রেজাউল করিম খান
আকাঙ্ক্ষা
স্বাধীনতা এবং স্বাধীনতার স্বপ্নরা
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য বাঙালির পূর্ব প্রস্তুতি ছিল না। অবশ্য মনে-মননে, চিন্তা-চেতনায় স্বাধীন হওয়ার আকাঙ্ক্ষা ছিল প্রবল। গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ ও ভাষা-সংস্কৃতির ওপর আঘাতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-বিক্ষোভে সেই প্রমাণ মেলে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ধনীর তালিকায় নাম লেখাতে থাকে, অচিরেই তারা বুঝতে পারে আবারও পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়েছে। বনেদি পরিবারের রাজনীতিকদের সঙ্গে এরাই মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমির দাবিতে আন্দোলন করেছে। পাকিস্তান চেয়েছে মনেপ্রাণে। কিন্তু দেশভাগের পরই পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি হিন্দু-মুসলমানকে বিজাতীয় ভাষা-সংস্কৃতি গেলাতে সচেষ্ট হয় পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী। ক্ষোভে ফেটে পড়ে ছাত্র-শ্রমিক-জনতা। শুরু হয় আন্দোলন। বায়ান্নর রক্তাক্ত ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর নির্বাচনে শাসক দল মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্টের অভূতপূর্ব বিজয়, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা, ঊনসত্তরের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের সাধারণ নির্বাচন, সবশেষে একাত্তরের
স্বাধীনতা সংগ্রাম।
সবাই স্বপ্ন দেখে। মধ্যবিত্তরা বোধকরি একটু বেশিই দেখে। তারা বড় হতে, উপরে উঠতে চায়। কিন্তু তাদের অধিকাংশই ভীতু, দোদুল্যমান, সুবিধাবাদী, আপসকামী। যে স্বপ্নের জাল বোনা হয়েছিল বায়ান্নর রাজপথে, একাত্তরে এসে তা বাস্তবে রূপ নিয়েছে। পঁচিশ বছর দর কষাকষি আর প্রস্তুতির পরিকল্পনায় কেটে গেছে। এই সময়ে বাংলায় বয়ে গেছে রক্তগঙ্গা। অবশ্য ঔপনিবেশিক শোষণ, বৈষম্য, নির্যাতন মানুষকে আরো ঐক্যবদ্ধ হতে সাহায্য করেছে। স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। কিন্তু কী ছিল সেই স্বপ্ন? পূর্ব বাংলার সিংহভাগ মানুষের ভাত-কাপড়ের সমস্যা তো ছিলই। চাহিদা ছিল বাসস্থানের, একটু চিকিৎসা আর সন্তানের সামান্য লেখাপড়া। সমস্যা ছিল মধ্যবিত্তেরও। ছিল উপরে ওঠায় নানা বাধা। গণতন্ত্র তখনো সাধারণ মানুষের নাগালে ছিল না, এখনো নেই। মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া শাসকের কাছে কেউ তা আশাও করে না। তবে রাজনীতি ছিল, ক্ষমতার রাজনীতি। ক্ষমতা একটি বিশেষ শ্রেণিকে টাকার জোগান দেয়, জন্ম হয়
পেশি শক্তির। আবারও ক্ষমতা প্রাপ্তির
লক্ষ্যে। মুক্তিযুদ্ধকালীন পূর্ববাংলার মানুষ
এমনটি ভাবেনি। সব শ্রেণি-পেশার মানুষ
তখন বিপন্ন ছিল। ছিল মৃত্যুভয়ে ভীত। এমনই এক বিপদসঙ্কুল পরিস্থিতিতে শত্রুর
বিরুদ্ধে যুদ্ধে গিয়ে জীবন দেওয়ার জন্য ঘর ছেড়েছিল লাখ লাখ কিশোর-তরুণ। তাদের অনেকেই বাড়ি ফিরে আসেনি আর। মায়ের কান্না থেমে গেছে। স্ত্রীও নিয়েছে বিদায়। স্বপ্নরা এখন শূন্যে ভেসে বেড়ায় এক দিগন্ত থেকে
অন্য দিগন্তেÍ।
ধর্মের নামে পাকিস্তান হয়েছে এ কথা ঠিক। কিন্তু বাংলা ভেঙে পূর্ব পাকিস্তান হওয়ার বিষয়টি ভিন্ন। বাংলায় সাধারণ মানুষের একটি ক্ষুদ্র অংশই ভারতবর্ষ ভেঙে পাকিস্তান চেয়েছে। নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা ও পূর্ববঙ্গের কিছু সংখ্যক মুসলমান ব্যবসায়ী-শিল্পপতির স্বার্থের কথা চিন্তা করেই খ-িত বাংলায় নাজিমুদ্দিন-আকরম খাঁসহ অন্যরা পাকিস্তানের পতাকা উড়িয়েছিলেন। ওই সময় কলকাতার বিভিন্ন কলকারখানায় কাজ করত পাঁচ লক্ষাধিক পূর্ববঙ্গীয় মুসলমান শ্রমিক। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্র দ্বিজাতি তত্ত্বে বিশ্বাসী পাকিস্তান আন্দোলনের নেতারা ওইসব শ্রমিকের কথা বিবেচনা করেননি। ভাবেননি কৃষকদের কথাও। অথচ সাধারণ মানুষ চেয়েছে বাংলাকে অখ- রাখতে। সমাজতন্ত্রীরা চেয়েছে সোসালিস্ট রিপাবলিক ঘোষণা করতে। শরৎ বসু ও আবুল হাসেমের মধ্যে এ ব্যাপারে সমঝোতাও হয়েছিল। কিন্তু কংগ্রেস-মুসলিম লীগের ইচ্ছাতে পাঞ্জাবের মতো বাংলাও ভাগ হয়ে যায়। একটি ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হবে জেনেও তারা ওই ঘৃণ্য কাজটি করেছিলেন।
১৯৬৯ সালে প্রেসিডেন্ট আইউববিরোধী আন্দোলনের সূত্রপাতের মধ্য দিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধিকার আন্দোলনের সূচনা হয়। মওলানা ভাসানীর আহ্বানে ছাত্র-জনতার তীব্র গণঅভ্যুত্থানে আইউবের পতন হয়। পরবর্তী দেড় বছরে প্রচারণা ও প্রচেষ্টা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের বৈষম্যের বিষয়টি তুলে ধরার। ওই সময়ের কারামুক্ত শ্রেষ্ঠ সংগঠক শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ফলে ’৭০-এর নির্বাচনে তার দল আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের ফল ছিল ভিন্ন। আইন যাই বলুক, পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা শেখ মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে রাজি ছিলেন না। নানা অজুহাতে সময় পার করা হচ্ছিল। বিষয়টি অনেকেই বুঝতে পেরেছিলেন। এমনই এক সময়ে মওলানা ভাসানী পশ্চিমাদের আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় জানান। সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রনেতারা শেখ মুজিবকে স্বাধীনতা ঘোষণার দাবি জানিয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সংগীত নির্বাচন করেন। এমতাবস্থায় দেশের মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর প্রতি অনাস্থা জানিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। ৭ই মার্চে শেখ মুজিবের ভাষণ আগুনের ওপর পেট্রল ঢেলে দেওয়ার মতো অবস্থা হয়। ততদিনে পাকিস্তানি সৈন্যরা পৌঁছে গেছে পূর্ব পাকিস্তানের জেলা শহরগুলোতে। ২৫ মার্চ ঢাকায় ব্যাপক গণহত্যার পরদিন থেকে শুরু হয়ে গেল প্রতিরোধ যুদ্ধ। ২৫ ফেব্রুয়ারি যে
বিজয় ছিল সহজ, একমাস পর তা হয়ে গেল অনেক কঠিন। দামও দিতে হলো অনেক। তো ১৯৭১ সালে যুদ্ধের আগে মানুষের দাবি ও প্রত্যাশা ছিল এক। যুদ্ধের সময় তা হয়ে গেল ভিন্ন। দীর্ঘদিন থেকেই পূর্ব বাংলার মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ-নির্যাতন থেকে মুক্তি চাইছিল। বস্তুত, এ সময় পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বৈষম্য ছিল চোখে পড়ার মতো। বিষয়টি সাধারণ মানুষ যতটা না বুঝতে পেরেছিল, তার চেয়ে বেশি বুঝেছিল বাঙালি শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা। প্রতিনিধি হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান যথার্থই ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন।
সুতরাং বাঙালি জাতীয়তাবাদের সূচনালগ্নে জনগণের মধ্যে যে চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সেই চেতনার কিছুটা রদবদল হয়। চিন্তা থেকে চেতনার জন্ম। এ সময় মানুষ চিন্তা করেছিল পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন। পৃথক হওয়া নয়, বরং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ মুজিবের ক্ষমতা গ্রহণ। সর্বোপরি সব বৈষম্য, শোষণ, বঞ্চনার অবসান। কিন্তু ২৬ মার্চ মানুষ পাকিস্তানি হায়েনাদের কবল থেকে মুক্তির চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে একটি অসম যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। যুদ্ধে বিজয় অর্জন করা সম্ভব হলেও সব শ্রেণি-পেশার মানুষ মুক্তি পায়নি। বিশেষ করে নির্যাতিত, নিপীড়িত শ্রমজীবী মানুষের মুক্তি মেলেনি। অবশ্য স্বাধীনতার পর যে শ্রেণির রাজনৈতিক দল বা সামরিক জান্তা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে, তাদের পক্ষে মুক্তি দেওয়া সম্ভব ছিল না। কারণ তারাই মুক্ত ছিল না। তবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ মানুষ ছিল তারা। এখন দায়িত্ব নিতে হবে অন্যদের। যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ। দায়িত্ব নিতে হবে দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক শক্তিকে। যারা কৃষক-শ্রমিক, নিপীড়িত, নির্যাতিত মানুষের মুক্তির দাবিতে রাজপথ কাঁপাতে পারে। তাদের সেই আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়বে প্রতিটি মেহনতি মানুষের ভাঙা ঘরের দরজায়। টগবগে তারুণ্যের উচ্ছ্বাস সেই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তার জন্য প্রয়োজন সুদক্ষ সেনাপতির। আমরা অপেক্ষায় থাকলাম।
লেখক : সাংবাদিক
ই-মেইল : [email protected]
"