এস এম মুকুল

  ২৪ মার্চ, ২০১৭

ভালোমন্দ

সমকালের কড়চা ২

জঙ্গিবাদ নাকি নিষ্ঠুরতা : গুলশানের হলি আর্টিজানের পর র‌্যাব-পুলিশের তৎপরতার মুখে জঙ্গিরা কিছুটা নিষ্ক্রিয় হলে জনমনে স্বস্তি ফিরে আসে। কিন্তু কয়েক মাসের ব্যবধানে আবারও জঙ্গি আতঙ্কে স্তব্ধ দেশের মানুষ। চট্টগ্রামের কর্নেলহাট, মিরসরাই, সীতাকুন্ড ও খিলগাঁওয়ে জঙ্গিদের পুনর্জাগরণের ঘটনায় তটস্থ সারা দেশ। জঙ্গিদের ফের মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার পাশাপাশি স্বল্প সময়ের ব্যবধানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর কয়েক দফা হামলা ঘটনায় সংশ্লিষ্ট প্রশাসনেও উৎকণ্ঠা ছড়িয়েছে। যদিও কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের ভাষ্য, জঙ্গিদের এখন আগের মতো শক্তিশালী নেটওয়ার্ক নেই। বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকার ভাড়া বাসায় জঙ্গি আস্তানা গড়ে তুলে নারী ও তরুণদের অস্ত্র চালানো, বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ এবং আত্মঘাতী হওয়ার কৌশল শেখানো হচ্ছে। ভয়ংকর নির্মমতার বিষয়-জঙ্গি মা-বাবার নিষ্ঠুরতার শিকার হচ্ছে শিশুরা। সীতাকুন্ডে জঙ্গি আস্তানায় দুই বছরের শিশুকে সঙ্গে নিয়েই জঙ্গি মা পুলিশকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছুড়ে মারার প্রাক্কালে পুলিশ গুলি ছুড়লে শিশুসহ মারা যায় সে। অপর এক জঙ্গি আস্তানায় নারী জঙ্গির সঙ্গে থাকা তিন মাসের শিশুকে নিয়েই সুইসাইডাল ভেস্ট বিস্ফোরণ ঘটাতে চাইলে আশপাশের মানুষ ধরে ফেলায় তার চেষ্টা ব্যর্থ হয়।

মন্তব্য : জঙ্গিবাদ একটি বৈশ্বিক বাস্তবতা-এ বিষয়টি মাথায় রেখেই জঙ্গি দমনে সব সময়ের মতো এবং আরো বেশি দক্ষতার পরিচয় দেবে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, জনগণ এমনটাই প্রত্যাশা করে। জঙ্গিবাদ বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে শুধু রাজনৈতিক নয়, অর্থনৈতিকভাবেও চরম হুমকির কারণ হতে পারে। ভাড়া বাসায় জঙ্গি তৎপরতা রোধে ভাড়াটিয়াদের মাঝে সচেতনতা বাড়াতে এলাকাভিত্তিক মনিটরিং ও টহল বাড়ানোর পাশাপাশি রেডিও, টেলিভিশন, মোবাইল, অনলাইন ও প্রিন্টমিডিয়ায় প্রচারণা বাড়ানো দরকার।

রাসায়নিকযুক্ত ডিম শনাক্তকরণ : অসাধু ব্যবসায়ী ডিমের পচন রোধ করার জন্য মানুষের জন্য ক্ষতিকর নানারকম রাসায়নিক পদার্থ মেশায়। রাসায়নিক মিশ্রিত এসব ডিম শনাক্ত করার সহজ ও ঘরোয়া পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে টাঙ্গাইলের সৃষ্টি কলেজ একাডেমির একাদশ শ্রেণির ছাত্র মুশফিকুর রহমান প্রিয়। তার প্রজেক্ট অনুযায়ী, প্রথমে ডিটারজেন্ট, আতর, শ্যাম্পু বা সাবান মিশিয়ে সুগন্ধিযুক্ত পানি তৈরি করতে হবে। সিদ্ধ করা ডিমকে সেই পানিতে ঘণ্টাখানেক ভিজিয়ে রাখতে হবে। ডিমটি যদি রাসায়নিক মিশ্রিত না হয়, তবে তাতে প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক ঘ্রাণ বজায় থাকবে। ডিমটি রাসায়নিক মিশ্রিত হলে সুগন্ধি পানির গন্ধ মিশে উদ্ভট গন্ধ তৈরি হবে।

ন্যাশনাল সায়েন্স কার্নিভালে বিষয়টি প্রদর্শন করে পুরস্কারপ্রাপ্তির পাশাপাশি প্রশংসা কুড়িয়েছে প্রিয়। তার লক্ষ্য, রাসায়নিকযুক্ত ডিম পরিহার করার ব্যাপারে মানুষকে সচেতন করা। মুশফিকুর রহমান প্রিয়র বাবা মোহাম্মদ ইব্রাহীম একজন ব্যবসায়ী ও মা মঞ্জু আরা নাজনীন টিচার্স ট্রেনিং কলেজের প্রভাষক। প্রিয়র ইচ্ছে, সে একটি ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠা করতে চায়; যেখানে বিজ্ঞান শিখতে ও জানতে আগ্রহী সবাই সহজে বিনামূল্যে গবেষণা করতে পারবে।

মন্তব্য : এই উদ্ভাবনের বাস্তবতা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কাজে লাগানোর বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। পাশাপাশি প্রিয়র এই উদ্ভাবনের জন্য অভিনন্দন এবং তার জন্য শুভকামনা।

সুপারবাগ ব্যাকটেরিয়া : ইদানীংকালের চিকিৎসাবিজ্ঞানের আশঙ্কার খবরটি হলো-রোগ নিরাময়ে অ্যান্টিবায়োটিক ক্রমেই জীবাণু দমনে কার্যকারিতা হারাচ্ছে। আমরা সচরাচর যেসব অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করি, তা মূলত ব্যাকটেরিয়া নামক অণুজীবের বিরুদ্ধে কাজ করে। একসময় বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করে পৃথিবী থেকে জীবাণুঘটিত রোগ একেবারেই নিশ্চিহ্ন করে ফেলা সম্ভব হবে। দুঃখজনক সত্যিটি হলো, অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে জন্ম নিয়েছে জীবাণুদের অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী হয়ে উঠার ক্ষমতা! ভাবতেও ভয় লাগে, বিশেষত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে অ্যান্টিবায়োটিকের অনিয়ন্ত্রিত, অপ্রয়োজনীয় ও ত্রুটিপূর্ণ ব্যবহারের পরিণতি ভয়ানক রূপ ধারণ করেছে। তার মানে অ্যান্টিবায়োটিকেও এখন ব্যাকটেরিয়া দমন হচ্ছে না। অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী এসব ব্যাকটেরিয়ার নাম দেওয়া হয়েছে ‘সুপারবাগ’। উদ্বেগের বিষয় অ্যান্টিবায়োটিকের প্রভাবে কিছু কিছু ব্যাকটেরিয়া জেনেটিক পরিবর্তনের মাধ্যমে নিজেদের এমনভাবে পাল্টে ফেলে যে অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতিতেই তারা নিজেদের বংশবিস্তার করতে সক্ষম হয়। এসব ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হলে প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে রোগ নিয়ন্ত্রণ করা অনেক কঠিন হয়ে যায় এবং রোগীর মৃত্যুঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। বিস্ময়কর তথ্য হচ্ছে, অপ্রতিরোধ্য এসব ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করার মতো অস্ত্র নাকি পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রেরও নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মানবস্বাস্থ্যের ওপর ঝুঁকি বিবেচনা করে এমন ১২টি প্রজাতির সুপারবাগ ব্যাকটেরিয়ার তালিকা প্রকাশ করেছে এবং এসব প্রজাতির ব্যাকটেরিয়ার দিকে বিশেষ নজর দেওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছে সংস্থার সদস্য দেশগুলোকে। জানানো হয়েছে, হাসপাতালে ও নার্সিংহোমে কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র বা রক্ত নিষ্কাশন যন্ত্র ব্যবহারকারী রোগীদের মাঝে এসব ব্যাকটেরিয়ার প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়। এসব ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে তৃতীয় প্রজন্মের সেফালোস্পোরিনের মতো অত্যাধুনিক ও সবচেয়ে শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিকও নাকি কার্যকারিতা হারিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ঘটনা মানবজাতির জন্য অনিশ্চিত ও ভয়াবহ এক পরিণতির অশনিসংকেত। প্রতি বছর অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী সুপারবাগের কারণে পৃথিবীজুড়ে প্রায় ৭ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করে। আমাদের আশঙ্কার কারণ আছে-কেননা বাংলাদেশে অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়ার জাতীয় পর্যায়ে কোনো সঠিক তথ্য নেই। বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী সুপারবাগের দ্রুত উত্থানের পেছনে মূল কারণ হলো যত্রতত্র প্রেসক্রিপশনবিহীন অ্যান্টিবায়োটিক সেবন, ভুল অ্যান্টিবায়োটিক সেবন এবং অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স সম্পূর্ণ না করা অথবা অপ্রয়োজনে বা অতিমাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ।

মন্তব্য : বাংলাদেশের আর্থসামাজিক বাস্তবতায় অ্যান্টিবায়োটিকের অপ্রয়োজনে বা অতিমাত্রিক ব্যবহার অথবা প্রেসক্রিপশনবিহীন অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি দ্রুত বন্ধ করতে হবে। সঠিক মাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ, কোর্স সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে রোগীকে সচেতন করা, টিকাদান কর্মসূচির সম্প্রসারণ, হাসপাতালে সংক্রমণ-নিয়ন্ত্রণ এবং সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবনে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার চর্চা ইত্যাকার বিষয়ে প্রেসক্রিপশনে, চিকিৎসকরা মৌখিকভাবে, রেডিও, টেলিভিশন ও পত্রপত্রিকায় প্রচারণা চালিয়ে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। সময় থাকতেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট বিভাগ অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণমুখী না হলে এক নীরব হত্যাকান্ড চালাবে এসব ঘাতক সুপারবাগ ব্যাকটেরিয়া।

আসছে পাটের পলিথিন : এমন প্রশ্নে বিস্মিত হতে পারেন আপনিও-পাটের সূক্ষ্ম তন্তুর পলিথিন কি সম্ভব? কিন্তু অবাক করা সত্যি হচ্ছে-এই অসম্ভবকে সম্ভব করে পরিবেশবান্ধব ‘পাটের পলিথিন’ ব্যাগ তৈরি করেছেন বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা। আমরা জানি, অপচনশীল পলিথিন ব্যাগ নালা-নর্দমায় আটকে থেকে মারাত্মক পরিবেশ দূষণ ঘটিয়ে চলেছে। বাংলাদেশে পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ পলিথিন। কড়া শাস্তির আইন করে এটি নিষিদ্ধ করা হলেও রোধ করা যাচ্ছে না এর উৎপাদন ও ব্যবহার। কারণ বাজারে পলিথিনের কোনো বিকল্প ছিল না। বলা হচ্ছে, পাটের তৈরি পলিথিন ব্যাগটি অবিকল বাজারে প্রচলিত পলিইথাইলিন-পলিথিনের মতোই। বাজারে যে পলিথিন ব্যাগ আছে, তার চেয়ে দেড় গুণ বেশি টেকসই এবং ব্যবহার স্বাচ্ছন্দ্য পাওয়া যাবে এই পাটের পলিথিনে। দুই রঙের দৃষ্টিনন্দন পাটের পলিথিন ব্যাগগুলো চার কোণ আকৃতির। বাজারে প্রচলিত পলিথিন ব্যাগের মতোই হালকা-পাতলা। এই ব্যাগ ব্যবহারের পর ফেলে দিলে সহজে মিশে যাবে মাটির সঙ্গে। পুড়িয়ে ফেললে ছাই-ভস্মে পরিণত হবে। পাট ও বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন, ছয় মাসের মধ্যে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পাটের পলিথিন উৎপাদন শুরু হবে। প্রথমে সরকারিভাবে উৎপাদনের পর বেসরকারিভাবেও উৎপাদনে যাওয়া যাবে। উৎপাদন বাড়লে দেশের চাহিদা পূরণ করে এই ব্যাগ বিদেশেও রফতানি সম্ভব হতে পারে।

মন্তব্য : পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সারা বিশ্ব পলিথিনের বিকল্প খুঁজছে। পাটের তৈরি পলিথিনে পরিবেশ দূষিত হবে না। দাম সাশ্রয়ী হবে। ন্যায্যমূল্য পাবেন কৃষক। বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের এই উদ্ভাবন নতুন আশাবাদ জাগানোর পাশাপাশি পাটশিল্পের বিকাশে বিশ্বে নতুন বাজার তৈরি করবে। সারা বিশ্বের পাটের পলিমার ব্যাগের বাজার দখল করার সুযোগ সৃষ্টি হোক। বিশ্বমাত করুক বাংলার পাট।

লেখক : সমাজতত্ত্ব বিশ্লেষক ও উন্নয়ন গবেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist