প্রকৌশলী রিপন কুমার দাস

  ১০ আগস্ট, ২০২০

মুক্তমত

পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধিতে চাই সুষ্ঠু নীতিমালা

দেশে ও বিদেশের শ্রমবাজারের বিকাশমান এবং পরিবর্তনশীল পেশাগত দক্ষতা যথাযথভাবে প্রতিফলিত করার জন্য বর্তমান জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতিমালা-২০১১-এর আওতায় জাতীয় কারিগরি ও বৃত্তিমূলক যোগ্যতা কাঠামো (NTVQF) পরিচালিত হচ্ছে। ২০১১ সালের নীতিমালাকে আরো যুগোপযোগী করার জন্য জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতিমালা-২০২০ চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। বর্তমান নীতিমালার ৫.৩ ধারায় জাতীয় কারিগরি ও বৃত্তিমূলক যোগ্যতা কাঠামোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি পর্যন্ত (তবে ডিগ্রি অন্তর্ভুক্ত না করে) বিভিন্ন অর্জন ও যোগ্যতা শনাক্ত করে একটি অভিন্ন জাতীয় মান তৈরি করা হয়েছে। যা বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান, বিদ্যালয়, প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান এবং কর্মক্ষেত্রের দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণকে NTVQF অন্তর্ভুক্ত করতে সাহায্য করছে। প্রকৃতপক্ষে নীতিমালায় বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব একাডেমিক ডিগ্রি অন্তর্ভুক্ত করা একান্ত প্রয়োজন, এখানে উল্লেখ্য NTVQF স্তর-৬ এ ডিপ্লোমা প্রকৌশল/সমমান দেখানো হয়েছে ঠিকই, কিন্তু জাতীয় সক্ষতা সনদে তা দেখানো হয়নি। তাই প্রাথমিক থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে সংযুক্ত ভোকেশনাল ও কারিগরি শিক্ষাকে NTVQF স্তরে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।

নীতিমালার ৫.৬ এ সাধারণ শিক্ষায় ঢোকার আরো রাস্তা তৈরি এবং সমাজের স্বল্প সুবিধাভোগী এবং স্বল্প শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে সমাজের মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য NTVQF দুটি প্রাক-বৃত্তিমূলক স্তর। এতে পাঁচটি বৃত্তিমূলক স্তর এবং ডিপ্লোমা পর্যায়ের যোগ্যতার জন্য একটি স্তর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ১. জাতীয় কারিগরি ও বৃত্তিমূলক যোগ্যতা কাঠামো। ২. জাতীয় প্রাক-বৃত্তিমূলক সনদ। ৩. জাতীয় সক্ষমতা সনদ।

দেশের উন্নয়নের স্বার্থে সাধারণ শিক্ষার পরিবর্তে একাডেমিকভিত্তিক বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষায় ঢোকার আরো রাস্তা তৈরি করতে হবে। এ ছাড়া স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের যোগ্যতাকে NTVQF এর অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। নীতিমালার ৫.৭-এ সাধারণ শিক্ষায় দ্বৈত সনদায়ন পদ্ধতি চালুর কথা বলা হয়েছে, যেমন এসএসসি ভোকেশনাল, এইচএসসি ভোকেশনাল ও এইচএসসি ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা কোর্স সন্তোষভাবে শেষ করার পর সাধারণ শিক্ষার যোগ্যতার পাশাপাশি NTVQF সনদ দেওয়া হবে মর্মে বলা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় এসএসসি ভোকেশনাল শিক্ষাক্রমকে এনএসসি-৩ ও এইচএসসি ভোকেশনাল শিক্ষাক্রমকে এনএসসি-৪ মান প্রদান করা হলেও এইচএসসি ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা কোনো মান প্রদান করা হয়নি। এ ছাড়া বর্তমানে এসএসসি ভোকেশনাল, এইচএসসি ভোকেশনাল ও ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং বা সমমান ডিগ্রি ফ্রেমওয়ার্কের লেভেলে অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে অনেক অসংগতি লক্ষ করা যায়।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বর্তমানে এসএসসি ভোকেশনাল শিক্ষাক্রমকে NTVQF লেভেলের NSC-3 মান প্রদান করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সিভিল কনস্ট্রাকশন ট্রেডকে NTVQF লেভেলের NSC-3 মান প্রদান করা হয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশ ন্যাশনাল কোয়ালিফিকেশন ফ্রেমওয়ার্কের আওতায় সিভিল কনস্ট্রাকশন নামে কোনো ট্রেড বা পেশা নেই, তাহলে কীভাবে এই মান প্রদান করা হয়েছে তা বোধগম্য নয়। বর্তমানে এসএসসি ভোকেশনাল শিক্ষাক্রমে সিভিল কনস্ট্রাকশন ট্রেডটিতে ম্যাশনারি, কনস্ট্রাকশন পেইন্টিং, রোড, বার বাইন্ডিং অ্যান্ড ফিক্সিং, কনস্ট্রাকশন ইলেকট্রিশিয়ান, টাইলস ওয়ার্ক, অ্যালুমিনিয়াম ফেব্রিকেশন, ইন্টোরিয়ায় অ্যান্ড এক্সটোরিয়ার ফিনিসড (ফলস সিলিং, ড্রাই ওয়াল ইন্সটেলর ও ফ্যাসাড ইন্সটেলর), প্লান্ট অ্যান্ড মেশিনারি, সাটারিং কার্পেনট্রি, ফেব্রিকেশন, স্ক্যাফোল্ডিং, প্রি স্ট্রেরেসিং, সিভিল ড্রাফটিং, সার্ভেয়িং, কোয়ালিটি কন্টোল, রেইনফোর্সমেন্টসহ ১৭টি পেশা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

বর্তমানে প্রচলিত ফ্রেমওয়ার্কটি অসম্পূর্ণ এখানে মাত্র প্রি-ভোকেশনাল থেকে ৬টি স্তর দেওয়া আছে। আবার ভোকেশনাল ও কারিগরি শিক্ষার সঙ্গে সমন্বয় করতে গিয়ে শুধু ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং বা সমমান ডিগ্রি পর্যন্ত অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ভোকেশনাল শিক্ষার ব্যাচেলর বা মাস্টার্স ডিগ্রি ও কারিগরি শিক্ষার ব্যাচেলর বা মাস্টার্স ডিগ্রিকে ফ্রেমওয়ার্কের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। যা দেশের দক্ষতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অন্তরায় হিসেবে দেখা দিতে পারে, তাই কারিগরি শিক্ষার সব একাডেমিক সনদকে ফ্রেমওয়ার্কের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতিমালা-২০২০-এ ভোকেশনাল শিক্ষার প্রাথমিক স্তর অর্থাৎ ৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি ও কারিগরি শিক্ষার ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং বা সমমান ডিগ্রি থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি পর্যন্ত ফ্রেমওয়ার্কের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। তাই বাংলাদেশ ন্যাশনাল কোয়ালিফিকেশন ফ্রেমওয়ার্ক ও বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সব শিক্ষাক্রমের সিলেবাস পুনর্গঠন করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদার ভিত্তিতে যুগোপযোগী পেশার পরিমার্জন করা একান্ত প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বর্তমানে এসএসসি ভোকেশনাল শিক্ষাক্রমের সিভিল কনস্ট্রাকশন ট্রেডে ট্রেড-১ ও ট্রেড-২ বিষয় রয়েছে, যার পরিবর্তে এখন ট্রেড-১, ট্রেড-২ ও ট্রেড-৩ নামে ৩টি বিষয় চালু করা যেতে পারে। ট্রেড-১ বিষয়ে থাকবে ম্যাশনারি পেশা বা ট্রেড, অনুরূপভাবে ট্রেড-২-এ রড বাইন্ডিং পেশা বা ট্রেড ও ট্রেড-৩ এ সিভিল ডিজাইন ও ড্রাফটিং পেশা বা ট্রেড অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। এ ছাড়া NTVQF লেভেলের NSC-3 মানের পরিবর্তে NSC-2 মান প্রদান করতে হবে। তাহলে সিভিল কনস্ট্রাকশন ট্রেডের শিক্ষার্থী পর্যায়ক্রমে NTVQF লেভেলের NSC-2 মান এর ৩টি বিষয়ে ৬টি সনদ প্রাপ্ত হবেন, যা অনেকটা বাস্তবসম্মত হবে।

এ ছাড়া ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং বা সমমান শিক্ষাক্রমকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর ভিত্তি করে বৃত্তি বা পেশার উপযোগী করে সিলেবাস প্রণয়ন করতে হবে, এ ক্ষেত্রে প্রতিটি টেকনোলজির জন্য ১১টি পেশা নির্ধারণ করা যেতে পারে। এরমধ্যে ৩টি হবে কোর পেশা বা ট্রেড এবং ৮টি হবে মূল পেশা বা ট্রেড। ৩টি কোর পেশাকে NTVQF লেভেলের NSC-5 ও ৮টি মূল পেশার ৩টি ট্রেডকে NTVQF লেভেলের NSC-5 এবং ৫টি ট্রেডকে NTVQF লেভেলের NSC-6 এর মান প্রদান করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সিভিল টেকনোলজির জন্য কোর বিষয় হিসাবে NTVQF লেভেলের ট্রেড (কোর)-১-কনস্ট্রাকশন ইলেকট্রিক্যাল, ট্রেড (কোর)-২- মেশিন টুলস অপারেশন, ট্রেড (কোর)-৩-কম্পিউটাল অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স বিষয় নির্ধারণ করা যেতে পারে। আর মূল বিষয় হিসাবে ম্যাশনারি, কনস্ট্রাকশন পেইন্টিং, রোড অ্যান্ড রানওয়ে, বার (রড) বাইন্ডিং অ্যান্ড ফিক্সিং, টাইলস ওয়ার্ক, অ্যালুমিনিয়াম ফেব্রিকেশন, ইন্টোরিয়ার অ্যান্ড এক্সটোরিয়ার ফিনিসড, প্লান্ট অ্যান্ড মেশিনারি, সাটারিং কার্পেনট্রি, রিগিং, ফেব্রিকেশন, স্ক্যাফোল্ডিং, প্রি স্ট্রেরেসিং, সিভিল ডিজাইন ও ড্রাফটিং, আর্কিটেকচারাল ডিজাইন ও ড্রাফটিং, সার্ভেয়িং, কোয়ালিটি কন্টোল, এনভায়রনমেন্ট হেলথ অ্যান্ড সেফটি, রেইনফোর্সমেন্ট ইত্যাদি ট্রেডের মধ্য হতে প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে যেকোনো ৮টি ট্রেড বা পেশা নির্ধারণ করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে বিষয়সমূহ ট্রেড (মূল)-১, ট্রেড (মূল)-২, ট্রেড (মূল)-৩, ট্রেড (মূল)-৪, ট্রেড (মূল)-৫, ট্রেড (মূল)-৬, ট্রেড (মূল)-৭ ও ট্রেড (মূল)-৮ নামে বিভক্ত করা যেতে পারে। এ ছাড়া ই.ঞবপয ও গ.ঞবপয শিক্ষাক্রমের ক্ষেত্রে অনুরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।

এ ছাড়া বর্তমানে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এসএসসি ও এইচএসসি ভোকেশনাল শিক্ষাক্রম সাধারণ শিক্ষা ও জাতীয় দক্ষতা মান সমন্বয়ে গঠিত। যেখানে কোনো শিক্ষার্থী কোনো শ্রেণির সব বিষয় উত্তীর্ণ হলে অথবা শুধু ট্রেড বিষয়ে উত্তীর্ণ হলেও বোর্ড নির্ধারিত নম্বরের স্কিল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে উত্তীর্ণ হলে ওই শ্রেণির জন্য জাতীয় দক্ষতা মান সনদ প্রদান করা হবে এর স্থলে প্রস্তাবিত নিম্ন মাধ্যমিক থেকে প্রস্তাবিত স্নাতকোত্তর পর্যন্ত ভোকেশনাল অথবা ডিপ্লোমা স্তরের কোনো শিক্ষার্থী কোনো শ্রেণির সব বিষয়ে উত্তীর্ণ হলে অথবা শুধু ট্রেড- (সব) (১ম পত্র/২য় পত্র/৩য় পত্র) বিষয়ে বোর্ড নির্ধারিত জঞঙ হতে ঘঞছঠঋ লেভেলের নির্ধারিত ঘংপ স্কিল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে উত্তীর্ণ হলেই ওই ট্রেড- (সব) (১ম পত্র/২য় পত্র/৩য় পত্র) বিষয়ে ঘঞছঠঋ লেভেলের নির্ধারিত ঘংপ সনদ প্রদান ও ওই বিষয়ের ব্যবহারিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হিসাবে গণ্য করা হবে মর্মে নতুন নিয়ম সব প্রবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। তবেই সত্যিকার অর্থে দক্ষ জনবল তৈরি করে সনদ প্রদান করা সম্ভব হবে। ভোকেশনাল ও কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থায় যদি NTVQF লেভেল পুনর্গঠন করে যুগোপযোগী করা যায়, তবে দেশের তরুণ ও যুবসমাজকে সত্যিকারের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যাবে ও শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা হ্রাস পাবে।

লেখক : ট্রেড ইনস্ট্রাক্টর

ডোনাভান মাধ্যমিক বিদ্যালয়, পটুয়াখালী

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close