আস্থা ফিরে আসবে
অপরাধ নিয়ন্ত্রণে বিচারের বিকল্প নেই। অনেকের ধারণা, খুনের বিচার কখনই খুন বন্ধ করতে পারে না। এ কথা স্বীকার করেও বলা যায়, বিচার অবশ্যই অপরাধের মাত্রা কমাতে পারে। আর বিচার না হলে তৈরি হয় বিচারহীনতার সংস্কৃতি। ফলে, সমাজে বেড়ে যায় নানা অরাজকতা। নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুনের মামলার রায় সেই বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ তৈরি করেছে। এ প্রশ্নে বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। এ দেশের ষোলো কোটি মানুষ যা আশা করেছিল বিচারের রায় সে আশা পূরণে সমর্থ হয়েছে। তারা মঙ্গল কামনা করে দোয়া করেছেন। বিচার প্রক্রিয়ার প্রতি মানুষের আস্থা কিঞ্চিৎ হলেও বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলাদেশের বিচারিক ইতিহাসে এটি একটি ঐতিহাসিক রায়। হত্যাকা-ে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তি যেমন জড়িত ছিলেন, তেমনি ছিলেন অপরাধী দমনে নিয়োজিত একটি সরকারি বাহিনীর বেশ কিছু সদস্য। রায় প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে অপরাধী যতই ক্ষমতাধর হোক না কেন, তাকেও শাস্তি পেতে হয়। এ রায় আদালতের প্রতি মানুষের আস্থা এবং ভালোবাসার সোপান তৈরিতে সাহায্য করেছে, যা এতদিন একটি ভাঙা সেতুর মতো মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিল এখন তা একটি ব্রিজে রূপান্তরিত হয়েছে।
বিচারিক ইতিহাসে এই রায়কে একটি মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মামলায় সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন ও র্যাবের সাবেক কর্মকর্তা লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদসহ (যিনি ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার জামাতা) ২৬ আসামিকে মৃত্যুদ-াদেশ দিয়েছেন আদালত। মামলার ৩৫ আসামির মধ্যে বাকি নয়জনকে দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ-। দ-প্রাপ্তদের মধ্যে ২৫ জনই র্যাবের সদস্য। ফৌজদারি অপরাধে একসঙ্গে এত র্যাব সদস্যের সাজার ঘটনা এটাই প্রথম।
ঐতিহাসিক এ রায়ের বিপক্ষে একজনকেও কোনো মন্তব্য করতে শোনা যায়নি। পক্ষে অগণিত। সাত খুন মামলার এই রায়ে আদালত কিছু অভিমত দিয়েছেন। অভিমতে আদালত বলেছেন, এ ঘটনা সব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য লজ্জাজনক। একইসঙ্গে জাতির জন্যও বটে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সাত খুন মামলার রায়ের মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে ‘ন্যায়বিচার হয়’। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, রায়ের মধ্য দিয়ে র্যাব আরো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়, তাও প্রমাণিত হয়েছে। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেছেন, এ রায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং মানুষের মাঝে যে আতঙ্ক ও অসহায়ত্ব তা দূর করতে প্রত্যাশিত ভূমিকা রাখবে। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম জানিয়েছেন, রায়ে সমগ্র জাতি স্বস্তি পেয়েছে।
ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের মতে, ‘সত্য সুপ্রতিষ্ঠিত হলো’। মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশিদ বলেছেন, আইন প্রয়োগকারীরা সতর্ক হলো। অ্যাডভোকেট শ. ম. রেজাউল করিম বললেন, নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি হলো। আর বাদীপক্ষের আইনজীবী সাখাওয়াত হোসেন খান বলেছেন, রায়টি কার্যকর করতে সব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হোক।
রায় ঘোষণাকালে দ-প্রাপ্ত আসামিদের অনেককেই ফুরফুরে মেজাজে দেখা গেছে। রায় শোনার পরও তাদের মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। প্রিজন ভ্যান থেকে আদালত কক্ষে নেওয়ার সময় তাদের অনেকের মুখে ছিল হাসির অভিব্যক্তি। আর এই অভিব্যক্তিই মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে। তারা আতঙ্কিত হয়ে বলছেন, উচ্চ আদালতে গিয়ে এ রায় কী হোঁচট খেয়ে দিক পরিবর্তন করবে?
আমরা মনে করি, নিরপেক্ষতাবাদকে দূরে সরিয়ে রেখে উচ্চ আদালত সত্যের পক্ষেই থাকবেন। ষোলো কোটি মানুষ সেই আশায় দিন গুনছে। আমরা আমাদের হারানো বিশ্বাসকে অবশ্যই ফিরে পাব।
"