ডক্টর শেখ সালাহ্উদ্দিন আহ্মেদ

  ২৩ মে, ২০১৭

সমাজ

বর্বরতার প্রকট রূপ

নারী নির্যাতনের ঘটনা দেশে অব্যাহতভাবে ঘটে চলা নৃশংসতা-বর্বরতারই প্রকট রূপ। এতে সামাজিক অবক্ষয় আর ক্ষয়িষ্ণু মূল্যবোধের সাক্ষ্য মেলে। ঘরে-বাইরে সমানতালে নারীরা যেভাবে ধর্ষণের শিকার হয়ে চলেছে তা অনাকাক্সিক্ষত ও অনভিপ্রেত। নারীরা আজকাল নানা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। বিশেষত যৌন হয়রানি বা ধর্ষণের মাত্রা সাম্প্রতিক দিনগুলোতে ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। গ্রামগঞ্জ, স্কুল-কলেজ, অফিসপাড়া সবখানেই নারীরা ধর্ষণের শিকারে পরিণত হচ্ছে ক্রমাগত।

সম্প্রতি রাজধানীর একটি হোটেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রীকে গণধর্ষণের ঘটনায় পুলিশের নিস্পৃহতার অভিযোগ উঠেছে। ঘটনার মামলা গ্রহণে পুলিশের গড়িমসির বিষয়টি মিডিয়ায় এসেছে। গত ২৮ মার্চ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রীকে জন্মদিনের অনুষ্ঠানের কথা বলে বনানীর রেইনট্রি হোটেলে ডেকে নেওয়া হয়। সেখানে তাদের দুজনকে আলাদা কক্ষে আটকে রেখে রাতভর ধর্ষণ করা হয়। শুধু ধর্ষণ নয়, ধর্ষণের ঘটনা ভিডিও করা হয়। ভিকটিমরা তাদের ভয়ভীতি দেখালে তারা পরিবারের সঙ্গে আলাপ আলোচনার ভিত্তিতে বনানী থানায় মামলা করতে যায়।

মামলা গ্রহণে পুলিশ প্রথমে টালবাহানা করে, এমনকি ওই ভিকটিমদের অপরাধী প্রমাণের চেষ্টা করে। তাদের চরিত্র খারাপ বলে প্রমাণের চেষ্টা করে। মেডিক্যাল টেস্টের নামে থানায় আটকে রাখা হয়। অপরাধীরা ধনাঢ্য এবং প্রভাবশালী পরিবারের সদস্য হওয়ায় অনেকের মনেই যথেষ্ট সন্দেহ দানা বাঁধে যে, অতীতের কোনো কোনো অপরাধ-ঘটনার মতোই এই ধর্ষণ-ঘটনাও ধামাচাপা পড়ে যাবে। কিন্তু ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করা এই ঘটনা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ার চাপে একটা পর্যায়ে মামলা হয়। এ ব্যাপারে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে।

পুলিশ আসামিদের আটক করতে গড়িমসি করে। এতে মিডিয়া সোচ্চার হয়। মিডিয়া জানায়, আসামিরা সিলেটে আছে। একটা পর্যায়ে শেষ পর্যন্ত সিলেট থেকে দুই ধর্ষককে আটক করে পুলিশ। যে কোনো অপরাধের মামলায় আসামি গ্রেফতার হবে এবং বিচারের কাঠগড়ায়

দাঁড়াবে-এটাই আইনের বিধান। কিন্তু ঘটনা ঘটার পর মিডিয়ায় আলোড়ন সৃষ্টি হলে, মানুষ রাস্তায় নেমে দাবি জানালে তারপর পুলিশ তৎপর হয়। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা আশা করি, তদন্ত কোনোভাবেই প্রভাবিত হবে না। এ দেশের প্রতিটি নাগরিকের আশাও তাই। পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়, এমন কাজ করা

যাবে না।

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতি মাসে ৩০০টিরও বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। প্রকৃত অর্থে এ সংখ্যা আরো বেশি হবে সংগত কারণে যে, গ্রামগঞ্জ এমনকি শহরেও অনেকেই লোকলজ্জার ভয়ে ধর্ষণের কথা প্রকাশ করতে চায় না। যেহেতু ধর্ষণের শিকার নারীটির ওপরই সামাজিকভাবে ঘৃণা বর্ষিত হয় বেশি। এমনকি এজন্য ধর্ষিতার পরিবার-পরিজন কিংবা তার অভিভাবকদেরও সুনজরে দেখা হয় না বললেই চলে। তাই অনেকে ধর্ষণের শিকার হয়েও থানায় মামলা করেন না। আর থানায় মামলা দিতে গেলেও অনেক অনাকাক্সিক্ষত প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় ধর্ষিতাকেই। এরপর সাহস করে যারা ধর্ষণের মামলা থানায় বা আদালতে করেন তারা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন, অর্থাৎ সিংহভাগ খেতেই আসামি রাজনৈতিক বা অর্থের কারণে রেহাই পেয়ে যায়। এ ছাড়া ধর্ষণের মামলা তদন্ত করতে গিয়েও একশ্রেণির পুলিশ কর্মকর্তা ধর্ষিতাকেই নানাভাবে হেনস্থা করে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।

আসলে ধর্ষণ কোনো সাধারণ অপরাধ নয়। এটি একটি গর্হিত ও অমার্জনীয় অপরাধ। আমাদের প্রচলিত আইনে এ অপরাধের কঠোর শাস্তি রয়েছে। শরিয়া আইনেও ধর্ষণের অপরাধে মৃত্যুদ-ের মতো কঠিন শাস্তির বিধান বিদ্যমান। এই কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধের মাত্রা আমাদের সমাজে ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এর একটি মাত্র কারণ, ধর্ষকরা শাস্তির মুখোমুখি না হয়ে নানাভাবে ছাড়া পেয়ে যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক ও ক্ষমাহীন যে কারণটি হচ্ছে তা রাজনৈতিক।

এ কারণে খুন বা ধর্ষণের মতো অপরাধ করেও অনেকে বেঁচে যায়। ফলে এমন অপরাধ আমাদের সমাজে বেড়েই চলেছে। ধর্ষণের অপরাধীদের কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়াতে একশ্রেণির বিকৃত মানসিকতার মানুষ প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে মেয়েদের ইজ্জত-সম্ভ্রম লুটে নেওয়ার দুঃসাহস করে।

অথচ অপরাধীরা এটা ভাবে না যে, সমাজে তাদেরও মা-বোন-কন্যাদের চলাফেরা করতে হয়। স্কুল-কলেজ বা কর্মস্থলে যেতে হয় তাদের পরিবারের কোনো কোনো নারী সদস্যকে। তারা যদি ধর্ষণের মতো নিষ্ঠুর ও নির্মম ঘটনার শিকারে পরিণত হয়, তাহলে তাদের কেমন মানসিক পরিস্থিতি হতে পারে। আসলে এমনটি যদি কোনো ধর্ষক কখনো চিন্তা করে তাহলে হয়তো ধর্ষণের মতো এমন মারাত্মক অপরাধ সংঘটনের চিন্তাও তারা করত না।

আমরা জানি না, অপরাধীচক্রের এমন মানসিকতা কখনো সৃষ্টি হবে কি না! যারা ধর্ষণ বা খুনের মতো মারাত্মক অপরাধ করে তাদের বিবেকের মৃত্যু ঘটে। তারা মানুষ থাকে না। পশুতে পরিণত হয়। আর এদের প্রতিহত এবং নিরপরাধ নারীদের রক্ষা করতেই তৈরি হয়েছে কঠোর আইন। শরীয়া আইনেরও একই উদ্দেশ্য। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে যদি ধর্ষকদের বিচারের মুখোমুখি না করা যায়, তাহলে এমন অপরাধ দিন দিন বাড়বে বই কমবে না কখনই।

আমাদের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এমনিতেই নারীদের অনুকূলে নয়। নারী অধিকারের কথা তথাকথিত প্রগতিবাদীদের তরফ থেকে ফলাও করে প্রচার করা হলেও নারীসমাজ যাতে ধর্ষণের মতো অমানবিক পরিস্থিতির শিকার না হয়, সে ব্যাপারে সোচ্চার হতে তাদের দেখা যায় না।

আমরা মনে করি, ধর্ষকদের আইনানুগভাবে বিচারের মুখোমুখি করতে পারলেই আমাদের মেয়েরা সমাজে নিরাপদে নির্বিঘেœ চলাফেরা করতে যেমন সক্ষম হবে, তেমনই অপরাধের সংঘটকরাও অনেকটা ভীত-সন্ত্রস্ত থাকবে। বিশেষত ধর্ষণ বা খুনের মতো অপরাধ সংঘটনকারীদের যেন রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয় না দেওয়া হয়, সে বিষয়টি সম্পর্কে সজাগ থেকে তাদের আইনের হাতে তুলে দেওয়ার ব্যাপারে যতœবান থাকতে হবে সবাইকে।

নারী নির্যাতনের যে ক্রমবর্ধমান উন্মত্ততায় সমাজদেহ থরথর করে কাঁপছে, এর কঠোর প্রতিকার জরুরি। প্রশাসনের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের এ ব্যাপারে জবাবদিহির আওতায় আনাও জরুরি। একই সঙ্গে দরকার সম্মিলিতভাবে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা। মনে রাখা দরকার, সময় সমাজকে এগিয়ে দেয়। আর সমাজের হাত ধরেই এগিয়ে যায় দেশ। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রের যে দায়িত্ব, সে ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করে পুলিশ। জনগণের বন্ধু ও সেবক হিসেবে কাজ করে তারা। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় পুলিশের এই ভূমিকা খুঁজে পাওয়া কঠিন। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। অভিযোগ রয়েছে, অজ্ঞাত কারণে ধর্ষিতাকে সহযোগিতার বদলে তারা নানাভাবে ধর্ষকের পক্ষ নিয়ে থাকে। পুলিশের

বিরুদ্ধে থাকা এ অভিযোগ কঠোরভাবে মোকাবিলা না করলে ধর্ষণ কেন, সমাজে সব ধরনের অপরাধই ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকবে এবং তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। তার আগেই উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।

লেখক : অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও সভাপতি

সাউথ এশিয়ান ল ইয়ার্স ফোরাম এবং প্রধান সম্পাদক দৈনিক আজকের অগ্রবাণী

e-mail: [email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist