গোপাল অধিকারী

  ১৩ আগস্ট, ২০২০

মুক্তমত

করোনাকালে পেশা নিয়ে বাড়ছে দুশ্চিন্তা

দীর্ঘদিনের করোনা জনজীবনে একটি অভিশাপে পরিণত হয়েছে। সরকারি চাকরি বা সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান ব্যতীত সবার জীবনে করোনা পরিবর্তন করেছে গতিপথ। করোনা পাল্টে দিয়েছে মানুষের জীবনযাত্রা ও জীবনযাত্রার মান। অনেকের মাঝে বেড়েছে দুশ্চিন্তা। জীবনের এ সময়ে তারা কী করবে? কীভাবে চলবে সংসার? সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের শুধু জীবন ধারণের অভ্যাসের পরিবর্তন করলেও অন্যান্য পেশার মানুষের জীবন-জীবিকাসহ সবকিছুতেই পরিবর্তন করছে করোনা। করোনার কারণে অনেকে হারিয়েছেন কর্মসংস্থান। অনেকের বেতন না থাকায় পাল্টেছে নিজস্ব কর্ম। নিম্ন আয়ের অনেক মানুষ করোনার কারণে ইতোমধ্যে পেশা বদল করেছেন। করোনায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে অনেকে বন্ধ করে দিয়েছেন হোটেলে খাওয়া-দাওয়া। ফলে মালিক বন্ধ করে দিয়েছে প্রতিষ্ঠান। কর্ম হারিয়ে বেকার হোটেলের বাবুর্চি ও সরবরাহকারী। অশিক্ষিত ও প্রশিক্ষণবিহীন এই মানুষগুলো এখন কী করবে, তা কেউ জানেন না। করোনায় সবেচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্তের শিকার বিভিন্ন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষিকামন্ডলী। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মানসূচক ডিগ্রি নিয়ে যখন এই পেশাতে যুক্ত হয়েছেন, করোনার কারণে সেই মানুষটি এখন দিশাহারা। অন্যান্য পেশায় অন্য কর্ম করার সুযোগ থাকলেও এই পেশাতে সবকিছু করা যেন বেমানান। সম্মানী সামান্য হলেও সম্মানের জন্য ধরে রেখেছিলেন এই পেশাটি। কিন্তু করোনা যেন তাদের কিছুই করতে দিল না। তাই জীবন ও জীবিকার তাগিদে বেছে নিচ্ছেন ভিন্ন কর্ম।

এমনই এক শিক্ষক দিনাজপুরের পার্বতীপুরের গোলাম কিবরিয়া। এখন তার হাতে চক-ডাস্টারের বদলে তুলে নিয়েছেন কোদাল ও ঝুড়ি। কাজ করছেন শ্রমসাধ্য রাজমিস্ত্রির। পার্বতীপুরের ব্রাইনটেন রেসিডেন্সিয়াল স্কুলের এই শিক্ষক নিজে অবিবাহিত হলেও বাবা-মা, ভাইবোন, দাদিসহ পরিবারে মোট ৯ জন সদস্য এই শিক্ষকের। নিজের দুর্দশার কথা জানিয়ে কিবরিয়া বলেছেন, স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে গত মার্চে। বন্ধের আগে এক মাসের বেতন পেয়েছিলেন, এরপর এ পর্যন্ত আর কোনো বেতন পাননি। যে কাজই হোক না কেন, না করে আর উপায় ছিল না! বেতন বন্ধ মেহেরপুরের কিডস ওয়ার্ল্ডস স্কলারস স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক সুজন ইসলামেরও। পেটের দায়ে চালাতে শুরু করেছেন ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক। এই শিক্ষক বলেছেন, করোনাভাইরাসের কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় তারা নিরুপায়। এলাকার অনেকে তাদের নিয়ে হাসাহাসি করে। কিন্তু সংসার তো চালাতে হবে। এভাবেই পেশা বদল করে কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার মিরপুর মাহমুদা চৌধুরী কলেজ-এর সমাজবিজ্ঞান বিষয়ের প্রভাষক আরিফুর রহমান। এপ্রিল থেকে স্থানীয় কাতলাগাড়ি বাজারে গরু-ছাগলের ওষুধ (ভেটেরিনারি মেডিসিন) বিক্রি শুরু করেছেন। একই জেলার কুষ্টিয়া ইসলামিয়া কলেজের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ের প্রভাষক ইমরুল হোসেন। তিনিও অনার্সের শিক্ষক। নিজেও একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স-মাস্টার্স করেছেন। কলেজ থেকে টানা তিন মাস বেতন না পেয়ে পেটের দায়ে এই শিক্ষক কষ্টসাধ্য কৃষিকাজে নেমে পড়েছেন। আরিফুল ও ইমরুলের মতো দেশের কয়েক হাজার শিক্ষক এখন নিজ পেশা ছেড়ে অন্য কাজ করছেন। পেটের ভাত জোগাড়ের চেষ্টায় দারিদ্র্যের সঙ্গে আপ্রাণ লড়াই করে যাচ্ছেন। কেউ রাজমিস্ত্রি, আবার কেউ মৌসুমি ফলও বিক্রি করছেন। কেউবা ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক চালাচ্ছেন। করোনাকাল তাদের জীবনে এসেছে ঘোর অমানিশা হয়ে। বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষক তারা। কয়েক মাস বেতন বন্ধ। পেট তো লকডাউন মানে না। পেটের দায়ে বাধ্য হয়ে নেমেছেন কষ্টকর এসব কাজে। অন্তত ১৪ লাখ বেসরকারি শিক্ষক পরিবার এমন দুর্বিসহ জীবনের মুখোমুখি।

‘সরকার বেসরকারি এই শিক্ষা সেক্টরের উন্নয়ন না ঘটালে আগামী বছরেই শিক্ষা খাতে বিরাট ধস নামবে বলে মনে করা হচ্ছে। দেশে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার নন-এমপিও স্কুল-কলেজ ও মাদরাসায় এক লাখ ১০ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছেন। এ বছর দুই হাজার ৬১৫ প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হওয়ায় এদের মধ্যে ৩০ হাজার শিক্ষক-কর্মচারীর সরকারি বেতনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু অনিশ্চয়তায় রয়েছেন ৮০ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী। দেশে প্রায় ৬৫ হাজার কিন্ডারগার্টেনে সাত লাখ শিক্ষক রয়েছেন। নিয়মিত বেতন না পাওয়ায় অনিশ্চয়তায় রয়েছে এই প্রতিষ্ঠানের সবার পরিবার। ্একজন মানুষ একটি পরিবারকে স্বপ্ন দেখায়। হয়তো এই একজনের বেতন দিয়েই চলত তার বাড়িতে থাকা বৃদ্ধ বাবা-মার চিকিসার খরচ। কিন্তু এখন এ সময়ে কে দেখবে তাদের প্রশ্নটা থেকেই যায়। পরিবর্তন হচ্ছে ব্যবসায়িক জীবনেও। লকডাউন শিথিল হওয়ায় মার্কেট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুললেও কাস্টমার মিলছে না। দোকান খুলে সারা দিন বসে থেকেও মিলছে না ক্রেতা। সবার মধ্যেই বিরাজ করছে অভাব। সবাই যেন শুধু জীবিকা নির্বাহ করতেই ব্যস্ত। এতে ক্ষদ্র ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা চোখে অন্ধকার দেখছেন। এ অবস্থা চলতে থাকলে মাস দুয়েকের মধ্যেই হয়তো দেখা যাবে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার প্রক্রিয়া। আগামীতে হয়তো ব্যবসায়ীদেরও পেশা বদল করে জীবন-জীবিকার জন্য অন্য কোনো পথ বেছে নিতে হবে। তারা হতাশ হয়েছেন। সংকট আরো বেড়েছে। লকডাউনে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকাবস্থায় যে লোকসান গুনতে হয়েছিল এখন তার চেয়ে বেশি গুনতে হচ্ছে। দোকান ভাড়া, কর্মচারীদের বেতন, বিদ্যুৎ বিল, সার্ভিস চার্জ সবকিছু মিলিয়ে এখন ব্যবসায়ীরা দিশাহারা। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ারও কোনো লক্ষণ নেই। স্বাভাবিক হলেও দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সহসাই ব্যবসাবান্ধব হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কমে এসেছে দৈনন্দিন আয়। যে কারণে কমে গেছে দেশের অর্থনীতির চাকা। তাই বিভিন্ন পরিবারগুলোতেও দেখা দিয়েছে আর্থিক সংকট। করোনাকালে সমস্যায় পড়েছে পর্যটনশিল্পকে ঘিরে গড়ে ওঠা হোটেল, রেস্টুরেন্ট ও ট্রান্সপোর্ট ব্যবসায়ীরাও। করোনার কারণে ঘোষণা দিয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে সব হোটেল। রেস্টুরেন্টগুলোর তালাও খুলছে না। এমতাবস্থায় এই খাতের ব্যবসায়ের ভবিষ্যৎ কীÑ এমন প্রশ্ন সবার মনে মনে।

করোনা সবকিছু লন্ডভন্ড করে দিয়েছে। খুব সহজে এই খাত দাঁড়ানো সম্ভব নয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও আর্থিক সংকটের কারণে মানুষ ঘুরতে বের হবে না। যে কারণে এই খাতে যে অন্ধকার নেমেছে, তা সহসা কাটার নয়। পেশা বদলে যাচ্ছে পরিবহন সেক্টরেও। পর্যাপ্ত যাত্রীসাধারণ না থাকায় কমেছে যানবাহনের সংখ্যা। ফলে সড়কে কমেছে যানবাহন। পরিবহন শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছে তারা যুক্ত হচ্ছে অটো, সিএনজি বা রাজমিস্ত্রির কাজে। বদলে যাচ্ছে আইনজীবীর সহকারীদের পেশায়ও। একটি প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ইমরান হোসেন মাসুদ, পেশায় আইনজীবীর সহকারী। খাগড়াছড়ি জেলা ও দায়রা জজ আদালতে কর্মরত ছিলেন এক দশক ধরে। কখনো বড় ধরনের সংকটে পড়তে হয়নি তাকে। কিন্তু করোনার কারণে আদালতের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নিত্যপণ্যের খরচ মেটাতে বাধ্য হয়ে মাসুদ বেসরকারি একটি ওষুধ কোম্পানিতে কাজ শুরু করেছেন। পৃথিবীটা একটি কঠিন সমরক্ষেত্র। তাই এই সময়ক্ষেত্রে জীবন ও জীবিকা উভয়কে বাঁচাতেই আমরা বেছে নেই কর্ম। সব কর্মেরই একটি গন্তব্য বা ভবিষ্যৎ থাকে। কারণ ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবাই জ্ঞানীর কাজ। কিন্তু করোনা সেই গন্তব্য পর্যন্ত পৌঁছাতে দেবে না হয়তো অনেককেই। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা আরো বাড়বে বলে মনে হচ্ছে। আর বেকারের সঙ্গে সঙ্গে বাড়বে অপরাধপ্রবণতা।

শুধু এই সেক্টরগুলোই নয়, করোনায় বিপর্যস্ত ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো। এজন্য সরকারি প্রণোদনা ও সহজ শর্তে ঋণের কোনো বিকল্প নেই। সরকার যদি এগিয়ে না আসে, তবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি বিনিয়োগকারীরা টিকে থাকতে পারবেন না। শিল্প-কারখানা না থাকায় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে গেলে মারাত্মক অর্থনৈতিক স্থবিরতা নেমে আসবে। হাজার হাজার মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়বে। পেশা বদলে বাধ্য হবে আরো অনেক মানুষ। সংবাদে প্রতিনিয়ত দেখা যাচ্ছে রাজধানীর অনেকে এখন গ্রামে চলে গেছেন। বিশেষ করে গণমাধ্যমকর্মীদের অনেকেই এই করোনাকালে ছাঁটাই হয়েছে। অনেকে পেশা পরিবর্তন করে টিকে থাকার যুদ্ধ করছেন। পরিবারকে দুমুঠো ভাত ও কাপড় তুলে দেওয়ার জন্য তারা পেশা পরিবর্তনে বাধ্য হয়েছেন। করোনায় পেশা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে খাদ্যাভ্যাস ও চালচলনে। কথায় বলে, অর্থই অনর্থের মূল। তাই অর্থ না থাকলে জীবনধারাও যেন পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। মানবজীবনটা যেন কর্মময়ই, জীবনের প্রথম চার বছরই কর্ম বা চিন্তা মুক্তির সময়। কারণ এ সময়ে নির্দিষ্ট কোনো কর্ম থাকে না। চার পেরোলেই পড়ালেখা শুরু। পড়ালেখা শেষ না হতেই ভাবনায় আসে চাকরি বা স্বাবলম্বী হওয়ার প্রচেষ্টা। তারপর থেকেই চলে জীবন নামের যুদ্ধ। যে চার বছর চিন্তামুক্ত থাকি, সেই চার বছরে আসলে চিন্তা করার বোধোদয়ও হয় না। করোনার কারণে অনেকের কর্মই শুরু হবে নতুন করে। শুরু হবে উত্থানপতনের নতুন খেলা। পেশা যার যেমনই হোক দ্রুত দেশটা করোনামুক্ত হোক। রচিত হোক সবার পরিবর্তনহীন কর্ম। তৈরি হোক শঙ্কাবিহীন জীবনের সফলতার গল্প। করোনামুক্ত একটি সুন্দর দিনের প্রত্যাশায় আমরা সবাই।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close