মো. কায়ছার আলী

  ২৩ মে, ২০১৭

ভূ-রাজনীতি

ঐতিহাসিক ছিটমহল

‘শক্তি নয়, ইচ্ছাই রাষ্ট্রের ভিত্তি’-টি এইচ গ্রিন। হবস, লক এবং রুশোর মতে, ‘চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে।’ প্রকৃতির নির্মম খেয়াল থেকে বাঁচার এবং একে অপরের জীবন, সম্পত্তি নিরাপত্তার জন্য পারস্পরিক চুক্তিতে উপনীত হওয়ার ফলে রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে। বিভিন্ন রাষ্ট্র, জাতি, উপজাতি, বর্ণ ও গোত্রে বিভক্ত কিন্তু সবার মূল পরিচয় মানুষ। তাই তো দেশে দেশে মানুষে মানুষে এত ভেদ-প্রভেদ থাকা সত্ত্বেও পরস্পরের প্রতি মমত্ববোধ চিরন্তন। মানবাধিকার, জননিরাপত্তাসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা একমাত্র রাষ্ট্র ছাড়া অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের নির্মমতার শিকার বা মুঘল আমলের রাজন্যবর্গের খামখেয়ালিপনার অথবা ক্ষমতার দ্বন্দ্বের প্রতীক হলো ছিটমহল।

অবিশ্বাস্য হলেও সত্য কুচবিহারের রাজা এবং রংপুরের মহারাজা তিস্তার পারে তাসখেলায় বাজি ধরতেন ছিটমহলের মালিকানা নিয়ে। তারা ছিলেন সামন্ত। ছিট শব্দের অর্থ খ- বা টুকরা। বিভিন্ন মহলকে একেকটি খন্ডে বিভক্ত করার পর এর নাম হয় ছিটমহল। ছিটমহল হলো রাষ্ট্রের এক বা একাধিক ক্ষুদ্র অংশ, যা অন্য রাষ্ট্র দ্বারা পরিবেষ্টিত। A Piece of territory surrounded by foreign dominion is Enclave. অর্থাৎ বন্দিত্ব বা দেশহীন মানুষের আবাসস্থল ছিটমহল।

ইতিহাস পাঠে জানা যায়, ষোড়শ শতাব্দীতে মুঘল সম্রাট শাহজাহানের হঠাৎ অসুস্থতার কারণে কুচবিহারের রাজা প্রাণনারায়ণ কামরূপের সুবেদার মীর লুৎফুল্লাকে আক্রমণ করে মুঘল সাম্রাজ্যের বেশ কিছু বাড়তি অংশের ওপর নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে আওরঙ্গজেবের নির্দেশে বাংলার সুবেদার মীর জুমলা বিশাল বাহিনী নিয়ে কুচবিহার আক্রমণ করেন এবং অধিকৃত মুঘল সাম্রাজ্যর হৃত অংশগুলো পুনরুদ্ধার করে রাজধানী কুচবিহারও অধিকার করে ফেলেন। পরে ইসফান্দিয়ার বেগকে কুচবিহারের দায়িত্ব দেন। রাজা প্রাণনারায়ণ পালিয়ে গিয়ে পরবর্তীতে স্বসৈন্য শক্তি সংগ্রহ করে পুনরায় রাজ্য উদ্ধার করেন। তখন থেকেই মুঘলদের সঙ্গে দফায় দফায় রাজার যুদ্ধ লেগেই থাকত, যা শেষ হয় ১৭৭২ সালে। কুচবিহারের রাজা হন শান্তনুনারায়ণ। তখন খাঞ্জা খাঁ কুচবিহারের বোদা, পাটগ্রাম এবং পূর্বভাগ-এই চাকলা তিনটি অধিকার করেন। রাজা বেনামে চাকলা তিনটি ইজারা নেন। অন্য ভূ-সম্পত্তি দ্বারা পরিবেষ্টিত হলেও মূলত এ তিনটি চাকলার অন্তর্ভুক্ত অঞ্চলগুলোই কুচবিহারের ছিটমহল। পরবর্তীতে বহু বছরব্যাপী খ- খ- যুদ্ধের ফলে কুচবিহার রাজ্যের বেশ কয়েকটি ভূ-খ-ে মুঘলদের দখলদারিত্ব কায়েম হয় এবং কালক্রমে এ অংশগুলো রংপুরের জমিদারির অধীনে চলে আসে, যা পরে রংপুরের ছিটমহল নামে পরিচিত। সেই ভূ-খ- মূল সম্পত্তির সঙ্গে এক লপ্তে (Stretch) নয় অথচ ঠিকই খাজনা আসত রাজা বা জমিদারের তহবিলে।

পলাশী যুদ্ধের পর ১৭৮৯ থেকে ১৮০০ সালে ইংরেজরা কৌশলে কুচবিহারের রাজাকে নিজেদের বশে আনে। সে প্রেক্ষাপটে প্রথমেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কুচবিহার রাজার নিকট হতে বোদা, পাটগ্রাম ও পূর্বভাগ-এই তিন চাকলা অধিকার করে এবং পুনরায় কুচবিহারের রাজার নিকট ফিরিয়ে দেয়। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান ভাগের সময় সমস্যা বাধে কুচবিহারকে ঘিরে। কুচবিহারের রাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণের কিছু জমিদারি স্বত্ব ছিল বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুর জেলার আওতাধীন। অপরদিকে রংপুর ও দিনাজপুরের জমিদারদের কিছু তালুক ও জোর ছিল কুচবিহার সীমানার মধ্যে। উভয়পক্ষ সমঝোতায় ব্যর্থ হওয়ায় বাংলাদেশের মধ্যে ভারতের এবং ভারতের মধ্যে বাংলাদেশের কিছু এলাকা পড়ে। দেশ বিভাগের মতো এত বড় জটিল কাজটি (৮ জুলাই ১৯৪৭ হতে ১৩ আগস্ট ১৯৪৭) ঝরৎ ঝরৎরষ জবফপষরভ অখ- ভারতের দীর্ঘদিনের স্থল ও জল যোগাযোগ ব্যবস্থা, সংস্কৃতি, সমন্বিত অর্থনীতি ও স্থিতি সম্পন্ন এলাকা ব্রিটিশ ভারতের পূর্ব-পশ্চিম দুই অঞ্চলের দুটি প্রদেশ বাংলা ও পাঞ্জাবকে মাঝ বরাবর ধরে ম্যাপের ওপর দাগ টেনে ভাগ করেন। সীমারেখা নির্ধারণী ঞড়ঢ় ঝযববঃ-এর মূলকপি ১৬ আগস্ট ১৯৪৭ সালে জনসম্মুখে প্রকাশ করা হলে বিতর্কের ঝড় ওঠে এবং সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাওয়ায় ছিটমহলবাসীর ১৬২টি ছোট-বড় ভূখ- অনিষ্পত্তি অবস্থায় রাখে, যার ফলে চরম দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়। পৃথিবীর মানচিত্রে এই অঞ্চলকে বিধ্বস্ত বলয় বলা হয়।

সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ছিল বলেই ছিটমহলবাসীর অবস্থা অত্যন্ত করুণ ও জটিল প্রকৃতির। নাগরিক অধিকার বঞ্চিত, নিপীড়িত অসহায় মানুষগুলো মেয়েদের সম্ভ্রমহানির ভয়ে সন্ধ্যা হলেই লুকিয়ে রাখত, শান্তিতে ঘুমাতে পারত না, হাসপাতালে গেলে ডাক্তার বাবুরা দেখত না, বলত দু’দিন পরে আস এবং গর্ভবতী মহিলাদের সন্তান জন্ম দানের সময় ভর্তি নিত না। কাজলা দীঘি ছিটমহলের বাসিন্দা হবিবর অসম্ভব মেধাবী ছোট মেয়েকে আত্মীয়স্বজনের সহায়তায় পরিচয় গোপন করে বাংলাদেশের একটি স্কুলে ভর্তি করায়। মেয়েটি এইচএসসি পরীক্ষায় এচঅ-৫ পেলে তার পিতৃ-পরিচয় জানাজানি হয়ে যায়। দেশি-বিদেশি সংস্থা মেয়েটির পড়াশোনায় সহযোগিতা করতে আগ্রহী হলে আইনগত সমস্যা দেখা দেয়। এই অবস্থায় মেয়েটিকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নিলে সে পড়াশোনা ছাড়তে চায় না এবং দিনরাত কান্নাকাটি করে। খাগরাবাড়ি সরকারপাড়া ছিটে সুরতন বেগমের জন্ম হওয়ায় বিয়ে হয়েছিল, কিন্তু শ্বশুরবাড়ি যাওয়া হয়নি। নিরুপায় বাবা চেরুমদ্দিন জামাই এনে ঘরে রেখেছিলেন। কোর্টভাজনী ছিটের স্বপন চন্দ্র রায় গোপনে বাংলাদেশে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পরও পুলিশের চাকরিতে উক্তীর্ণ হয়েও নাগরিকত্বের জটিলতায় চাকরি হয়নি এবং বর্তমানে তার চাকরির বয়স নেই। মনছুর আলী মিয়া বলেন, ১৯৬৬ সালে ৭ বছর আমরা গ্রাম থেকে বের হতে পারিনি। গ্রামে হকার আসত। আমরা গ্রাম থেকে বের হলেই ভারতের পুলিশ তাড়া করত। ১৯৯২ সালে শালবাড়ি ছিটমহলে শালবনের গাছ কেটে ফেলেছিল দুষ্কৃতকারীরা। এরপর তারা ধরা পড়লে উভয়পক্ষের মারামারিতে মারা যায় একজন, আহত হয় অনেক, ৫০০ বাড়িতে আগুন, নির্বিচারে লুটতরাজ, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহ বন্ধ, অবরুদ্ধ এবং সারারাত চলে নারী ধর্ষণ। ঘটনাগুলোর বিচার করা তো দূরের কথা তদন্ত পর্যন্ত হয়নি।

রেডক্লিফ রোয়েদাদ, বাউন্ডারি কমিশনের রিপোর্ট, নুন-নেহরু চুক্তি, ১৯৭৪ সালের ১৬ মে ইন্দিরা-মুজিব ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরের পরও দীর্ঘ ৬৮ বছর (তিনটি প্রজন্ম) বিচ্ছিন্ন ভূখ-ের অবহেলিত, নাগরিকত্বহীন মানুষেরা চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে মানবেতর জীবনযাপন করেছে, যাকে সোজা কথায় বলা যায়- সভ্য সমাজের এক কলঙ্ক তিলক। জাতিসংঘ সনদে চৎড়ঃড়পড়ষ ঃড় ঃযব ওহঃবৎহধঃরড়হষ ঈড়হাধহধহঃ ড়হ ঈরারষ ্ চড়ষরঃরপধষ জরমযঃ-এর ৪.৩ (৩) অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে, ‘রাষ্ট্র সবার আত্মবিকাশের সমান সুযোগ প্রদান করবে।’ অন্যত্র জোর দিয়ে বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেক শিশুর একটি জাতীয়তা লাভের অধিকার থাকবে।’ এ কথাগুলো এক দিন ছিল কাগজে আর কলমে, বাস্তবে নয়। বর্তমান শেখ হাসিনা সরকার ১৯৯৬ সালে ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির সূত্র ধরে নতুন করে কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করেন। ২০১১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং বাংলাদেশের সফরে এলে তখন একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেন। বাংলাদেশের পক্ষে ছিটমহল বিনিময় ও সীমানা নির্ধারণ সংক্রান্ত বিলটি (জলসীমানা পূর্বেই মীমাংসিত) ৬ সেপ্টেম্বর ২০১১ তারিখে মহান জাতীয় সংসদে পাস হয়। নরেন্দ্র মোদির সরকার ক্ষমতায় এলে ছিটমহলবাসীর দীর্ঘদিনের করুণ আর্তনাদ তার কর্ণগোচর হয়। অদৃশ্য সেই অভিশাপ বা সীমান্তরেখা গত ৭ মে ২০১৫ সালে ১১৯তম (প্রকৃতকক্ষে ১০০তম এবং স্বাধীনতা বা বিজয় দিবসের মতো) স্থলসীমান্ত চুক্তি সংক্রান্ত সংবিধান সংশোধনী বিল (ছিটমহল বিনিময়) ভারতের লোকসভায় ৩৩১ সদস্যের উপস্থিতিতে এবং সর্বসম্মতক্রমে পাস হয়। বাংলাদেশের মধ্যে ভারতের ১১১টি ছিটমহল (লালমনিরহাটে ৫৯টি, পঞ্চগড়ে ৩৬টি, কুড়িগ্রামে ১২টি, নীলফামারীতে ৪টি মোট ১৭ হাজার ১৬০.৬৩ একর ভূমি ও জনসংখ্যা ৩৭৩৮৬ জন) বাংলাদেশ পেল এবং ভারতের মধ্যে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল (কুচবিহারে ৪৭টি, জলপাইগুড়িতে ৪টি মোট ৭ হাজার ১১০.০২ একর ভূমি ও জনসংখ্যা ১৪০৯০ জন) ভারত পেল। বসবাসরতরা ইচ্ছানুযায়ী যে কোনো দেশের অভ্যন্তরেই থেকে যেতে পারলেন। এছাড়াও বাংলাদেশ ভারতের জোর করে দখল করে রাখা ২২৬৭.৬৮২ একর এবং ভারত বাংলাদেশের জোর করে দখল করে রাখা ২৭৭৭.৩৮ একর জমি- যার যা দখলে আছে সে তার মালিকানা পেল। তদুপরি নীলফামারী-পশ্চিমবঙ্গ, ফেনীর মুহুরী নদী-ত্রিপুরা, লাঠিটিলা ও ডুমাবাড়ী-আসাম সীমান্তে ৬.৫ কি.মি. অমীমাংসিত সীমারেখা স্থির করা হবে এবং তিন বিঘা করিডোর ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকবে। উৎসবমুখর পরিবেশে উভয় দেশের ১৬২টি ছিট মহলে দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ও স্থানীয় নেতাদের উপস্থিতিতে নাগরিকত্ব নির্ধারণ করা হয়েছে এবং হেড কাউন্টিং হালনাগাদ বা জনগণনা বা যৌথসমীক্ষার পর বর্তমানে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদানের কাজ চলছে। ৩১ জুলাই মধ্যরাত থেকে ১১১টি ছিটমহল বাংলাদেশের এবং ৫১টি ছিটমহল ভারতের অন্তর্ভুক্তি হলো অর্থাৎ উভয় দেশের মূল ভূখন্ডে পরিণত হলো। সীমান্তের এপারে এবং ওপারে (৩১ জুলাই এবং ১ আগস্ট) সূর্য উদয় এক নয়। ১ আগস্ট ২০১৫ সূর্য উদয় হয়েছিল স্বাধীনতার বা বিজয়ের আনন্দের মতো। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও গুরুত্ব পেয়েছিল ছিটমহল বিনিময়ের খবর। বিশ্ববাসী জানতে পেরেছিল, আমরা উভয় দেশ মিলেমিশে একসঙ্গে ভালো কাজ করতে পারি। উন্নত দেশ হলে

উভয় দেশ শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেত। পরিশেষে দুই

দেশের ছিটমহলবাসীর ২০১২ সালে সেই সম্মিলিত স্লোগান, ‘দাও নাগরিকত্ব, নয় মৃত্যু।’ ২০১৫ সালে এসে তা পূর্ণতা

পেল। তবে মৃত্যু নয়, বাঁচার স্বপ্ন নিয়ে। বর্তমানে জয় হয়েছে মানবিকতা, মূল্যবোধ এবং মনুষ্যত্বের। বর্তমান প্রজন্ম শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আলোর পথে এগিয়ে যাবে, সব

ধরনের নাগরিক সুবিধা ভোগ করবে। এজন্য যাকে ধন্যবাদ না জানালেই নয়, তিনি হলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যার বুদ্ধিমত্তার ফলে বাংলাদেশ ফিরে পেল তার হারিয়ে যাওয়া ছিটমহল।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist