reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ০৮ আগস্ট, ২০২০

ফিরে দেখা

ঐতিহ্য ফিরে পাচ্ছে নদীপথ

মো. কায়ছার আলী

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। ছোট-বড় মিলে ১৩৫০টি নদ-নদী এ দেশে আছে। তাই তো এ দেশকে নদীমাতৃক বলা হয়। ধরিত্রীকে জননী আর নদীকে বলা হয় বোন। ছোটবেলায় পাঠ্যবইয়ে পড়েছি পৃথিবীতে তিন ভাগ জল আর এক ভাগ স্থল। তাইতো পানির অপর নাম জীবন। খাল, বিল, নদী, নালা, হাওর, বাঁওড়-পানি তার বক্ষে ধারণ করে। সেই প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকে নদ-নদীগুলো ছিল বাধাহীন। তাদের গতিপথ ছিল উন্মুক্ত। শহর, বন্দর, গঞ্জ, হাটবাজার এমনকি সভ্যতা নদ-নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। সিন্ধু নদের তীরে সিন্ধু সভ্যতা ২৭০০ খ্রি. পূর্বে দুটি নগর হরপ্পা মহেঞ্জোদারো। ২৪০০ বছর আগে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে উয়ারী বটেশ্বর। করতোয়া নদীর তীরে ২৪০০ বছর আগে মহাস্থানগড় (পুন্ড্রনগর)। ৫০০০ বছর আগে নীলনদের তীরে মিসরীয় সভ্যতা। খ্রিস্টপূর্বে ৪০০০ অব্দে ইরাকের টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর তীরে মেসোপটেমীয় সভ্যতা। ২০০০ খ্রি. পূর্বে হোয়াংহো ও ইয়াংসিকিয়াং নদীর তীরে চীন সভ্যতা।

প্রধান প্রধান রাজধানী শহরগুলো নদীর তীরে যেমন টেমস নদীর তীরে লন্ডন, মস্কোভা নদীর তীরে মস্কো, সীন নদীর তীরে প্যারিস, হাডসন নদীর তীরে নিউইয়র্ক, হুগলী নদীর তীরে কলকাতা ও বুড়িগঙ্গার তীরে ঢাকা আর আমাদের প্রাণের শহর দিনাজপুর পুনর্ভবা নদীর তীরে। বিশাল জলরাশির ধারক ও বাহক নদী। আজ নদ-নদীগুলোর করুণদশা। পরিবেশ, প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য, কৃষিকাজ এবং দেশের মানুষের জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে চরম সমস্যার বিষয় যেমনÑ বর্ষায় বন্যা, শুষ্ক মৌসুমে পানিশূন্যতা যেটি দেশের নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিছু লোকের অপকর্ম তথা অবৈধ দখল বা স্থাপনা নির্মাণের ফলে নদীগুলো স্বাভাবিক চলার পথে বাধা পাচ্ছে। আবার কল-কারখানার ময়লা বর্জ্য পদার্থ মিশে নদীর পানিকে ভয়াবহ দূষিত করে ব্যবহারের অনুপযোগী করছে। দেশের ছোট-বড় সব শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলো আজ নালা বা ঘাগড়ায় পরিণত হয়েছে। অবৈধ দখলের ফলে সামান্য বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতায় গ্রাস করছে পুরো শহরকে। ফলে বিষময় হয়ে উঠছে পরিবেশ। কোথাও ব্রিজের কাছে অবৈধ বালু উত্তোলন করে ব্রিজগুলোকে হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। অথচ নদীর ওপর ব্রিজ উঁচু করে পরিকল্পনামাফিক তৈরি করা হয়েছে এজন্য যে, বর্ষা বা অন্য যেকোনো সময় ব্রিজের নিচ দিয়ে নৌকা, লঞ্চ, স্টিমার, পানি জাহাজ যেন অনায়াসে চলাচল করতে পারে।

‘বাঁচলে নদী বাঁচবে দেশ, বাঁচবে সবুজ পরিবেশ’- এ মহান লক্ষ্য সামনে রেখে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় আজ কাজ করে যাচ্ছে। নদী শাসন পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাজ, ভূমির দায়িত্বে ভূমি মন্ত্রণালয়, পরিবেশ রক্ষার দায়িত্বে আছে পরিবেশ মন্ত্রণালয়। তাই সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। দেশরতœ প্রধানমন্ত্রীর সাহসিকতা ও সমর্থনের কারণে নদীতীর দখলমুক্ত করার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় আর্তনাদ ও মুমূর্ষু বুড়িগঙ্গা এবং তুরাগ নদের তীররক্ষা প্রকল্প বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে। নদীর তীর দখলকারীরা শক্তিশালী ও ক্ষমতাবান, কিন্তু এর চেয়েও বেশি ক্ষমতাবান সরকার। নদী দুটি ৯০ ভাগ দখলমুক্ত করে আজ সীমানা, পিলার, পাকা দেয়াল এবং ওয়ার্কওয়ের কাজ দৃশ্যমান। সরকারের মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী, ঢাকার মধ্য দিয়ে নৌ চলাচলের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীরক্ষার পাশাপাশি তার মন্ত্রণালয়ের অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত সবকিছুই তীক্ষèভাবে দেখভাল করছেন, উন্নয়ন করছেন। তিনি যথার্থই বলেছেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের লাইফলাইন। তাই চট্টগ্রাম বন্দর উন্নয়নে আমাদের দায়বদ্ধতা আছে’। চট্টগ্রাম বন্দরের আওতায় মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, বে-টার্মিনাল, পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালসহ (পিসিটি) অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দরকে ৬৪তম থেকে ৩০-৫০তম স্থানে সরকার নিয়ে যেতে চায়। ঢাকা সদরঘাট ওপারে ডকইয়ার্ড স্থানান্তরের কর্মকান্ড চলমান।

গত ২৯ জুন বুড়িগঙ্গায় লঞ্চ দুর্ঘটনা না ঘটে পরিকল্পিত হত্যাকান্ড ঘটে। ব্যাপক বা প্রবল স্রোত, কালবৈশাখী, ঘন কুয়াশা, অন্ধকার রাতে দিক হারিয়ে ফেলা, যান্ত্রিক ত্রুটি, অতিরিক্ত যাত্রী ও পণ্যবোঝাইয়ের কারণে নৌ-দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু সেদিন ময়ূর-২ লঞ্চটি হঠাৎ করেই মর্নিং বার্ড লঞ্চের দিকে তেড়ে আসছিল এবং পেছন দিক থেকে জোরে ধাক্কা দিলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই লঞ্চটি ডুবে। ঘটনার পর ময়ূর-২ লঞ্চের মাস্টার, ড্রাইভার ও সুকানিকে দায়ী করা হয়। বর্তমানে মামলায় ঘাতক ময়ূর-২ লঞ্চের সুকানি নাসির মৃধা আদালতে দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন। অপরদিকে লঞ্চের ইঞ্জিন চালক মো. শিপন হাওলাদার ও মো. শাকিল হাওলাদারকে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। লঞ্চের মালিক প্রধান আসামি মোসাদ্দেক সোয়াদকে আগেই গ্রেফতার করা হয়েছে।

আজ সরকার শত বছরের ডেল্টাপ্ল্যান কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। কার্যকর নদী ব্যবস্থাপনায় নদীমাতৃক এ দেশে ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ খননসহ বা ঢেলে সাজিয়ে নদীর বিলুপ্ত হওয়া গতিপথ ফিরিয়ে এনে নদীর নাব্য বজায় রাখার তথা সোনালি হারানো অতীত ফিরিয়ে আনার জন্য সরকার কাজ করে যাচ্ছেন। সরকার তার এ কাজে সফল হবেনÑ এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close