হলেও সরকারি কোষাগারে জমা পড়ছে নামমাত্র রাজস্ব।
আশ্চর্যজনক খবরটি হলো, গত ১০ বছরে বৈধভাবে এক তোলা সোনাও আমদানি হয়নি। তার মানে চোরাই সোনা দিয়েই চাহিদা মেটানো হচ্ছে দেশের গ্রাহকদের। এই অবৈধ ব্যবসার জন্য দায় শুধু চোরাচালানকারীদের কেন হবে, সরকারের নয় কেন? অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অবৈধভাবে আমদানির জন্য দু’ধরনের সমস্যা হচ্ছে হুন্ডির মাধ্যমে দেশের অর্থ পাচার হচ্ছে এবং বিপুল অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। তাহলে সরকার কেন বৈধ পথে সোনা আমদানির সুযোগ না দিয়ে চোরাই পথকে উৎসাহিত করছে। বোধকরি এ বিষয়ে আমলাসহ নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর দায়িত্বশীলরা নিজেদের স্বার্থে সরকারকে সঠিক তথ্য দিচ্ছে না। জনগণের প্রত্যাশা বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে সরকার সোনা চোরাচালানের হোতাদের ধরবে। রাষ্ট্রায়ত্ত বিমান সংস্থাকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিয়ে সোনা ও মাদক চোরাচালান সামাল দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হোক।
সোনা সম্পর্কে সম্প্রতি একটি ভালো খবর জানা গেল। বৈদুতিক বর্জ্যকে কাজে লাগিয়ে সোনা তৈরির পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন কানাডার সাসকাটচেওয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর স্টিফেন ফলি। বলা হয়েছে, বর্তমানে সারা বিশ্বে এক বছরে ৫০ মিলিয়ন টনেরও বেশি বৈদ্যুতিক বর্জ্য পদার্থ হয় যার ৮০ শতাংশ আর কোনো কাজে লাগে না। প্রফেসর ফলি বাতিল কম্পিউটর চিপস ও সার্কিটকে এক বিশেষ তাপমাত্রা ও পরিবেশে অ্যাকোয়া রেগিয়া নামক নাইট্রিক অ্যাসিড ও হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিডের দ্রবণে বিশেষ পদ্ধতিতে মিশিয়ে সোনা তৈরি করেছেন। এক কিলোগ্রাম সোনা তৈরিতে ১০০ লিটার অ্যাকোয়া রেগিয়ার দ্রবণ লাগে বলে জানিয়েছেন প্রফেসর ফলি। তবে তিনি গোপন রেখেছেন দ্রবণে ব্যবহার করা কাঁচামালের পরিমাণ, তার গুণাবলি ও দ্রবণের মিশ্রণগুলোর পরিমাপ। ধারণা করা হচ্ছে, স্টিফেন ফলির এই দাবি স্বীকৃতি পেলে তা পৃথিবীর অন্যতম যুগান্তকারী আবিষ্কার হিসেবে বিবেচিত হবে।
লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক ও উন্নয়ন গবেষক [email protected]
পিডিএসও/হেলাল