সাহাদাৎ রানা

  ১১ আগস্ট, ২০২০

দৃষ্টিপাত

সড়কে মৃত্যুর মিছিল আবার শৃঙ্খলার প্রশ্ন

করোনাভাইরাসের কারণে নতুন এক চ্যালেঞ্জের সামনে পুরো বিশ্ব। সেই চ্যালেঞ্জের মধ্যেই যেন দিন পার করছে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ। তাই সারা বিশ্বে এখন আলোচনার প্রধান ও একমাত্র বিষয় হলো করানোভাইরাস। কেননা, এর বিরূপ প্রভাবে প্রায় থমকে সবকিছু। থেমে গেছে প্রায় ৬০০ কোটি মানুষের জীবনযাত্রা। এমন পরিস্থিতির মূল কারণ প্রতিদিনই সারা বিশ্বে করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। কঠিন এমন অবস্থা থেকে বিশ্ববাসী কবে নাগাদ মুক্তি পাবেন তা কেউ বলতে পারছে না। কারণ এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাস প্রতিরোধে কোনো প্রতিষেধক আবিস্কার হয়নি। তাই করোনাভাইরাস বিষয়ে সবার মধ্যে কাজ করছে ভয়। বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। এমন খবরে সবার মধ্যে কাজ করছে অস্বস্তি। তবে করোনায় মৃত্যুর খবরের মাঝে আরো একটি মৃত্যুর খবর আমাদের সবাইকে প্রতিনিয়ত ভাবিয়ে তুলছে। বিষয়টি সড়ক দুর্ঘটনা। প্রতিদিন বাড়ছে সড়কে মৃত্যুর সংখ্যা। করোনাকালীন এমন সময়ে মানুষের চলাচলা কম থাকার পরও সড়ক যেন এখনো মৃত্যুপুরী। শুধু করোনাকালিন সময়ে নয়, সারা বছরই আমাদের দেশে হাজার হাজার মানুষের প্রাণ যায় সড়কে। করোনার মতো আমাদের জন্য সড়ক দুর্ঘটনাও একটি ভয়াবহ মহামারির মতো। যে মহামারি দিন দিন আমাদের স্বাভাবিক জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে। দেশে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা বৃদ্ধি পায় আর বারবার আবারও সেই পরিচিত প্রশ্ন সামনে উঠে আসে। সড়কে কবে ফিরে আসবে শৃঙ্খলা?

সড়কে শৃঙ্খলার বিষয়টি বারবার আমাদের সামনে আসার পর এর সমাধানের বিষয়েও ব্যাপক আলোচনা হয়। নতুন নতুন আইন হয়। কিন্তু সড়কে মৃত্যুর সংখ্যা কমে না। গত বছর ১ নভেম্বর থেকে বহুল আলোচিত সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ কার্যকর করা হয়েছে। প্রায় এক বছর দুই মাস আগে পাস হওয়া আইনটি সেদিন থেকে কার্যকর হয়। যে আইনে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির দায়ে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘দন্ডবিধির ৩০৪-বি ধারায় যাই থাকুক না কেন, কোনো ব্যক্তির বেপরোয়া বা অবহেলাজনিত মোটরযান চালনার কারণে সংঘটিত কোনো দুর্ঘটনায় কোনো ব্যক্তি গুরুতরভাবে আহত বা নিহত হলে চালক সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদন্ড বা সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে। একই সঙ্গে এটি জামিন অযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে। আইনে পেশাদার-অপেশাদার চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকলে অনধিক ছয় মাসের জেল বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ড দেওয়ারও বিধান রাখা হয়েছে। এ ছাড়া আরো বেশকিছু জরিমানার নতুন বিধানও যুক্ত হয়েছে। বিশেষ করে মদপান করে বা নেশাজতীয় দ্রব্য খেয়ে গাড়ি চালালে, সহকারীকে দিয়ে গাড়ি চালালে, উল্টো দিকে গাড়ি চালালে, নির্ধারিত স্থান ছাড়া অন্য স্থানে গাড়ি থামিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি, চালকছাড়া মোটরসাইকেল একজনের বেশি সহযাত্রী উঠালে, মোটরসাইকেলের চালক ও সহযাত্রীর হেলমেট না থাকলে, ছাদে যাত্রী বা পণ্য বহন, সড়ক বা ফুটপাতে গাড়ি সারানোর নামে যানবাহন রেখে পথচারীদের চলাচলে বাধা সৃষ্টি, ফুটপাতের ওপর দিয়ে কোনো মোটরযান চলাচল করলে সর্বোচ্চ তিন মাস কারাদ- বা ৩৫ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড প্রস্তাব করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ কি শুধু কাগজপত্রের মধ্যেই সীমাবন্ধ থাকবে না কার্যক্ষেত্রে যথাযথ প্রয়োগ হবে। সাম্প্রতিক সময়ে সড়কে মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি আইন যথাযথ কার্যকর হয়েছে তা প্রমাণ করে না।

আমাদের দেশে সড়কে নিরাপত্তা, সময়ের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়গুলোর একটি। গত প্রায় দুই দশক ধরে বারবার আলোচিত হলেও এর সমাধান যেন আমাদের কাছে সবসময় সুদূর অতীত। অথচ আমাদের দেশে নিত্যদিনের যাত্রায় মানুষের নির্ভরতা সড়ক পথেই বেশি। দেশের প্রধান যোগাযোগমাধ্যমও সড়কপথ। কিন্তু সেই সড়কপথই সরচেয়ে অনিরাপদ। যাত্রী পরিবহন থেকে শুরু করে পণ্য পরিবহন সব ক্ষেত্রে সড়কপথের গুরুত্ব বেশি। তাই সড়কপথে সবচেয়ে বেশি শৃঙ্খলা ও নিরাপদ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের দেশে বাস্তব চিত্র যেন উল্টো। আমাদের সড়ক পথে নিরাপত্তা নেই, নেই শৃঙ্খলা। এর প্রভাবে সড়কে ক্রমান্বয়ে দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। অর্থাৎ বাংলাদেশে প্রায় প্রতিদিন সড়কে প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। এবং এর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বিভিন্ন সংস্থার জরিপ অনুযায়ী প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় আমাদের দেশে প্রায় ৭ থেকে ৮ হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়। অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন সারা দেশে প্রায় ১৮ জন মানুষের প্রাণহানি ঘটে সড়ক দুর্ঘটনায়। কারো কারো মতে, অবশ্য সংখ্যাটা আরো বেশি। তবে মৃতের সংখ্যা নিয়ে তারতম্য থাকলেও, এটা সত্যি সড়ক দুর্ঘটনায় কারণে দেশজ উৎপাদনে ব্যাপকভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। কারণ গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই শিশু, তরুণ ও কর্মক্ষম ব্যক্তি। বিশেষ করে তরুণ ও কর্মক্ষম এই দুই শ্রেণিকে দেশের ভবিষ্যৎ ও অর্থনীতির মূল শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাদের মধ্যে প্রায় ৬০ ভাগের চেয়ে বেশি মানুষই কর্মক্ষম। যাদের বয়স ২০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে। নিহতের পরিবার এসব কর্মক্ষম মানুষকে হারিয়ে অনেকটা দিশাহারা হয়ে পড়ে। তাদের মৃত্যুর কারণে পুরো পরিবারে দেখা দেয় এক ধরনের অনিশ্চয়তা। পাশাপাশি শুধু পরিবার নয়, তাদের হারিয়ে দেশও হয় ক্ষতিগ্রস্ত। কারণ কর্মক্ষম জনগণ যেমন পরিবারের সম্পদ, তেমনি দেশের জন্যও। সড়ক দুর্ঘটনা এবং এর প্রভাবে ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক পরিমাণের অঙ্কটাও নেহায়েত কম নয়।

তবে শুধু আইন কার্যকর করলেই হবে না। এর পাশাপাশি কিছু উদ্যোগও নিতে হবে। কারণ আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনার পেছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনার মূল কারণ সড়কে চলাচলের পরিবেশ, অদক্ষ চালক, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, চালকের অসর্তকতা, সড়ক নির্মাণে প্রকৌশলগত ত্রুটি, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অধীনস্থ সংস্থার মধ্যে দায়িত্ব পালনে অনীহা, যানবাহন ও সড়ক ব্যবহারকারী তথা চালক, যাত্রী ও পথচারীসহ সবার অসতর্কতা, সড়কের পাশে বসবাসরত জনগণের অসচতেনতার বিষয়গুলো প্রধান। এ ছাড়া দেখা যায় দেশের সব মহানগরে যত পথচারী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান, তার দ্বিগুণের বেশি মারা যান শুধু ঢাকা মহানগরে। এর পেছনেও রয়েছে অনেকগুলো কারণ। এরমধ্যে অন্যতম হচ্ছে, ঢাকায় মানুষ ও যানবাহন দুটোর সংখ্যাই বেশি। পাশাপাশি রয়েছে সব স্থানে জেব্রা ক্রসিং না থাকা, ফুটপাত না থাকা কিংবা অবৈধ দখলে চলে যাওয়া, স্বয়ংক্রিয় সংকেত ব্যবস্থার অনুপস্থিতি, পথচারী পারাপারে অব্যবস্থাপনাও অন্যতম প্রকৌশলগত ত্রুটি সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে। এসব কারণে মূলত প্রতিদিন সড়কে ঘটছে দুর্ঘটনা। এখন প্রশ্ন হলো এ থেকে উত্তরণের কি কোনো উপায় নেই? অবশ্যই এ থেকে উত্তরণ সম্ভব। তবে এ ক্ষেত্রে সবার আগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আন্তরিক হতে হবে।

সড়ক দুর্ঘটনার কারণে বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকার ক্ষতি আমাদের মতো দেশের জন্য সত্যিই অস্বস্তির খবর। যা মেনে নেওয়ার মতোও নয়। কিন্তু তা-ই যেন আমরা মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছি। এখানে জনসাধারণেরও অনেকটা দায় রয়েছে। আমরাও অনেক সময় ট্রাফিক আইন মানি না। তাই জনগণের মধ্যেও সচেতনতা আসতে হবে। সরকারের একার পক্ষে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ভূমিকা রাখতে হবে। তবে এটাও সত্যি এ ক্ষেত্রে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে সরকার, মালিক ও শ্রমিকদের। সবার আন্তরিকতায় সম্ভব দেশব্যাপী নিরাপদ সড়কপথ গড়ে ওঠা।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close