ড. মাহবুব হাসান

  ২৮ মার্চ, ২০১৭

মতামত

এবার লক্ষ্য জাজিরাতুল আরব

গত সোমবার ম্যানহাটানের একটি ফেডারেল কোর্টে ‘লস্যুট’ করেছে ৯/১১-এর ক্ষতিগ্রস্ত ৮০০ ফ্যামিলি। তাদের দাবি, সেপ্টেম্বর মাসের ১১ তারিখে যে হামলাটি করেছিল ওসামা বিন লাদেনের সন্ত্রাসী দলটি, তাদের অর্থ, ট্রেনিং ও পাসপোর্ট দিয়ে সাহায্য করেছে সৌদি আরবের সরকার বা বাদশা। এই অভিযোগ তুলেই তারা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ক্ষতিপূরণ দাবি করেছে।

২০০১ সালের ওই হামলায় ম্যানহাটানের টুইন টাওয়ার ধ্বংস হয়েছিল। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার নামের বিল্ডিংটি ধসে পড়ে দুটি বিমানের হামলায়। আর মারা পড়ে সেখানে কর্মরত মানুষরা। সেই সকালে বেশি লোক অফিসে না পৌঁছালেও তাদের সংখ্যা নেহাত কম ছিল না। তিন হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। সেই অপরিমিত হত্যাযজ্ঞের ক্ষতিপূরণের মামলা করেছে ভিকটিম পরিবারগুলো ১৫ বছর পর।

ভিকটিম পরিবার থেকে যে অভিযোগ করা হয়েছে তার সত্যাসত্য নিয়ে আলোচনা করতে চাইছি না। কারণ এটি এখন বিচারাধীন। দ্বিতীয়ত, এটি আমেরিকার জন্য সবচেয়ে বিতর্কিত ও আলোচিত বিষয় ছিল এবং এখনো আছে। পুরনো ঘায়ে আঘাত করলে তা দ্বিগুণ জ্বলে ওঠে।

৯/১১-এর ভিকটিম পরিবারগুলো কি সেই ঘুমন্ত বা সারতে থাকা ঘায়ে নুনের ছিটে দেওয়ার মতো কোনো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা করল? কে বলতে পারে যেÑনা, এটা সে রকম নয়। কিংবা এটি সে-রকম মামলাই। এর কোনোটাই আমরা বলতে পারি না। কারণ যার গেছে সে-ই কেবল জানে কী গেছে, ক্ষতিটা কতটা মর্মবিদারী ও নির্মম।

আমি জেনেছি যে, ওই হামলায় বাংলাদেশের কয়েক তরুণ মারা গেছেন। তারাও গিয়েছিলেন সেদিন তাদের কাজের জায়গায়। ইনভেস্টিগেশনে নাকি বেরিয়ে এসেছে, ওই দিন ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের কর্মজীবীদের মধ্যে যারা ইহুদি, তারা কেউ সকাল ৯টার মধ্যে অফিসে যাননি। এটা শোনা কথা। এ-কথা প্রচারের মানে হচ্ছে ওই হামলার পেছনে ইহুদি ইসরায়েল জড়িত। তাই তারা ইহুদিদের সেখানে যেতে নিষেধ করেছিল। কিন্তু আল কায়দা তো ওসামা বিন লাদেনের সংগঠন। এটি সৃষ্টি হয়েছিল আফগানিস্তানে রুশ দখলদারিত্ব উৎখাতের উদ্দেশ্যে, আমেরিকার অর্থে, অস্ত্রে, ট্রেনিং ও সার্বিক তত্ত্বাবধানে। অনেক প্রাজ্ঞজন, ইনটেলেকচুয়াল এই অভিযোগ করেন যে, আমেরিকা যদি এই ধরনের অপকর্মগুলো না করে, তাহলে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বেচে যেত প্রতিবছর এবং সেই টাকায় পৃথিবীর দারিদ্র্যপীড়িত দেশগুলোর শিশুদের অন্ন-বস্ত্র-চিকিৎসা, বাসস্থান ও শিক্ষার ব্যবস্থা করা যেত। আর তাতে পৃথিবীর সংঘাতময় পরিস্থিতিরও অবসান হতো। আসলে এ-কথাগুলোও তর্ক-সাপেক্ষ। তর্কের ঊর্ধ্বে কিছু নেই এই আধুনিক যান্ত্রিক ও প্রযুক্তিনির্ভর জীবনে।

৯/১১-এর ধ্বংসাত্মক কাজের পেছনে যারাই থাক, বাস্তবতা হচ্ছে ওই ধ্বংস আমাদের নারকীয় ক্ষমতা লোভের আকাক্সক্ষাকেই প্রকাশ করেছে। যেমনÑদ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে এসে আমেরিকার পারমাণবিক বোমা হামলার পেছনে যুদ্ধ জয়ের চেয়েও এটাই প্রমাণ করতে চাওয়া হয়েছিল যে, ভবিষ্যতে যেন অন্য কোনো দেশ মাথা তুলতে না পারে।

প্রতিটি কাজের পেছনে আছে তার কার্যকারণ। কোনো একটা লক্ষ্যকে সামনে রেখেই সেই কাজের সূচনা হয়। আজ সৌদি আরবের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণের মামলা করার পেছনেও রয়েছে কিছু গূঢ় কারণ। ১৫ বছর পর কেন ভিকটিমদের মনে হলো যে, ওই হামলার পেছনে খোদ সৌদি রাজ পরিবার রয়েছে?

আমরা একটা সহজ ইকোয়েশন দাঁড় করাতে পারি। বর্তমান বিশ্ব রাজনীতির মূল মোটিভ হচ্ছে মুসলমানদের দমন। সেটা শুরু হয়েছে ১৯৯০ সালের পর থেকে। প্রফেসর স্যামুয়েল হান্টিংটন একটি সেমিনারের জন্য প্রবন্ধ লিখেছিলেন। সেটাই ১৯৯৪-৯৫ সালে প্রকাশ পায় বই আকারে, ‘দ্য ক্লাস অব টু সিভিলাইজেশন’ নামে। সেই বইয়ের মূল কথা হলো মুসলমানদের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বা কালচারাল প্রাগ্রসরতা। কোন সিভিলাইজেশনের সঙ্গে ক্ল¬্যাশ হবে সেটাও দেখানো হয়েছে গোটা বিশ্বের কালচারাল ডেভেলপমেন্ট ও সংঘাতের কারণগুলো চিহ্নিত করে। আফানিস্তানে সোভিয়েত দখলদারিত্ব, তাদের বিতাড়ন, ইরাকের ওপর নানা মিথ্যা অভিযোগ এনে দেশটিকে পুতুল সরকারের হাতে ছেড়ে দেওয়া, লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফিকে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে হত্যা ও দেশটি দখল করা, ইরানকে একঘরে করে তোলা এবং তাকে ধ্বংস করতে নানা কায়দা-কৌশল নেওয়া, সিরিয়াকে ধ্বংস করে তোলাÑসবকিছুই মুসলিম বিশ্বকে ধূলিসাৎ করারই এক মহাপরিকল্পনার অংশ। যে সৌদি আরবে মার্কিনি বন্ধুত্বের জোরে জাজিরাতুল আরবের একটি সমৃদ্ধ এলাকা দখল নিয়ে রাজতন্ত্র কায়েম করেছে এই আধুনিক জমানায় ব্রিটিশ ও আমেরিকা, সেই দেশটির বিরুদ্ধে আজ ক্ষতিপূরণের মামলা করার পেছনকার অন্তর্নিহিত কারণ কী?

কার্যকারণ ছাড়া আল্লাহর দুনিয়ায় কিছুই ঘটে না। মনে রাখতে হবে, মুসলমানদের ধর্মীয় কাজের মূল ভূমি সৌদি আরব আর কাবা সেখানে। ঠিক ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের মতোই কেন্দ্রমুখী লক্ষ করা হয়েছে অবশেষে। ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বিজয়ী করে আনা হয়েছে সেই লক্ষ্যেই। নাহলে তিরিশ লাখ ভোট কম পেয়েও আমেরিকার প্রেসিডেন্সিতে যে লোকটিকে বসানো হলো ইলেকটোরাল কলেজের মাধ্যমে, তার পেছনে কেবল তাদের গণতন্ত্রের অগণতান্ত্রিক ইলেকটোরাল কলেজই দায়ী নয়, এর পেছনকার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কারণও রয়েছে সচল। যে লক্ষ্যকে সামনে রেখে ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠন করা হয়েছিল, আর তারই ফাইনাল রাউন্ড চলছে এখন। গুরুতর অভিযোগ উত্থাপনের পেছনেও যে লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে, সেখানে পৌঁছাতে হলে অনেক রাজনৈতিক ও সামরিক পথ অতিক্রম করতে হবে। ট্রাম্পের পাঁচটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ তারই একটি ক্ষুদ্র পদক্ষেপ মাত্র। এর রাজনৈতিক টানাপড়েন চলতে চলতেই আরো অনেক রাজনৈতিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংকট সূচিত হবে। সেসব সংকটের উপরিকাঠামোতে প্রলেপ দেওয়ারও ব্যবস্থা হবে, কিন্তু ভেতরের ঘা থেকেই যাবে বিসুভিয়াসের মতো সুপ্তাবস্থায়।

সৌদি আরবের বিরুদ্ধে ৯/১১-এর অভিযোগ উত্থাপনের পেছনে যে অভিলাষ রয়েছে, তাকে মূর্ত করে তোলার জন্যই চলছে ব্রডওয়ে নাটকের মহড়া।

কয়েক বিলিয়ন ডলারের ক্ষতিপূরণ চেয়েছে ভিকটিম পারিবারগুলো। সে টাকাটা ট্রাম্প আদায় করবে সৌদি বাদশাদের কোষাগার থেকে। আমরা জানি, মার্কিনি পুতুল সৌদ পরিবারকে সেদেশের ক্ষমতা থেকে সরাবে না। কিন্তু সরিয়ে দেওয়ার মতো নানা কায়দাগুলো প্রদর্শিত হবে যাতে গণবিচ্ছিন্ন সৌদ পরিবার আমেরিকার কথাগুলো হৃদয়ে ধারণ করে এবং তাদের কথা মতো কাজগুলো করে দেয়। একেই বোধহয় বলে, কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার রাজনৈতিক খেলা।

সৌদি আরবের বাদশাদের দিয়েই মুসলমানদের পবিত্র কাবা নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা চালানো হবে বলে আমার মনে হচ্ছে। আলামত দেখে সেটাই যৌক্তিক মনে হতে পারে। সিরিয়ার বাশার আল আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের সংগঠিত এবং অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সাহায্য করে চলেছে যুক্তরাষ্ট্র। আজ সেই বিদ্রোহীদের দমনের ঘোষণা দিয়ে ট্রাম্প সে দেশে যুদ্ধ প্রলম্বিত করতে চায়। আর পুতুল হিসেবে আমেরিকার হয়ে সেই দায়িত্ব পালন করেছে সৌদি পরিবারের দায়িত্বপূর্ণ পদে বসে থাকা লোকেরা। এখনো তারাই বিদ্রোহীদের নানাভাবে সহায়তা করে চলেছে যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে। তারপরও সেই যুক্তরাষ্ট্রই বা ৯/১১-এর ভিকটিমদের দিয়ে ১৫ বছর পর মামলা করানোর কারণ একটাই, তাহলো ওই জনগণবিচ্ছিন্ন বাদশাহীর সম্পদ দখল করে নেওয়া ও তাদের নাচের পুতুল করে রাখা। ইহুদিরা যেমন জানে যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির হিটলার তাদের চিরতরে উৎখাত করে ‘ইহুদিমুক্ত বিশ্ব’ করতে চেয়েছিল, ওরা ছিল খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষ। খ্রিস্টানদের হাতে মার খেয়ে দেশ থেকে বিতাড়িত হয়েও সেই ইহুদি সম্প্রদায় তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়নি। বরং উল্টোটা করছে তারা। মুসলমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিয়েছে ইসরায়েল। তাদের বিশ্বাস করানো হয়েছে যে, ইহুদিদের ওই পরিণতির জন্য ইসলাম ও মুসলমানরা দায়ী। ইহুদিরা খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে গেল না কেন বা খ্রিস্টানদের হয়ে কেন তারা কাজ করছে!

সৌদ পরিবার উপরিকাঠামোতে মুসলমান মনে হলেও তারা মুহাম্মদ ইবনে আবদাল ওয়াহাবের ‘ওয়াহাবী মতবাদ’-এ বিশ্বাসী। আবদাল ওয়াহাব আবার সৌদ পরিবারের আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ। ওয়াহাবী চিন্তা বিপ্লবী হওয়ায় তাদের মূল চেতনা ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে ওঠে। তাই এই মতবাদের আশ্রয়দাতাদের কাজে লাগাচ্ছে মার্কিনি ক্ষমতাবানরা। মূলত ওয়াহাবীরা মিলিট্যান্ট। উপমহাদেশে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ওয়াহাবী আন্দোলন বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। সৌদি রাজপরিবার ওয়াহাবের পারিবারিক আত্মীয়তার সূত্রেগাঁথা। তারা ধর্মীয় গুরুর মতোই মান্য করে বলে তার মতবাদের ভেতরের বিষয়গুলো নিয়ে বসে আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য এদের দিয়েই ইসলামের কেন্দ্রভূমি পবিত্র কাবাকে করায়ত্ত করা। এই সাংস্কৃতিক ও সামরিক রাজনৈতিক যুদ্ধে জয় কে পাবে, তা বলার সময় আসেনি এখনো। বর্তমান বিশ্ব রাজনীতিতে এতটাই চোরা-স্রোত চলছে যে, কোনটা আসল আর কোনটা নকল বোঝা মুশকিল।

এই মুশকিল আসান কবে হবে তা কেউ বলতে পারে না। প্রিডিকশনও সম্ভব নয়। তবে ঘটমান বর্তমানের গতি-প্রকৃতি অনুসরণ করলে এবং এর বাহারি রং ও রূপ মনে রাখলে কার্যকারণের চেহারা উপলব্ধি করা সহজ।

লেখক : কবি ও কলামিস্ট, নিউইয়র্ক প্রবাসী

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist