reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ২০ জানুয়ারি, ২০১৭

সমাজ

ভেজাল সাম্রাজ্যে বিষেও ভেজাল

এ কে এম শামছুল হক রেনু

একটু খেয়াল করলে প্রতিনিয়তই প্রয়োজনীয় ওষুধ, হার্টের রিং, ইনসুলিন থেকে শুরু করে খাদ্যদ্রব্য, ভোগ্যপণ্য, এমনকি বিষেও ভেজাল আছে বলে শোনা যায়। প্রায় সময়ই মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে এক-দুটি ঘটনা এবং ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের জেল-জরিমানাও হয়ে থাকে। এ ব্যাপারে ভুক্তভোগীসহ অনেকেরই প্রশ্ন হলো, ভেজাল নেই কোথায়?

ক্ষেতের পোকামাকড় ধ্বংস করার জন্য অনেকেই ‘এন্ড্রিন’ নামক কীটনাশক ব্যবহার করে থাকে। এই মারাত্মক কীটনাশক খাওয়ার পর হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য একজনকে নেয়া হলে জীবিত রোগী দেখে ডাক্তার বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, এন্ড্রিন খেয়ে কারো এতক্ষণ বেঁচে থাকার কথা নয়। এড্রিন বোতলের লেবেল দেখে ডাক্তার আরো নিশ্চিত হন, এটা সত্যিই এন্ড্রিন। চিকিৎসারত রোগী হাসপাতালে কয়েক ঘণ্টা থাকার পর আরোগ্যের লক্ষণ দেখে আরো অবাক হন ডাক্তার। পরে বোতলটি ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় জানা যায়, এই কীটনাশকেও ভেজাল। যদি এন্ড্রিনে ভেজাল না থাকত, তাহলে কোনো অবস্থাতেই এই রোগীকে বাঁচানো সম্ভব ছিল না। রোগীকে হাসপাতাল পর্যন্ত আনারও সুযোগ হতো না। ডাক্তার কীটনাশক এন্ড্রিন ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা না করালে বিষে যে ভেজাল ছিল, তা অজানাই থেকে যেত। ঘটনার পরম্পরায় প্রমাণিত হয়েছে, অন্যান্য জিনিসের ভেজালের মতো মারাত্মক এন্ড্রিনেও ভেজাল। একইভাবে অপর এক ঘটনায় জানা যায়, কোনো এক রোগী দেশের এক নামিদামি হৃদরোগ হাসপাতালে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে বাইপাস অপারেশন করে দুটি রিং লাগান। পরবর্তীকালে দেখা যায়, রিং দুটি যেভাবে কাজ করার কথা, সেভাবে কাজ করছে না। পরে অন্য একটি হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর দেখা যায়, রিংটি দুটি নকল। এভাবে ডায়াবেটিস রোগীদের ইনসুলিন এবং ক্যান্সার চিকিৎসায় ব্যবহত ওষুধেও নকল ও ভেজালের কথা শোনা যায়।

তেমনিভাবে দেখা যায়, সম্প্রতি স্বর্ণ পাচারের আসামি রায়ের ভুয়া কাগজ দেখিয়ে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসে, যা ভেজালেরই নামান্তর। এই ভেজাল সর্বনাশা ঘাতক হিসেবে রাজনীতি, সমাজনীতি, শাসন, প্রশাসন, আইন এবং বিচারসহ সর্বক্ষেত্রে আবির্ভূত হচ্ছে, যা একসময় ভয়াবহ আকার ধারণ করে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়বে সমাজে। এ ক্ষেত্রে বলা যায়, সর্বাঙ্গে ঘা, ডাক্তার ওষুধ দেবে কোথায়? কোর্ট ফিতে ভেজাল, স্ট্যাম্পে ভেজাল, ১০, ২০, ৫০, ১০০, ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোটসহ ৫ টাকার কয়েনেও ভেজাল। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদেও ভেজালের সমারোহ। অফিসে অসময়ে আসা এবং নির্ধারিত সময়ের আগে ত্যাগ করার ব্যাপারেও হাজিরা খাতায় রয়েছে ভেজালের ছড়াছড়ি। অর্থাৎ, অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়মিত এবং সময়মতো যেমন অফিসে আসে না, তেমনি যথাসময়ে অফিস ত্যাগও করে না। অনেকেই ৫টা বাজার আগেভাগেই অফিস ত্যাগ করে গন্তব্য চলে যায়। আবার অনেকেই ব্যক্তিগত কারণে রাতেরবেলায়ও অফিস করে থাকে। স্বজনদের চিকিৎসার ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিতে গিয়ে কিশোরগঞ্জ জেলাধীন একটি উপজেলা স্বাস্থ্য হাসপাতালে সন্ধ্যায় একজন ডাক্তারেরও উপস্থিতি পাওয়া যায়নি, যদিও সরকারি হাসপাতালের জরুরি বিভাগে সার্বক্ষণিক একজন ডাক্তার উপস্থিত থাকার কথা। কিন্তু ডাক্তার যে থাকে না, এটাই বাস্তবতা। সর্বজনীন কথা।

ভোগ্যপণ্য ও খাদ্যে ভেজালের সমারোহ এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে, সমাজের সচেতন কারো পক্ষে স্বস্তির সঙ্গে সুষম খাদ্য পাওয়া দুষ্কর। হাট-বাজার ও বিপণিবিতানে যেসব ভোগ্যপণ্য ও খাদ্যদ্রব্য পাওয়া যায়, সেগুলোর অধিকাংশের মধ্যেই দেশি-বিদেশি নামিদামি ব্র্যান্ডের লোগো সংবলিত এবং উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের নাম গায়ে লেখা থাকলেও কেমিক্যাল টেস্টে বেশিরভাগই ভেজাল। বাজারে যেসব জুস এবং পানীয় বিক্রি হয়, তার সিংহভাগই ভেজাল। নামিদামি দোকানের মিষ্টি, ব্রেড, ঘি, মধু, ভোজ্য তেল, নারিকেল তেল এবং বাটার অয়েলের ব্যাপারেও রয়েছে প্রশ্ন। দুধ এবং প্যাকেটজাত শিশুখাদ্য মানসম্মত নয়। আম, জাম, আনারস, কলা, আঙ্গুর, কমলা, মাল্টা, তরমুজ, পেঁপে ইত্যাদি ফল সম্পর্কে মানুষের ধারণা দিনের পর দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। ভয়ঙ্কর কেমিক্যাল মেশানো ফলফলাদি, দুধ, ঘি, মধু ভালোর চেয়ে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা গ্রহণ করলে মানুষ ভালো থাকা তো দূরের কথা, ক্রমান্বয়ে কিডনি-পাকস্থলী অকেজো হয়ে যাচ্ছে। ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, হেপাটাইটিস এবং ব্লাড প্রেসারসহ বিভিন্ন দুরারোগ্য ব্যাধি মানুষের শরীরে স্থায়ী আসন করে বসেছে। তাছাড়া ভেজালের কথা জানা যায় হলুদের গুঁড়া, মরিচের গুঁড়া, ধনিয়ার গুঁড়া, জিরার গুঁড়া, দারুচিনির গুঁড়া, ডাল এবং সেমাইসহ আরো অনেক খাদ্যদ্রব্য ও ভোগ্যপণ্যে। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় খাদ্যে নিষিদ্ধ ঘোষিত ডিডিটি, কার্বামেড, কার্বাইড, ক্রোমিয়াম, অ্যালড্রিন, আর্সেনিক, মিথানল ও ফরমালিনের মতো অনেক রাসায়নিকের উপস্থিতি লক্ষণীয়। এখন মাছে ও দুধে মেশানো হয় ফরমালিন, ফলমুল পাকাতে কার্বাইড। মুড়িতে ইউরিয়া, শুঁটকি তৈরিতে ডিডিটি পাউডার, গুঁড়া মসলা, চানাচুর ও রঙিন খাবারে ব্যবহৃত হয়ে থাকে শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর কাপড়ের রং, গুড়ে মেশানো হয় আটা, ভুসি, রং ও ফ্লেভার। সবজিতে কীটনাশক স্প্রে, মুরগির খাবার, পোল্ট্রি ফিড এবং মাছের খাবার তৈরি হয় ট্যানারির বিষাক্ত বর্জ্য দিয়ে।

সম্প্রতি হাইকোর্ট খাদ্য ও ভোগ্যপণ্যে ব্যাপক ভেজাল মেশানোর পরিপ্রেক্ষিতে রুল জারি করেছেন। কিন্তু তাতেও কোনো ফল হয়নি। প্রশাসনের ঢিলেঢালা মনিটরিং ব্যবস্থা এবং ভেজালের বিরুদ্ধে আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়ায় খাদ্যে ও ভোগ্যপণ্যে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ মেশানোর প্রবণতা নিয়মতান্ত্রিকে পরিণত হয়েছে। শুধু খাদ্যদ্রব্য বা পণ্যে ভেজাল নয়, রাজনীতিতেও ভেজালের অনুপ্রবেশ ঘটেছে।

দীর্ঘদিন ধরে সর্বনাশা ও সর্বগ্রাসী ভেজাল সমস্যা বর্তমানে দেশের আপামর মানুষের জন্য আত্মঘাতী মরণাস্ত্র হিসেবে দেখা দিয়েছে। এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়াই এখন দেশের মানুষের একমাত্র অভিলাষ; এবং ভেজালমুক্ত দেশ গড়ার পদক্ষেপ গ্রহণ করে জনগণের দোরগোড়ায় সুখবর পৌঁছে দেয়া সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য বলে মনে করে এ দেশের কোটি কোটি মানুষ। আশা করি, সরকার বিষয়টি ভেবে দেখবে।

লেখক : কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist