আহমেদ কামাল

  ২৪ মে, ২০১৭

শিক্ষা

কোচিংনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা

বর্তমানে আমাদের দেশে শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা যেমন বেড়েছে, তেমনি লাগামহীন বেড়ে চলেছে প্রাইভেট টিউশনি। অভিভাবকরা শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট টিউশনির জন্য কোচিং সেন্টারের পেছনে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেও অনেক সময় আশানুরূপ ফল পাচ্ছেন না। দেশে সোনার হরিণ নামক ভালো একটা চাকরি পেতে হলে পরীক্ষার ফলও ভালো করতে হবেÑএটা নিশ্চিত। এই চিন্তা থেকেই অভিভাবকরা ছেলেমেয়েকে প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে পড়তে পাঠান। বিশেষ করে স্কুল-কলেজে পড়াশোনায় তেমন ভালো ফল লাভ করতে না পারলে তো কথাই নেই। বাংলাদেশে প্রাইভেট টিউশনের প্রচলন বহু পুরনো। মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার আগে দেখা যায়, স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারাও প্রাইভেটে পড়ানো শুরু করে দিয়েছেন। এর কোনো নেতিবাচক দিক আছে কি?

অনুসন্ধানে জানা যায়, দেশের আনাচেকানাচে ব্যাঙের ছাতার মতো অসংখ্য কোচিং সেন্টার গড়ে উঠেছে। পাশাপাশি রয়েছে প্রাইভেট টিউটরদের দৌরাত্ম্য। পত্রিকার পাতা খুললেই দেখা যাবে, পড়াতে চাই কিংবা গৃহশিক্ষক আবশ্যক ইত্যাদির চমকপ্রদ বিজ্ঞাপন। যা সাধারণের চোখ এড়িয়ে যাবে না, যেতে পারে না। ১৭ বছর বয়সী তরুণ-তরুণীর মধ্যে প্রতি চারজনে তিনজন স্কুলজীবনে অন্তত একবার প্রাইভেট টিউটরের সাহায্য নিয়েছে। আর এ কারণেই এ বছর ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজের এসএসসি পাস করা শিক্ষার্থীর মা লুৎফা বেগম বলেন, ক্লাস নাইন থেকে দুটি মেয়েকে টানা কোচিং করিয়েছি। প্রতি মাসে শুধু এ জন্যই খরচ হয়েছে ২০ হাজার টাকা। গোল্ডেন জিপিএ-৫ পাওয়া মেয়ের এই সাফল্যের কৃতিত্ব স্কুলের নয়, কৃতিত্ব আমাদের, কৃতিত্ব কোচিংয়ের। তাহলে দেখা যাচ্ছে, বর্তমান সমাজে উচ্চবিত্তদের কাছে বেহিসাবে টাকা খরচ করে কোচিং ও গৃহশিক্ষক রাখাটা কোনো ব্যাপারই নয়, বরং আভিজাত্যের প্রতীক। সকাল, বিকাল ও রাতের শিফটে বিভিন্ন বিষয়ের জন্য বিভিন্ন শিক্ষক খোদ শিক্ষার্থীদের বাসায় চলে আসেন শিক্ষাদানের জন্য। অথচ শিক্ষার্থীদের পড়ার চাপে দম ফেলারও ফুরসৎ থাকে না। কিন্তু সমস্যা হয় মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্তদের। যুগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ও চাকরির বাজারের কথা চিন্তা করে কম খেয়ে না খেয়ে সন্তানের জন্য প্রাইভেট শিক্ষক রাখেন তারা। অনেকে পাঠান কোচিং সেন্টারে। দেখা যাচ্ছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্কুলের শিক্ষক ও শিক্ষিকারাই শিক্ষার্থীদের বাসায় গিয়ে প্রাইভেট পড়িয়ে থাকেন। বেতন কম বলে জীবিকার তাগিদে অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকা প্রাইভেট টিউশনির দিকে ঝুঁকেছেন। অনেকের কাছে আবার টাকাটাই মুখ্য। আর এর ফলেই ক্লাসের পড়ার দিকে শিক্ষক-শিক্ষিকা ও শিক্ষার্থী উভয়েরই মনোযোগ কমে যাচ্ছে দিনে দিনে। এদিকে সকাল নেই বিকেল নেই পড়তে পড়তে ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত থাকে শিক্ষার্থীরা। নবম শ্রেণির ছাত্র সিয়ামের প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে। সে প্রাইমারি স্কুলে পড়াশোনায় খুবই ভালো ছিল। কিন্তু হাইস্কুলে এসে অবস্থাটা বদলে যায়। একটু সংকোচের সঙ্গেই জানায় সিয়াম। আর তখনই মা-বাবা প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে তার পড়ার ব্যবস্থা করেন। দেখা যাচ্ছে, অন্য সহপাঠীরা যখন অবসর সময়ে খেলাধুলায় ব্যস্ত, সিয়ামকে তখন মুখবুজে অঙ্ক বুঝতে হয় অথবা ফিজিক্স। অবশ্য সপ্তাহে তিন দিন এবং এক ঘণ্টার জন্য। দেখা যায়, শতকরা ১৫ শতাংশ ছাত্রছাত্রী প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে নিয়মিত পড়ে। আরো দেখা যায়, বর্তমানে শিক্ষকদের মধ্যে পূর্বের ন্যায় সততা বোধ নেই। কালের বিবর্তনে আজ তাতে ফাটল ধরেছে। শিক্ষা নিয়ে চলছে রাজনীতি। শিক্ষকরা রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছেন। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থেকে দাপট দেখিয়ে নিজের দায়িত্ব যথাযথ পালন করছেন না। এতে শিক্ষার্থীরা প্রকৃত শিক্ষা লাভে বঞ্চিত হচ্ছে আর রয়ে যাচ্ছে সুদূরপ্রসারী ক্ষতির সমূহ সম্ভাবনা।

আরো জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্কের ছাত্র মিশুক মুবারক একজন প্রাইভেট শিক্ষক। ১০ বছর ধরে এই দায়িত্বটি হাতে নিয়েছেন মিশুক। ইদানীং হাইস্কুলে পড়ার চাপ খুব বেড়ে গেছে। বিশেষ করে অঙ্কের মতো কঠিন বিষয়টিকে পাশ কাটানো একেবারেই সম্ভব নয় বলেই মিশুকের মতো শিক্ষকের চাহিদা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। মাসিক ও বার্ষিক চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের জন্য দৈনিক খবরের কাগজে, ইন্টারনেটে বা বিভিন্ন ইনস্টিটিউশনের মাধ্যমে পাওয়া যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এই তরুণ শিক্ষকদের। টিউশনি বাবদ মিশুকের প্রত্যেক দিনের আয় ৬০০ টাকা। বেশিরভাগ ছাত্রকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন বলেই কিছুটা কম রাখেন তিনি। অঙ্কে পাস করা বা অবসরপ্রাপ্ত অন্য কোনো অঙ্কের শিক্ষক হলে ১২০০-১৫০০ টাকা কমে শিক্ষাদানে রাজি হতেন না তিনি। এ হিসেবে, দেশে প্রতিবছরে আড়াই থেকে তিনশ’ কোটি টাকা কোচিং বা প্রাইভেট শিক্ষার জন্য ব্যয় হয়। যার ফলে দেখা দেয় বিরাট এক বৈষম্য। শরীফ উবায়েদউল্লা একসময় শিক্ষার্থীদের বাসাবাড়িতে গিয়ে প্রাইভেট টিউশনি করাতেন। আর এখন তিনি একটি কোচিং সেন্টার চালান। প্রথমেই তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, প্রাইভেট টিউশনির প্রয়োজন কেন? তিনি জানালেন, আমি আগে প্রাইভেট টিউটর হিসেবে কাজ করেছি এখন একটি কোচিং সেন্টার চালাই। এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য কোচিং দেওয়া হয় শিক্ষার্থীদের। সারাদেশে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেয় চার লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী। আর সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সব মিলিয়ে কোনো অবস্থাতেই ৩০ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হতে পারে না। ভর্তির জন্য প্রতিযোগিতা এখানে খুবই তীব্র। এত বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থী কোথায় ভর্তি হবে? এরা সবাই কি পড়াশোনা বন্ধ করে সমাজের বোঝা হয়ে বসে থাকবে? আর এদের প্রতিযোগিতায় টিকিয়ে দিতে আমরা ছাত্রছাত্রীদের যোগ্য হতে কোচিংয়ের মাধ্যমে সাহায্য করি। যেন তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে। এজন্যই আমি মনে করি, এ ধরনের কোচিংয়ের প্রয়োজন রয়েছে। অথচ বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, গত বছর লক্ষাধিক ছাত্রছাত্রী জিপিএ-৫ পেয়েও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগের ভর্তি পরীক্ষায় মাত্র দুজন শিক্ষার্থী পাস করতে পেরেছিল। এ ব্যাপারে অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, জিপিএ-৫ পেয়ে ভালো শিক্ষার্থীর তকমা নিলেও জ্ঞান অর্জনের দিক থেকে পিছিয়ে আছে তারা। যারা জিপিএ-৫ পেয়েছে এবং তাদের যেটা শেখার কথা তারা সেটা শেখেনি। তার মানে হচ্ছে, শিক্ষার্থীরা যে জিপিএ-৫ পাচ্ছে, এটা সত্যিকারের জিপিএ-৫ নয়। তাদের হাতে জিপিএ-৫ তুলে দেওয়া হচ্ছে মাত্র। এখন শিক্ষার প্রকৃত গুণগত মানটা যদি বাড়ানো না হয়, শুধু সংখ্যা বৃদ্ধি করে আসলে কোনো লাভ হবে না। আর এ অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে, শিক্ষার মান বাড়বে না কেবল সংখ্যাই বাড়বে। তাহলে দেখা যাচ্ছে কোচিংয়ে শিক্ষা বছরের শুরু থেকেই পাঠ্যবইয়ের চ্যাপ্টারগুলোকে সামারাইজ করে ছোট আকারে শেখানো হয় নাম্বারের দিকে তাকিয়ে। এতে শিক্ষার্থীর জ্ঞান তো বাড়ছেই না মেধাও বাড়ছে না, শুধুই মেধার অপচয় হচ্ছে। আর এর প্রভাব পড়েছে চাকরির ক্ষেত্রেও। যেসব শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়ে পাস করেছে, চাকরির ইন্টারভিউ বোর্ডে তাদের ফল ভালতো হচ্ছেই না সঙ্গে চরম হতাশার জন্ম দিচ্ছে আগামী ভবিষ্যতের।

অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, প্রখ্যাত শিক্ষাবিদরা স্কুলের পাশাপাশি এই ধরনের প্রাইভেট টিউশনি চলাকে খুব ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখেন না। তাদের মতে, শিক্ষা সিস্টেমের মধ্যেই কোথাও বড় রকমের গলদ রয়েছে। নয়তো মা-বাবারা অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করে ছেলেমেয়েদের প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে পাঠাবেন কেন? আর এই প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে অসচ্ছল পরিবারের ছেলেমেয়েরা। তার মানে হচ্ছে আর্থিক সঙ্গতির ওপর পরীক্ষায় ভালো ফল অনেকটা নির্ভর করছে। বেড়ে যাচ্ছে ধনী দারিদ্র্যের ফারাকটাও। তাই বাস্তবতার প্রয়োজনে এমন এক যুগোপযোগী শিক্ষাপদ্ধতি তৈরি করতে হবে, যাতে প্রাইভেট টিউটরের আর প্রয়োজন হবে না। স্কুলের তরফ থেকেই দুর্বল শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় সহায়তা করতে হবে। এক্ষেত্রে ডে-স্কুলের ব্যবস্থা করা যায়। দুর্বল শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ ক্লাস ও হোম টাস্কে সহায়তা দেওয়ার ব্যবস্থাও করা যেতে পারে।

ইউরোপের অন্যান্য দেশে সমস্যাটা আরো প্রবল। দক্ষিণ ইউরোপীয় দেশগুলোয় প্রাইভেট টিউশনির প্রচলন অনেক বেশি। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোয় শিক্ষকরা তো আর্থিক দিক দিয়ে প্রাইভেট টিউশনির ওপর অনেকটা নির্ভরশীল। অন্যদিকে ফ্রান্সে ডে স্কুলের প্রচলন থাকলেও প্রাইভেট শিক্ষকের কিন্তু কমতি নেই। জার্মানির চেয়ে বরং বেশি। জার্মানিতে শিক্ষকদের বেতন ভালো, তাই তাদের রুটিরুজির জন্য অতিরিক্ত আয়ের পথ না খুঁজলেও চলে। কলেজ ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা এক্ষেত্রে তৎপর। টিউশনির টাকা দিয়ে নিজেদের পড়াশোনার খরচ দিব্যি চালিয়ে নেন অনেকে। তাই পুরো ব্যাপারটিই বেশ জটিল। কিছু অভিভাবকের সন্তানকে নিয়ে অসুস্থ

প্রতিযোগিতার জন্য আজ এ অবস্থা। তারা বিদ্যালয়ের পড়াশোনাকে কোনো গুরুত্ব দেন না। তারা সুশিক্ষা নয়, জিপিএ-৫-এর পেছনে দৌড়েন। তাদের এ বিশ্বাস আবার অন্য সন্তানদের মধ্যেও ঢুকিয়ে দেন। এমন বাস্তবতায় শিক্ষার্থীরা শিক্ষার গুনগতমান নিশ্চিত করতে, তারা যেন মুখস্থের পরিবর্তে পাঠ্যবইকে শুরু থেকে শেষ অবধি পড়তে এবং পাঠ্যবইয়ের বাইরেও অন্যান্য বই পড়তে উৎসাহিত হয়, সে ব্যাপারে আশু ব্যবস্থা গ্রহণপূর্বক সারা বিশ্বে এই সমস্যার সুরাহার জন্য রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, শিক্ষক ও অভিভাবক সবাইকে জোরাল ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে বলে মনে করেন শিক্ষাবিদরা।

লেখক : সাংবাদিক

e-mail: [email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist