পঞ্চানন মল্লিক

  ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭

মাদক

ভূত তাড়াবে কে

ছোটবেলায় নরেন মামার (আমাদের প্রতিবেশী) মুখে একটা গান প্রায়ই শুনতাম। মামা দাওয়ায় বসে চরকায় পাটের সুতো পাকাতে পাকাতে গাইতেন, ‘বিড়ি খেয়ে গেল দেশের মান। ওরে ছ্যামড়ারা (ছেলেরা) খায় যেমন তেমন ছ্যামড়িরা (মেয়েরা) দেয় লম্বা টান, বিড়ি খেয়ে গেল দেশের মান। ভাইরে আর খাব না পাতার বিড়ি কিনে আনো ক্যাপেস্টান।’ বিড়ি খেয়ে দেশের মান কতখানি গেছে তা জানি না, তবে এখনকার সন্তানরা নেশায় আসক্ত হয়ে অভিভাবকের আশা ভরসা এমন কি মান-সম্মানও যে ধুলোয় মিশিয়ে দিচ্ছে তা আশপাশে হরহামেশাই দেখে থাকি। প্রজন্ম বিধ্বংসী মাদকের ব্যবহার সমাজে যেভাবে অতি দ্রুত বিস্তার লাভ করছে তাতে অভিভাবক মহল আজ শঙ্কিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহায়তায় পরিচালিত এক জরিপ হতে জানা গেছে, এ দেশে ১৮ বছরের ওপরে ০ দশমিক ৬৭ শতাংশ মানুষ মাদকাসক্ত। এর মধ্যে ৮৫ শতাংশের বয়স ১৮ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। বিগত মাত্র কয়েক দশকে এ দেশে মাদকের সবচেয়ে বেশি বিস্তার ঘটেছে। আশির দশকের শেষ দিকে ফেনসিডিল ও নব্বইয়ের দশকে মাদকের জগতে সংযুক্ত হয় ইয়াবা। পর্যায়ক্রমে এগুলোর ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করেছে। এ ছাড়া অন্যান্য প্রাকৃতিক এবং রাসায়নিক মাদক দ্রব্যের প্রতিও দিন দিন আসক্তদের সংশ্লিষ্টতা বেড়ে চলেছে। কালের বিবর্তনে ভেঙে গেছে আমাদের আগের সেই যৌথ পরিবার-ব্যবস্থা। দাদা-দাদি, চাচা-চাচি, ফুফুর স্নেহ, মমতা আমরা আগেই হারিয়েছি। সংসারের প্রয়োজনে এখন মাতা-পিতা দুজনকেই ছুটে চলতে হচ্ছে কর্মমুখী স্রোতে। নিজের সন্তানকে আদর, স্নেহ, মায়া, মমতা, ভালোবাসা দেওয়ার মতো সময় এখন মানুষের হাতে কমে গেছে। এ কারণে আজ সন্তানরা স্নেহ-মমতা হারিয়ে অনেকটা নিঃসঙ্গ। যা সন্তানদের ঠেলে দিচ্ছে বিভিন্ন নেশাদ্রব্যের দিকে। মাদকের সহজলভ্যতা, মাতা-পিতার উদাসীনতা, জীবনে খারাপ বন্ধুর প্রভাব, প্রেম বা অন্য বিষয়ে ব্যর্থতা, রঙিন কৌতূহল ইত্যাদি সন্তানকে ঠেলে দিচ্ছে মাদকে আসক্তির পথে। সাধারণত সন্তানরা তার মাতা-পিতাকেই বেশি অনুসরণ করে থাকে। ধূমপায়ী পিতা-মাতার সন্তানদের তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধূমপানে আসক্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি থাকে। প্রথমে বাবার পকেট থেকে চুরি করে বিড়ি, সিগারেট কিংবা টাকা নিয়ে দোকান থেকে কিনে গোপন কক্ষে, বন্ধুর মেসে, স্কুল-কলেজের পার্শ্ববর্তী দোকান ইত্যাদিতে ধূমপানে লিপ্ত হয়। পরে খারাপ বন্ধু-বান্ধবের আখড়ায় মিশে ধূমপান ছেড়ে মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ে। আসক্ত সন্তানের মধ্যে হঠাৎ আচরণের পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। মা-বাবার অবাধ্য হতে শুরু করে সন্তান। মেজাজ খিটখিটে, খাওয়া-দাওয়ায় অনীহা, ক্ষুধামান্দ্য, বমিবমি ভাব দেখা দেয়। অধিক রাতে বাসায় ফেরে, কখনো রাতে বাসাতেই ফেরে না। মিথ্যা বলার প্রবণতা বেড়ে যায়। বিভিন্ন অজুহাতে মা-বাবার কাছে টাকা-পয়সা চায়। না দিলে উত্তেজিত হয় ও অস্থিরতা দেখায়। সামাজিকতা ভুলে নিজেকে গুটিয়ে রাখে। নিকটস্থদের কাছে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ঋণ শোধ দিতে পারে না। আসক্তের খবর মাতা-পিতার কানে আসার পর অনেকেই ক্ষুব্ধ হয়ে সন্তানকে গালিগালাজ, মারধর ইত্যাদি করে থাকেন। কিন্তু এভাবে সন্তানের মাদকাসক্তি ছাড়ানো সহজ হয় না। বরং আরো অধঃপতনের দিকে সন্তান ধাবিত হতে পারে। এ রকম সন্তান তাই মা-বাবার জন্য দুশ্চিতার কারণ।

মাদকাসক্তি একটি সামাজিক ব্যাধি। এটি আমাদের আর্থিক, সামাজিক, মানসিক, নৈতিকতার ক্ষতি করে। এই ব্যাধি থেকে সন্তানদের রক্ষার উপায় তাই আমাদেরই খুঁজে বের করতে হবে। মাদকাসক্ত সন্তানকে যতটা সম্ভব বোঝাতে হবে। মাদক সেবনে দেহে সাময়িক উত্তেজনা সৃষ্টি হলেও ক্রমে তা দেহ ও মনকে ঠেলে দেয় নিশ্চিত ধ্বংস ও মৃত্যুর দিকে। মাদকাসক্তির কারণে স্নায়ুতন্ত্র, ফুসফুস, যকৃৎ, হৃদযন্ত্র, কিডনি, পাকস্থলী, প্রজননতন্ত্রসহ দেহের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত এবং পরবর্তীতে সম্পূর্ণরূপে নষ্ট হয়ে যেতে পারে, এমনকি সময়মতো চিকিৎসা না করালে মৃত্যুও পর্যন্ত হতে পারে, সে কথা তাদের বোঝাতে হবে। আসক্ত সন্তানকে মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করাতে হবে। তাদের নিবিড় তত্ত্বাবধানে আসক্ত সন্তান ধীরে ধীরে সুস্থ হবে। সন্তানকে নৈতিক জ্ঞান শিক্ষা দিতে হবে। মাতা-পিতাকে শুধু টাকার পেছনে না ছুটে সন্তানকে সময় দিতে হবে। আদর, স্নেহ, যতœ দিয়ে তাদের মানুষ করে তুলতে হবে। তাহলে সন্তান মাদকে আসক্ত হয়ে আমাদের জীবনে আর অভিশাপ ডেকে আনবে না। আসুন আমরা সচেতন হই।

এ তো গেল মাদক থেকে সন্তানকে দূরে রাখার একটি উপায়। কিন্তু আসল কাজটি করবে কে? দেশের অভ্যন্তরে এত যে মাদক আসছে তার প্রতিরোধের ব্যবস্থা কী? সম্ভবত এর কোনো ব্যবস্থা নেই। কেননা যারা এর প্রতিরোধের দায়িত্বে আছেন, তাদের সব ধরনের বিলাসিতার জোগান এসে থাকে অবৈধ মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। অর্থাৎ সরিষার মধ্যেই ভূতের বসবাস। এই ভূতকে তাড়ানো না গেলে মাদকাসক্তের সংখ্যা কমার কোনো সম্ভাবনা নেই। বরং দিনে দিনে তা বেড়েই চলবে। আমরা মনে করি, সরকারকেই এ দায়িত্ব নিতে হবে। যা স্বাধীনতার এত বছর পর হলেও, কেউ তা কারেনি-এটাই বাস্তবতা।

লেখক : কলামিস্ট ও গীতিকার

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist