রায়হান আহমেদ তপাদার

  ২৮ মে, ২০১৭

আন্তর্জাতিক

ইরান : অনেকের কাছেই ঈর্ষণীয়

ইরানের বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি ও স্বাধীনচেতা পররাষ্ট্রনীতিই পশ্চিমাদের কাছে ঈর্ষণীয় হওয়ার মূল কারণ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। সম্প্রতি ইসলামী বিপ্লবের ৩২তম বার্ষিকী উপলক্ষে ইরানে উদ্যাপিত হয়েছে দেশটির সাফল্য, আবিষ্কার ও উদ্ভাবনবিষয়ক প্রদর্শনী। গত ৩২ বছরে ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা শক্তিগুলোর নানা বাধা ও নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও সৃষ্টিশীলতার মন্ত্রে উজ্জীবিত ইরানি জাতি এবং বিশেষ করে এর যুব প্রজন্ম বিজ্ঞান, চিকিৎসা ও অর্থনীতিসহ অন্য অনেক ক্ষেত্রে অসাধারণ অনেক সাফল্য অর্জন করেছে। এ উপলক্ষে প্রতি বছরের মতো এবারও ইরানে আলোকোজ্জ্বল দশ প্রভাত বা ঐতিহাসিক পয়লা ফেব্রুয়ারি থেকে ১১ ফেব্রুয়ারিতে বিপ্লবের প্রতি সর্বস্তরের জনগণের অঙ্গীকার নবায়নের পাশাপাশি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসহ সামরিক, অর্থনৈতিক, শিল্প ও অনেক ক্ষেত্রে ইসলামী ইরানের সাম্প্রতিক অগ্রগতির কিছু নিদর্শন তুলে ধরা হয়। একই সময়ে চালু করা হয় বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প। সাফল্যের দিক থেকে এসব প্রকল্প ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও দর্শনীয়। লেজার প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ইরানি বিশেষজ্ঞদের সাফল্য তুলে ধরার জন্য গত ৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ৮ ফেব্রুয়ারি তেহরানে এক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। চিকিৎসা, কৃষি, মহাকাশ, আবহাওয়া ও সামরিক শিল্পসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে লেজার প্রযুক্তির রয়েছে ব্যাপক ব্যবহার। এ প্রদর্শনীতে ইরানের লেজার প্রযুক্তি সংক্রান্ত জাতীয় কেন্দ্রের পরিচালক ডক্টর জামশিদ বলেছেন, ইরান বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের লেজার-রশ্মি তৈরিতে মধ্যপ্রাচ্যে প্রথম এবং এশিয়ায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। এক্ষেত্রে এশিয়ায় প্রথম স্থানটি রয়েছে জাপানের দখলে।

এদিকে তেহরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সীমিত করার ব্যাপারে ছয় বিশ্বশক্তির সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের পর প্রথমবারের মতো ইরানে পার্লামেন্ট ও বিশেষজ্ঞ পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ইরানের পার্লামেন্ট বা মজলিশের নির্বাচন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হলেও এবার বিশেষজ্ঞ পরিষদের নির্বাচনটিকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে ২৫ বছর পর ইরানের সর্বোচ্চ নেতার পরিবর্তন হতে পারে এবং নতুন সর্বোচ্চ নেতা মনোনীত হতে পারেন। আর সর্বোচ্চ নেতা নির্বাচনের চূড়ান্ত ক্ষমতা রয়েছে বিশেষজ্ঞ পরিষদের হাতে। এদিকে আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুমোদনের ক্ষেত্রে ব্যাপক ক্ষমতার কারণে পার্লামেন্ট নির্বাচনের দিকেও চোখ রয়েছে আন্তর্জাতিক বিশ্বের।

প্রতি আট বছর পরপর নির্বাচনের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞ পরিষদের জন্য ৮৮ জন ধর্মীয় নেতাকে বেছে নেওয়া হয়। এ বিশেষজ্ঞ পরিষদের সদস্যরাই সাংবিধানিক ক্ষমতাবলে ইরানের সর্বোচ্চ নেতাকে বাছাই করে থাকেন এবং পর্যবেক্ষণে রাখেন। পরিষদ চাইলে সর্বোচ্চ নেতাকে উৎখাতও করতে পারে। তবে মজার ব্যাপার হলো গত তিন দশকের মধ্যে ইরানে মাত্র দুজন সর্বোচ্চ নেতাকে মনোনয়ন দিয়েছে বিশেষজ্ঞ পরিষদ। অন্যদিকে ১৯৮৯ সালে, ইরানের প্রথম সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির মৃত্যুর পর আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে নির্বাচন করে বিশেষজ্ঞ পরিষদ। আর সে সময় থেকে এখন পর্যন্ত তিনি সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে বহাল আছেন। তবে খামেনির বর্তমান শারীরিক অবস্থার কারণে পরবর্তী বিশেষজ্ঞ পরিষদকে নতুন সর্বোচ্চ নেতা মনোনীত করতে হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। বর্তমানে আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির বয়স ৭৬ বছর। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে খামেনির দেহে অস্ত্রোপচার হয়। তার প্রোস্টেট ক্যানসার হয়েছে এবং শারীরিক অবস্থা বর্তমানে খুব একটা স্থিতিশীল নেই বলে গুঞ্জন রয়েছে। আর সেদিক থেকে ইরানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণের ক্ষেত্রে নতুন বিশেষজ্ঞ পরিষদ সদস্যদের ভূমিকা থাকতে পারে। কারণ, সর্বোচ্চ নেতা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে তারাই চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী।

আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির ইসলামী সরকারের তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করেই বিশেষজ্ঞ পরিষদের ভূমিকা নির্ধারিত হয়ে থাকে। বিশেষজ্ঞ পরিষদের সদস্যরা উৎখাত না করলে আজীবন মেয়াদ পান সর্বোচ্চ নেতা। যদিও বিশেষজ্ঞ পরিষদের সদস্যরা সর্বোচ্চ নেতাকে নিয়োগ দিয়ে থাকেন, তারপরও বলা যায় তার বিশাল ক্ষমতা রয়েছে। এক কথায় বলতে গেলে একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কারো কাছে জবাবদিহি করার ব্যাপারে তিনি দায়বদ্ধ নন। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা নানাবিধ আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক ক্ষমতার অধিকারী। এর মধ্যে আছে, বিচারিক প্রতিষ্ঠান, নিরাপত্তাবাহিনী এবং রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের নেতৃত্ব ঠিক করে দেওয়া এবং ১২ সদস্যের গার্ডিয়ান কাউন্সিলের ৬ জুরিকে নিয়োগ দেওয়া। গার্ডিয়ান কাউন্সিল বা অভিভাবক পরিষদ ইরানের প্রেসিডেন্ট প্রার্থীসহ সব প্রার্থীর যোগ্যতা বিবেচনা করে ও যাচাই বাছাই করে। অভিভাবক পরিষদ ইরানের পার্লামেন্টে পাস করা আইনগুলো পর্যালোচনা করে থাকে। এছাড়া সকল জাতীয় ইস্যুতে হস্তক্ষেপ এবং নির্বাহী আদেশ জারির ক্ষমতা রয়েছে গার্ডিয়ান কাউন্সিলের। আর গার্ডিয়ান এ জবাবদিহিতাবিহীন পরিষদের অর্ধেক সদস্য মনোনয়নের ক্ষমতার কারণে সর্বোচ্চ নেতার ক্ষমতা কতটুকু তা ধারণা করাই যায়। ইরানে পার্লামেন্ট নির্বাচন কেন গুরুত্বপূর্ণ? এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে চার বছরের জন্য মজলিশ বা পার্লামেন্ট সদস্যদের বেছে নেন ইরানিরা। মজলিশের সদস্যদের আইন প্রণয়ণের পাশাপাশি প্রেসিডেন্টের ব্যাপারে অনাস্থা প্রকাশের ক্ষমতা রয়েছে। ইরান সরকারের ওপর পার্লামেন্টের কী ভূমিকা রয়েছে তা পরিমাপ করা এক অর্থে খুব কঠিন। একদিকে রাষ্ট্রীয় বাজেট নিয়ন্ত্রণ আবার সরকারের মন্ত্রীদের নিয়োগের কাজটি করে থাকে পার্লামেন্ট। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন সরকারের সমালোচনা করার একটি অন্যতম ভেন্যুও পার্লামেন্ট। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চুক্তির অনুমোদনও পার্লামেন্ট থেকে নিতে হয়। ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে সমালোচনা শুরুর পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট আশাবাদ জানিয়ে বলেছিলেন, দেশটির নীতিমালায় পরিবর্তন আসবে।

ইরানের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হলো সাংবিধানিকভাবে ইসলামী সরকার ব্যবস্থা থাকার পরও এদেশটি বরাবরই মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদবিরোধী, যা সাধারণত মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্র থেকে ভিন্ন। ঐতিহাসিকভাবেই ইসলামী ভাবাপন্ন সরকার বরাবরই মার্কিন মদদপুষ্ট ও মার্কিনিদের তল্পীবাহক। আর ইরানের বর্তমান ধাঁচের সরকার ব্যবস্থা মূলত সৃষ্টি হয়েছে মার্কিন-ইসরায়েলি তাঁবেদার রেজাশাহ পাহলভীর বিরুদ্ধে বিপ্লব ঘটিয়ে। যার ফলে এই সরকার ব্যবস্থায় বরাবরই মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদবিরোধী দেশগুলোর মধ্যে একটি বিশেষ জায়গা দখল করেছে। এই সুবাদে আজ ইরানের সঙ্গে ল্যাটিন আমেরিকা ও উত্তর কোরিয়ার মতো সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর অত্যন্ত মধুর সম্পর্ক বিদ্যমান। ইরানের গণতন্ত্র এবং এর মাত্রা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তোলেন।

প্রত্যেক দেশের অধিকার আছে নিজ নিজ জাতীয় স্বার্থে সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার। চীনে যেমন আছে কম্যুনিস্ট শাসিত একমাত্র রাজনৈতিক দল। কোন দেশের গণতন্ত্র উত্তম এ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে বলতে হয়, পৃথিবীর কোনো দেশের গণতন্ত্রই উত্তম নয়। সবার ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে। যেকোনো দেশের সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে হলে প্রথমেই সেই দেশের ইতিহাস এবং সেই দেশের সংস্কৃতি ও সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের বিশ্বাসকে আমলে নিতে হয়। পৃথিবীর সব দেশেই একই ধরনের সরকার ব্যবস্থা থাকবে- এটা কখনই আশা করা যায় না আর গণতন্ত্রের ফেরিওয়ালা হওয়ারও কারো প্রয়োজন নেই, যদিও আমেরিকার নেতৃত্বে বিশ্বের কতিপয় দেশ স্বেচ্ছায় গণতন্ত্র রফতানি করার দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছে। অথচ সেই আমেরিকাতে গণতন্ত্র তো নেই-ই, বরং বলা যায় ধনতন্ত্র এবং মাফিয়াতন্ত্র বিদ্যমান। বিশেষ করে গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল বিশ্বকে সে বার্তাই পৌঁছে দিয়েছে।

ইরান নিয়ে তাদের মাথাব্যথার মূল কারণ ইরানের পরমাণু কর্মসূচি, ইরানের বৈজ্ঞানিক উন্নতি ও ইরানের স্বাধীনচেতা পররাষ্ট্রনীতি। পশ্চিমাদের শত অবরোধ ইরান থোড়াই কেয়ার করে যেভাবে উন্নতি করছে তা অনেকের কাছেই ঈর্ষণীয়। তাছাড়া পশ্চিমারা ইরানের এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে নিষ্ঠুর অবরোধ আরোপ করেনি। তারপরও মহাকাশ, পরমাণুসহ মহাকাশে স্যাটেলাইট ও বানর পাঠানো, সামরিকসহ বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইরানের বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি ঈর্ষণীয়! ইরানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্র ইইউ শত শত অবরোধ আরোপ করেও ইরানকে দমাতে পারেনি। পারেনি সাদ্দামকে লেলিয়ে দিয়েও। আসলে একটা বিপ্লবী জাতিকে দমানো সম্ভব নয় যদি তারা দৃঢ়তা বুকে নিয়ে ইমানি দায়িত্ব পালন করে। তাও আবার সে দেশ যদি হয় ইরানের মতো কোনো ঐশ্বর্যশীল ও উঁচু সভ্যতার অধিকারী। পশ্চিমাদের অভিযোগ ইরান পরমাণু বোমা বানাচ্ছে যদিও এর সপক্ষে তারা বছরের পর বছর ধরে অনুসন্ধান চালিয়েও প্রমাণ হাজির করতে পারেনি।

ধরা যাক ইরান পরমাণু বোমা বানাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া, চীন, ভারত, পাকিস্তান ও ইসরায়েলের যদি পারমাণবিক অস্ত্র থাকতে পারে, ইরানের কেন নয়? ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যে বিষয়গুলো সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে তা হলো অর্থনীতি, পরমাণু কর্মসূচি ও আমেরিকা-ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক। তবে ইরানে প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতা লক্ষ করা যায় যে, কে কতটা আমেরিকা ও ইসরায়েলবিরোধী। ইসরায়েলবিরোধী বাস্তবসম্মত হলেও আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক বিষয়ে প্রেসিডেন্ট প্রার্থীরা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে মন্তব্য করেন এবং প্রত্যেক প্রেসিডেন্ট প্রার্থীই জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের বিরোধী। পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে পাশ্চাত্যের সঙ্গে ইরানের বিরোধ কারো অজানা নয়, আর এজন্য ইরানকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে পাশ্চাত্যের ও জাতিসংঘের আরোপ করা কঠিন অর্থনৈতিক অবরোধ। তবে কোনো প্রার্থী এ পর্যন্ত পরমাণু কর্মসূচি বন্ধ করার কথা বলেননি। নতুন প্রেসিডেন্ট কিভাবে পাশ্চাত্যের চাপিয়ে দেওয়া অবরোধ মোকাবিলা করে পরমাণু কর্মসূচি চালিয়ে যান-তা দেখার বিষয়।

লেখক : কলামিস্ট ও যুক্তরাজ্য প্রবাসী

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist