মীর আব্দুল আলীম
সমাজ
অনৈতিকতা বনাম ভোলারাম
রাজধানীর বনানীর ‘দ্য রেইনট্রি’ হোটেলে দুই ছাত্রীকে আটকে রেখে ধর্ষণের ঘটনায় হইচই পড়ে গেল দেশে। আমাদের দেশে এমনই হয়। কোনো কিছু ঘটলে সজাগ হই আমরা, আর তা নিয়ে হম্বিতম্বি, তার পর চুপসে যাওয়া বেলুনের মতো সব শেষ। বাঙালি তো এমনই ভোলারাম। সব ভুলে যায় কদিনের মাথায়। তারপর চুপেচাপে পার পেয়ে যায় অপরাধীরা। আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করে আবার বীরদর্পে চলা শুরু করে। অপকর্ম করা তার কাছে আরো সহজ হয়। এই তো হচ্ছে দেশে। যেখানে বিচারহীন সংস্কৃতির চর্চা আছে সেখানে এমনটাই হওয়ার কথা। রাজধানীর বনানীর ঘটনায়ও তার ব্যতিক্রম হবে না।
দেশে প্রতিদিন গড়ে ১৮ বছরের কম বয়সী এক দশমিক সাত শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। জরিপই বলে দেয়, দেশে ১৮ ঊর্ধ্ব নারী ধর্ষণ আর নির্যাতনের পরিমাণ কত। সমাজে প্রতিনিয়ত ধর্ষণ ও নির্যাতনের ঘটনা বেড়েই চলেছে। নিত্যই ব্যভিচার ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। রোধ হচ্ছে না। যৌন নির্যাতন করছে কলেজশিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ডাক্তার, কর্মচারী, পুলিশ, আত্মীয়, চাচা-মামা-খালু, দুলাভাই, আমলা, ধনীর দুলাল। কেউ বাদ যাচ্ছে না। ধর্ষণের শিকার হচ্ছে ছাত্রী, শিশু, যুবতী, আয়া, বুয়া, গৃহবধূ। রাস্তাঘাটে, রেস্তোরাঁয়, গাড়িতে, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে, গৃহে ঘটছে এই পৈশাচিক ঘটনা। কোথাও আজ নারীরা নিরাপদ নয়।
অপসংস্কৃতি আর ভিনদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসন আমাদের সমাজকে কতটা ক্ষত-বিক্ষত করছে তা হাল আমলের ধর্ষণের চিত্র দেখলেই টের পাওয়া যায়। বাসের ভেতরে ধর্ষিত হচ্ছে মেয়েরা, শিক্ষাঙ্গনে যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে শিক্ষার্থীরা, এমপির কথিত এপিএসের দ্বারাও এদেশে ধর্ষিত হচ্ছে যুবতী। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া দুই ছাত্রীকে জন্মদিনের অনুষ্ঠানের কথা বলে বনানীর রেইনট্রি হোটেলে ডেকে নেওয়া হয়। সেখানে তাদের দুজনকে আলাদা আলাদা কক্ষে আটকে রেখে রাতভর ধর্ষণ করা হয়। শুধু ধর্ষণ নয়, ধর্ষণের ঘটনা ভিডিও চিত্রে ধারণ করা হয়। ভিকটিমরা তাদের ভয়ভীতি দেখালে তারা পরিবারের সঙ্গে আলাপ আলোচনার ভিত্তিতে বনানী থানায় মামলা করতে যায়। মামলা গ্রহণে পুলিশ প্রথমে টালবাহানা করে, এমনকি ওই ভিকটিমদের অপরাধী প্রমাণের চেষ্টা করে। তাদের চরিত্র খারাপ বলে প্রমাণের চেষ্টা করে। মেডিক্যাল টেস্টের নামে থানায় আটকে রাখা হয়। অপরাধীরা ধনাঢ্য এবং প্রভাবশালী পরিবারের সদস্য হওয়ায় অনেকের মনেই যথেষ্ট সন্দেহ দানা বাঁধে যে, অতীতের কোনো কোনো অপরাধ ঘটনার মতোই এই ধর্ষণ ঘটনাও ধামাচাপা পড়ে যাবে। কিন্তু ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করা এই ঘটনায় সোশ্যাল মিডিয়ার চাপে একটা পর্যায়ে মামলা হয়। পুলিশ আসামিদের আটক করতে গড়িমসি করে। মিডিয়া সোচ্চার হয়, মিডিয়া জানায় আসামিরা সিলেটে আছে। একটা পর্যায়ে শেষ পর্যন্ত সিলেটে দুই ধর্ষককে আটক করে পুলিশ। যেকোনো অপরাধের মামলায় আসামি গ্রেফতার হবে এবং বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াবে এটাই আইনের বিধান। কিন্তু ঘটনা ঘটার পর মিডিয়ায় আলোড়ন সৃষ্টি করে, মানুষ রাস্তায় নেমে দাবি জানানোর পর পুলিশ তৎপর হবে। এটা গ্রহণযোগ্য নয়।
আইন যাই থাকুক না কেন আমাদের সমাজের অতি-রক্ষণশীলতা এবং পারিবারিক সমস্যাকে গোপন রাখার চেষ্টা ধর্ষণকারীদের শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে বিরাট অন্তরায়। যৌননির্যাতন তথা ব্যভিচার সব যুগে সব ধর্মমতে নিকৃষ্টতম পাপাচার। তন্মধ্যে মুসলিম ধর্মগ্রন্থ আল কোরানের বিভিন্ন সূরার বিভিন্ন আয়াতে মহান আল্লাহ ব্যভিচার সম্পর্কিত পাপের ভয়াবহতা ও এর কঠিন পরিণতি সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে মানবজাতিকে সাবধান হতে বলেছেন। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘তোমরা ব্যভিচারের ধারেকাছেও যেও না, কারণ এটা একটা অশ্লীল এবং জঘন্যপনা।’ বিশেষজ্ঞদের মতে, ধর্ষণের এই ব্যাপকতার পেছনের অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে, ইসলামী মূলবোধ মেনে না চলা এবং অপরাধীর শাস্তি না হওয়া। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্লিপ্ততা ও তাদের অপতৎপরতাও দায়ী। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে যথেষ্ট শক্তিশালী আইন থাকা সত্ত্বেও নির্যাতনকারীরা বিভিন্ন উপায়ে পার পেয়ে যায়। বাংলাদেশের আইন ভারতের চেয়েও শক্তিশালী। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩)-এর ৯(১) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে তবে সে যাবজ্জীবন কারাদ-ে দ-িত হবে। একই আইনের ৯(২) ধারায় আছে, ‘ধর্ষণ বা ধর্ষণ পরবর্তী কার্যকলাপের ফলে ধর্ষিত নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটলে ধর্ষকের মৃত্যুদ- বা যাবজ্জীবন কারাদ- হবে।’ একই সঙ্গে জরিমানার কথাও আছে। সর্বনিম্ন জরিমানা এক লাখ টাকা। ৯(৩) ধারায় আছে, ‘যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে এবং উক্ত ধর্ষণের ফলে কোনো নারী বা শিশু মারা যায়, তাহলে প্রত্যেকের যাবজ্জীবন কারাদ- বা মৃত্যুদ-, কমপক্ষে এক লাখ টাকা জরিমানা হবে।’
যারা উচ্চবিত্ত, সমাজের ওপর তলার মানুষ, এই জাতীয় বিপদ তাদের ছুঁতে পারে কম। এ দেশে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে নি¤œবিত্ত আর মধ্যবিত্তরাই বেশি। যারা নিম্নবিত্ত বাসিন্দা, তারা সম্ভবত এখনো ধর্ষণকে স্বাভাবিক জ্ঞান করে। ভয়ে চুপ থাকে। ইজ্জত হারিয়েও মুখ খোলে না। তারা ধারণা করে, আইন আদালত করলে তাদের ভাগ্যে উল্টো বিপত্তি ঘটবে। অন্যায় করে অপরাধীরা এভাবে পার পেয়ে যাচ্ছে বলেই দেশে ধর্ষণ বেড়ে গেছে। বর্তমানে আমরা ঈমান শক্তি হারিয়েছি। অনৈতিক আচরণ, যৌন কামনা ইত্যাদি নেতিবাচক চেতনা আমাদের অন্ধ করে ফেলেছে। তাই সমাজ থেকে সুখ, শান্তি বা আনন্দ হারিয়ে যাচ্ছে। নিঃশর্ত ভালোবাসা বা ভক্তি কমে যাওয়ার কারণে আমাদের গঠনমূলক মনোভাব বা সৃষ্টিশীলতা নষ্ট হচ্ছে। এ কারণে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি শ্রদ্ধার পরিবর্তে আমাদের ভোগের মনোভাব সৃষ্টি হচ্ছে। অনিয়ন্ত্রিত যৌন কামনার প্রভাবে আমাদের মধ্যে ধর্ষণ, জেনা, পরকীয়া প্রেম ইত্যাদির প্রবণতা বাড়ছে। পার্শ্ববর্তী ভারতে ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে হইচই পড়ে যায়। এ ব্যাপারে আমাদের দেশের জনগণ একেবারেই নীরব। সচেতন কম। প্রতিবাদ হয় না। হলেও খুবই সামান্য।
লেখক : সাংবাদিক, গবেষক ও কলামিস্ট
"