অলোক আচার্য

  ১০ আগস্ট, ২০২০

বিশ্লেষণ

চীন-মার্কিন উত্তেজনার শেষ কোথায়

করোনা মহামারির সময় সারা বিশে^র একত্রিত হওয়া খুবই প্রয়োজন ছিল। যুদ্ধ, অস্ত্র প্রতিযোগিতা, আধিপত্য বিস্তারের কৌশল, জোট পরিকল্পনা প্রভৃতি সবকিছুই সমানতালে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন দোরগোড়ায়। রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাট দুই দল থেকে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ট্রাম্প ও বাইডেন জোরেশোরে নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছেন। বিভিন্ন জরিপে বাইডেন এগিয়ে রয়েছেন। এতকিছু ছাপিয়ে যুক্তরাষ্ট্র-চীন সাম্প্রতিক দ্বন্দ্ব যাকে নতুন ¯œায়ুযুদ্ধ হিসেবে দেখা হচ্ছে আন্তর্জাতিক মহলের মনোযোগের কেন্দ্রে রয়েছে। কেন এত দ্বন্দ্ব! এই দ্বন্দ্বের শেষইবা কোথায় বা কত দিনে?

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সম্পর্কের অবনতি শুরু ২০১৮ সালে। ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণা থেকেই চীনের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে আসছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। ক্ষমতায় এসেই বাণিজ্যযুদ্ধ দিয়ে টানাপড়েনের শুরু হয়। তার প্রশাসন চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি করা পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে। এরই জবাবে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে। আর এতেই শুরু হয়ে যায় দুদেশের বাণিজ্যযুদ্ধ। তৈরি হয় উত্তেজনা। সেই উত্তেজনা আজও চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে সেই উত্তেজনা আরো তীব্র হচ্ছে। এই চলমান দ্বন্দ্বকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে। জর্জ ফ্লয়েড হত্যা এবং ফলে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন এবং মৃত্যু, করোনায় যুক্তরাষ্ট্রের বিপুল মানুষের প্রাণ হারানো এবং এ নিয়ে বিভিন্ন সময় মন্তব্য করে সমালোচনার শিকার হওয়া এবং রাজনীতিÑ এসব কিছুই ঘুরেফিরে আসছে। সম্প্রতি চীন সীমান্তের কাছাকাছি দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের সাবমেরিন বিধ্বংসী যুদ্ধবিমানের। সাংহাই থেকে ১০০ কিলোমিটারর মধ্যে ওই বিমান চলে এসেছিল। এমনটাই জানিয়েছে দক্ষিণ চীন সাগরের ওপরে নজর রাখা চীনের একটি থিংকট্যাংক।

একে অপরের কনস্যুলেট বন্ধ করার নির্দেশে এই উত্তেজনা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্প্রতি সম্পর্ক এতটাই তিক্ততায় পৌঁছায় যে, যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টনে চীনা কনস্যুলেট বন্ধ করে দেওয়ার আদেশের পাল্টাপাল্টি ব্যবস্থা হিসেবে চেংডুর মার্কিন কনস্যুলেট বন্ধ করার নির্দেশ দেয় বেইজিং। হিউস্টনের কনস্যুলেট থেকে চীন বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ চুরি করার তৎপরতা চালাচ্ছিল বলে অভিযোগ আনে মার্কিন প্রশাসন। এর আগে দুই দেশ আরো পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপ নিয়েছে। এরমধ্যে ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ, কূটনৈতিক ভ্রমণের নতুন নিয়মকানুন আর বিদেশি সংবাদদাতাদের বহিষ্কারের মতো সিদ্ধান্তও ছিল। অর্থনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন দ্ইু পরাশক্তি। যুক্তরাষ্ট্র-চীনের মধ্যে সবসময় একটি উত্তেজিত অবস্থা বিরাজ করে। কারণ দুই দেশই পরাশক্তি এবং কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। এ সমস্যার সমাধান এ রকম শক্ত অবস্থানে থেকে সম্ভব হবে না। দুপক্ষকেই ছাড় দিতে হবে এবং সহনশীল হতে হবে। কিন্তু ক্ষমতার প্রশ্নে বা প্রভাব বিস্তারের প্রশ্নে আপস করা প্রায় সময়ই কঠিন হয়। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যেকার এই টানাপড়েন শীতলযুদ্ধের দিকে এগোচ্ছে। শীতলযুদ্ধ বা ¯œায়ুযুদ্ধ সম্পর্কে পৃথিবী জ্ঞাত। কারণ দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট এবং তার মিত্রদের সঙ্গে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যেকার ¯œায়ুযুদ্ধের কথা আজও স্মরণে আছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন দুই দেশই ছিল সেসময় বিশে^ দুই পরাশক্তি। গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র মতবাদে বিভক্ত দুই পরাশক্তির এই ¯œায়ুযুদ্ধের ব্যপ্তিকাল ছিল চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি থেকে আশির দশক পর্যন্ত। আজ যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে যে বিভেদ সেখানেও দুই পরাশক্তির মধ্যে এক ধরনের শীতল লড়াই লক্ষণীয়। বাণিজ্যবিরোধ ছিল বিরোধের শুরু। এরপর মতভেদ বাড়তে থাকে। করোনাভাইরাস মহামারি নিয়েও এ দূরত্ব আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।

যে ভাইরাসকে একসময় ট্রাম্প চায়না প্লেগ বলেছিলেন। নানা অভিযোগ রয়েছে চীনের বিরুদ্ধে এই করোনাভাইরাস নিয়ে। এসবের পাশাপাশি উইঘুর মুসলিমদের মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং হংকংয়ের বিতর্কিত নতুন নিরাপত্তা আইনও রয়েছে। যদিও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের সঙ্গে ফোনে কথা বলার সময় ট্রাম্প বলেছেন, মস্কো বা বেইজিংয়ের সঙ্গে অস্ত্র সম্ভার বাড়ানোর ব্যয়বহুল প্রতিযোগিতা চায় না ওয়াশিংটন। করোনা-পরবর্তী সময়ে বিশে^র অর্থনীতি একটি নতুন জায়গায় গিয়ে দাঁড়াবে। সেখান থেকে অর্থনীতিকে চাঙা করতে হলে বিশ^কে একত্রিত হতে হবে। বাণিজ্য সুবিধা বিস্তার লাভ করাতে হবে। বাণিজ্যযুদ্ধ কেবল অর্থনীতির ক্ষতিকে বৃদ্ধি করতে পারে। ২০১৯-এর শুরু থেকে বাণিজ্যযুদ্ধে এ পর্যন্ত চীনের ক্ষতি প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলার। ক্ষতির পরিমাণ যুক্তরাষ্ট্রেরও কম নয়। উভয়পক্ষের উত্তেজনা দক্ষিণ চীন সাগরেও বিরাজ করছে।

বিশ^ নেতৃত্বে কে থাকবে বা আগামী শতাব্দীর নেতৃত্বকে দেবে তার জন্য যেন প্রস্তুতি নিচ্ছে বিশ^! যদিও বিশ^ এখন একক কর্তৃত্ব করার সুযোগ হারিয়েছে। এখন বিশ^ জোটের অন্তর্গত থাকতে পছন্দ করে। সম-মতবাদে বিশ^াসী দেশগুলো জোট গড়ে তোলে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও লন্ডন সফরে গিয়ে চীনের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ তুলে চীনকে মোকাবিলায় জোট গঠনের কথা বলেন। জিনজিয়ায় প্রদেশে সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলমান নিপীড়ন ও তাদের অধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তৃতীয় দফায় ১১টি চীনা কোম্পানিকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে। এর আগের দুই দফায় ৩৭টি চীনা প্রতিষ্ঠান কালো তালিকাভুক্ত হয়েছে। এখন করোনাকাল চলছে। বিশে^র প্রায় সব দেশই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত। এ থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে হবে। ভ্যাকসিন আবিষ্কারের সফলতার খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে মানবজাতি। ইতোমধ্যেই চীন কোভিড পরিস্থিতি মোকাবিলা এবং করোনা সংকটের জেরে ক্ষতিগ্রস্ত আর্থিক বৃদ্ধির গতি পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় তিন দেশ (পাকিস্তান, নেপাল ও আফগানিস্তান) নিয়ে একটি নতুন জোট গড়তে চলেছে। এ সময় অবশ্যই সবাইকে নিয়েই পথ চলতে হবে। ভারতের সঙ্গে ঝামেলা শুরুর পর থেকে চীন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে আরো বেশি ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে শুরু করেছে। এভাবেই ক্ষমতা বা আধিপত্যের প্রতিযোগতা চলে আসছে। কীভাবে এর সমাধান হয়ে বিশ^শান্তির পথে অগ্রসর হবে তা ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। তবে যুক্তরাষ্ট্র-চীনের এই দ্বৈরথ থামলে বা সমতা প্রতিষ্ঠিত হলে পুরো বিশ^ই স্বস্তি লাভ করবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close