মো. কায়ছার আলী

  ২৬ মার্চ, ২০১৭

পর্যালোচনা

গ্রিসের বেইল আউট : দৃশ্যমান পদ্মা সেতু

খ্রিষ্টপূর্ব ৮ম-৬ষ্ঠ শতকে প্রাচীন গ্রিস বিভক্ত ছিল ২০০টিরও বেশি নগর রাষ্ট্রে; যেমন-এথেন্স, স্পারটা, আরগোস, ডেলফি, থিবিস ইত্যাদি। নগরকেন্দ্রিক সরকার দ্বারা উন্নয়ন হলেও একে অপরের প্রতি নির্ভরশীল, কিন্তু তারা ছিল সার্বভৌম। হোমারীয় যুগে গ্রিকদের প্রধান পেশা ছিল কৃষিকাজ ও পশুপালন। ব্যঞ্জনবর্ণের সঙ্গে স্বরবর্ণ যুক্ত করে গ্রিকরা ২৪টি অক্ষরের বর্ণমালা সর্বপ্রথম উদ্ভাবন করে। ট্রয় নগরী ধ্বংস, জিউসের ইচ্ছায় পৃথিবীতে বৃষ্টিপাত বা অনাবৃষ্টির কাহিনি সেখানে প্রচলিত। প্রায় ১০০০ বছর পূর্বে তারা লৌহ নির্মিত দ্রব্যাদির উদ্ভব ঘটায় এবং ৪০০০ বছর পূর্বে প্রাচীন গ্রিসে এক মহান সভ্যতা গড়ে ওঠে। তারা বিজ্ঞান, শিল্প, স্থাপত্য, গণিত ও রাজনীতি, সাহিত্য, কলা, দর্শন শব্দের প্রথম ব্যবহার ও খেলাধুলায় (অলিম্পিক গেমসের প্রতিষ্ঠা ৭৭৬ খ্রিষ্টপূর্ব) বিশেষ খ্যাতি অর্জন করে। তারাই বিশ্বে সর্বপ্রথম রাষ্ট্রের ধারণা, ভোটাধিকার এবং গণতন্ত্রের চর্চা শুরু করে। এজন্য ইতিহাসের অভিধায় গ্রিসকে ‘ধ্রুপদী সভ্যতার দেশ’ বলা হয়। শুধু গণতন্ত্রের আঁতুড়ঘরই নয়, অর্থনৈতিক শৌর্যবীর্যেও ছিল বিশ্বসেরা। ইতিহাস আর ঐতিহ্যের আলোতে ভরপুর এথেন্স নগরী থেকে গ্রিক সভ্যতা ধীরে ধীরে মিসর, ইস্তাম্বুল, ইতালিসহ বিশ্ব দরবারে ছড়িয়ে পড়ে। খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩৮ অব্দে মহাবীর আলেকজান্ডার এক বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। দেশটি ১৪৬ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ রোম সাম্রাজ্যের অংশে পরিণত হয়। ১৪৬০ খ্রিষ্টাব্দে গ্রিস তুরস্কের দখলে যায়। ১৮২০ সালে অটোমান সাম্রাজ্য থেকে বেরিয়ে এসে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও রাশিয়ার ছত্রছায়ার স্বাধীন রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। ১৮২১-২৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রবল সংগ্রাম চালিয়ে গ্রিস স্বাধীনতা অর্জন করে ১৮২৯ সালে। ১৯৬৭ সালে রাজা দ্বিতীয় কনস্ট্যান্টিনোপল নির্বাসিত হলে গ্রিস স্থায়ীভাবে সাধারণতন্ত্রী রাষ্ট্র হয়। ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘের সদস্য পদ, অতঃপর নানা উত্থান-পতনের পর রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে ১৯৭৪ সালে গ্রিস প্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র হয়।

খ্রিষ্টপূর্ব ৫ম থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ২য় শতাব্দী পর্যন্ত গ্রিস উন্নতির সর্বোচ্চ শিখরে ওঠে। অথচ সেই প্রাচীন ঐতিহ্যের গ্রিসই সাম্প্রতিক সময়ে কাঁদে অর্থনৈতিক মহাসংকটের জাঁতাকলে পড়ে। গ্রিসের আছে সোনালি অতীত ইতিহাস, নেই শুধু অর্থনীতি। বিশ্বব্যাপী আলোচিত স্মরণকালের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সংকটের ঘটনা একটু শেয়ার করা যাক। ২০১০ সাল থেকেই গ্রিসের অর্থনৈতিক সংকটের সূত্রপাত। ২৯ লাখ লোকের পেনশনের পরিমাণ শতকরা ৪৫ ভাগ কমানো হয়, আইএমএফের পরামর্শ অনুযায়ী এবং ঋণের পরিমাণ ৩২০ বিলিয়ন ডলার-যা কিনা জিডিপির শতকরা ১৮০ ভাগ। অথচ কিছুদিন আগে এই ঋণের পরিমাণ ছিল জিডিপির ৬০ ভাগ, অর্থাৎ কৃচ্ছ্র সাধন করেও তারা ঋণের পরিমাণ কমাতে পারেনি। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে তাদের সপ্তাহব্যাপী ব্যাংকগুলো বন্ধ ছিল এবং ১০ লাখ লোক চাকরি হারিয়েছে। এই মুহূর্তে কর্মক্ষম গ্রিসবাসীর চার ভাগের এক ভাগ বেকার এবং দুই লাখ দেশত্যাগ করেছে। যাদের অধিকাংশই দেশে প্রকৌশলী, ডাক্তার অথবা আইটি সেক্টরে কাজ করতেন। উন্নত বিশ্বের দেশ হিসেবে গত ৩০ জুন দেশটি দেউলিয়া হিসেবে পরিগণিত হয়। কারণ দাতাদের ঋণের কিস্তি তারা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পরিশোধে অসমর্থ হয়। ইতোপূর্বে ২০০১ সালে আর্জেন্টিনা, জিম্বাবুয়ে ও সোমালিয়া দেউলিয়া রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল। শুধু গ্রিস নয়, কোনো না কোনোভাবে আমরা সবাই সারা পৃথিবীতে আজ ঋণের আবর্তে জর্জরিত। দাতা ও গ্রহীতার মধ্যে ছোট ছোট অক্ষরে যে শর্তগুলো জুড়ে দেওয়া হয় তার সংক্ষিক্ত নাম সুদ। যা পরিশোধের পথ অত্যন্ত কঠিন। ঋণ গ্রহীতা হতে পারে এক বা একাধিক ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা দেশ। শর্ত সাপেক্ষে সুদ কারো আসলে মাফ থাকে না। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কিস্তির মাধ্যমে সুদে-আসলে লোন ছাড়া ব্যাংককে তা পরিশোধ করতেই হয়। আর কিস্তি সময়মতো পরিশোধ না করলে কী পরিস্থিতিতে পড়তে হয় আজকের গ্রিসই তার একটি জ্বলন্ত বা বাস্তব উদাহরণ। মূলত ১৯৪৪ সালের বিশ্বব্যাংক প্রতিষ্ঠার পর থেকেই কাঠামোগত সাহায্য করে শর্ত সুপারিশমালার ভিত্তিতে যেমন-গ্রহীতা দেশের মুদ্রার অবমূল্যায়ন করা, সরকারি ব্যয় হ্রাস করা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্যসহ সেবামূলক খাত ও কৃষি খাতে ভর্তুকি হ্রাস করা, প্রকৃত মজুরি হ্রাস ও ঋণ সংকোচন, দাম নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার, জনসেবামূলক খাত, কৃষি উপকরণ, বিদ্যুৎ, রেলওয়ে বেসরকারিকরণ, উঁচু কর ও সুদের হার বাড়ানো, আমদানি অবাধ করা, মুক্তবাজার প্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদি। গ্রিসের বামপন্থী সরকার অনেক শর্ত মেনেও সেখানকার অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি করতে পারেনি। বেশ কয়েকবার কৃচ্ছ্র সাধন কর্মসূচি পার্লামেন্টে পাস হলেও তাদের অর্থনৈতিক ধস অব্যাহত থাকে। এদিকে গ্রিস সরকারের প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্সিস সিপ্রাস আন্তর্জাতিক ঋণ দাতাদের চূড়ান্ত সংস্কার প্রস্তাবের ওপর ৫ জুলাই ২০১৫ গণভোটের ঘোষণা দেয়। গণভোটে না ভোট বিজয়ী হয়। এ গণভোটের বা ন্যায়ের লড়াইয়ের মাধ্যমে দেশটির জনগণ ঋণ দাতাদের দেওয়া কঠোর কৃচ্ছ্র সাধনের শর্ত সংবলিত অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের প্রস্তাব (বেইল আউট) প্রত্যাখ্যান করে। বেইল আউট হলো কোনো দেশকে দেওয়া আর্থিক সহায়তা কর্মসূচির নাম। এ ব্যবস্থায় পুরনো হিসাব থাকলে নতুন অর্থ সহায়তা দেওয়ার আগে সেই পুরনো ঋণ পরিশোধ করার শর্ত থাকে, আবার তা না করেও নতুন ঋণ গ্রহণ করা যায় (যদি দাতারা চায়)। বর্তমানে গ্রিসকে তৃতীয় বেইল আউট প্যাকেজ দিয়ে সহায়তাকারী তিন পক্ষ আইএমএফ, ইসিবি ও ত্রয়ীকা নামে পরিচিত। দেশটির পরিস্থিতি বিবেচনা করে অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে পার্লামেন্টে সর্বশেষ অর্থনৈতিক সংস্কার প্রস্তাব ঋণদাতাদের কাছ থেকে ৮ হাজার ৬০০ কোটি ইউরো অনুমোদন করে। ঋণের সাগরে ভাসা গ্রিস ঋণের ভারে তলিয়ে যাবে অথবা ভেসে থাকবে অথবা শক্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে-তা কিছুদিনের মধ্যে পরিষ্কার হয়ে যাবে। আমরা বিশ্ববাসী চাই তাদের সুদিন ফিরে আসুক, যুবকদের কর্মসংস্থান হোক এবং বৃদ্ধদের পেনশন বাড়–ক। ব্যাংকগুলো সর্বদা চালু থাকুক, জ্ঞান-বিজ্ঞানের উজ্জ্বল জ্যোতিস্ক আলোকিত ও কিংবদন্তি মহান ব্যক্তিদের অমর, অক্ষয়, অবিনশ্বর আত্মা সর্বদা শান্তি পাক এবং আপামর জনসাধারণ ভালো থাকুক। অর্থাৎ, পুরাতন ঐতিহ্য ফিরে পাক সেই আশায় আমরা পথ চেয়ে রইলাম।

এ তো গেল গ্রিসের কথা। আমাদের স্বপ্নের বহুল প্রত্যাশিত পদ্মা বহুমুখী সেতুতে বিশ্বব্যাংকের ঋণ নিয়ে ইতোপূর্বে বিভিন্নœ কথাবার্তা হয় এবং ২০১৩ সালে বর্তমান সরকার অর্থ নেবে না বলে পরিষ্কার জানিয়ে দেয়। আবারও আরেক প্রভাবশালী ঋণদাতা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলকে ইসিএফের ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা লাগবে না বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। পদ্মা সেতু নির্মাণে বর্তমান সরকারের এক নম্বর চ্যালেঞ্জ বৈরী আবহাওয়া, প্রমত্ত পদ্মার ভয়াল ভাঙ্গন, সরু বালুকাময় উপেক্ষা করে রাত-দিন অর্থাৎ, তিন শিফ্টে অতি দ্রুত কাজ চলছে। বর্তমানে নদীর মধ্যে কয়েকটি পিলার এখন দৃশ্যমান। নদীর দুই পাশে সংযোগ সড়কের কাজও প্রায় শেষের দিকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আধুনিক ও স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে এক সময়ের নিঝুমপুরী মংলা বন্দর দীর্ঘ ১৮ বছর লোকসানের বোঝা টানার পর এখন লাভজনক প্রতিষ্ঠান হতে যাচ্ছে। দক্ষিণ-পশ্চিমের ২১ জেলা দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে নব দিগন্তের সূচনা করতে যাচ্ছে। পদ্মা সেতুর জন্য আমাদের প্রাণপ্রিয় জন্মভূমি, পিতৃভূমি ও মাতৃভূমি অর্থনৈতিক দিক থেকে সিঙ্গাপুরের চেয়েও শক্তিশালী হতে পারে। প্রায় ৩৫ হাজার কোটি ব্যয়ে আগামী বছরের শুরুতেই পদ্মা সেতুতে রেলপথ নির্মাণকাজ শুরু হবে। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের চেয়ে মংলা বন্দরের দূরত্ব ৯৫ কি.মি. কম অর্থাৎ, কাছের বন্দর। এ জন্য ভারত, নেপাল ও ভুটান পণ্য আমদানি-রফতানিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার মাওয়া ও শরীয়তপুরের জাজিরা পয়েন্টে চার লেনের ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ২২ মিটার চওড়া পদ্মা বহুমুখী সেতুর কাজ দেখতে এখন পদ্মার পারে মানুষের ঢল। আর বেশি দিন নয়, ২০১৮ সালের যেকোনো দিন পদ্মা সেতুর দ্বার খুলে দেওয়া হবে। আর সেই দিনটি হবে ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা একটি দিন।

লেখক : শিক্ষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist