reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ০৮ আগস্ট, ২০২০

মুক্তমত

চামড়া ও পাটশিল্পকে বাঁচাতে চাই

আবু আফজাল সালেহ

বিপুল সম্ভাবনাময় শিল্প হচ্ছে চামড়াশিল্প। কিন্তু সুযোগসন্ধানী সিন্ডিকেট এ শিল্পকে নষ্ট করে দিচ্ছে। ঈদুল আজহায় দেশে সিংহভাগ চামড়া আহরিত হয়। ঈদুল ফিতরেও কিছুটা। সারা বছর ঢিমেতালে চামড়া সংগ্রহ হয়। আর সুযোগসন্ধানীরা ঈদের সময়কেই বেছে নেয়। সিন্ডিকেট তৈরি করে। আরো একটি কারণ আছে। মাঠপর্যায়ের ক্রেতা-বিক্রেতা চামড়া সংরক্ষণে দক্ষতার অভাব। চামড়ার সুদিন আনতে হলে সিন্ডিকেট ভাঙতেই হবে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের চামড়া সংরক্ষণের ওপর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। পাটকে সোনালি আঁশ বলা হত। কিন্তু এখন ধুঁকছে, মৃতপ্রায়। পাটের হারানো সেই সোনালি দিন ফিরিয়ে আনতে পারলে দেশের অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার হবে। এজন্য আমাদের বিভিন্ন মেয়াদি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। পাটের বহুমুখীকরণ করতে হবে। চামড়ার মতো পাঠের আঁশ সংগ্রহ ও সংরক্ষণেও তৃণমূল পর্যায়ে দক্ষতার অভাব আছে।

একসময় পাট ছিল আমাদের একমাত্র রফতানি পণ্য। কিন্তু বিদেশি চক্রান্ত ও সুদক্ষ পরিচালনা ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাবে প্রায় মরে গেছে এ শিল্প। বর্তমান সরকার এ খাতকে গতি সঞ্চার করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। যার ফলও আমরা হাতেনাতে পাচ্ছি। সম্প্রতি পাটের উৎপাদন বাড়ছে। কৃষিজমির হ্রাস নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। প্রয়োজনে ‘পাট চাষ জোন গড়ে তোলা যেতে পারে। পাটপণ্যের পাশাপাশি হরেক, বাহারি, নিত্যব্যবহার্য, ফ্যাশনেবল বহুমুখী পাটসামগ্রীর প্রসার ও বিপণন এ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন গতি সঞ্চার করেছে। বাংলাদেশ বিশ্বের মোট পাটের ৩৩ শতাংশ উৎপাদন করে এবং কাঁচাপাটের প্রায় ৯০ শতাংশই রফতানি করে। আমাদের ব্যবহারিক জীবনে পাটের গুরুত্ব অপরিসীম। এই পাট থেকে উৎপাদিত পণ্য (যেমন- বস্ত্র, থলে, দড়ি, কাছি, সূক্ষè বস্ত্র ও কার্পেট প্রভৃতি) আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে প্রতিনিয়ত ব্যবহার হয়ে থাকে। এই বাংলাদেশের পাট থেকে তৈরি জুট পৃথিবীর নানা দেশে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছে। আমাদের পাটকলের তৈরি কার্পেট পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে এখনো বিশেষভাবে সমাদৃত। এ ছাড়া পাটের তৈরি ঝুড়ি, শিকে এবং কারুকাজশোভিত অন্যান্য দ্রব্য বিদেশিদের শুধু দৃষ্টি কাড়ছে। এগুলো রফতানি করে বাংলাদেশ এখনো যথেষ্ট পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। বাজারে পাটের তৈরি চালের বস্তা ও সুতলি থেকে গত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় প্রায় ১০০ কোটি টাকার বহুমুখী পাটপণ্যের বাজার সৃষ্টি হয়েছে।

পাটের বহুমুখীকরণ করতে হবে। পাটের বহুমুখীকরণ যত বাড়ানো , ততই এর অর্থনীতিতে অবদান বাড়বে। শুধু পাটেই নয়, যেকোনো পণ্যের ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য। আমরা যতই আধুনিক হচ্ছি, ততই রুচিবোধে ভেরিয়েশন আসছে। আর এ কারণেই বহুমুখীকরণ ছাড়া অন্য উপায় কম ফলপ্রসূ হবে। মানুষের রুচির ব্যাপক পরিবর্তন হচ্ছে এবং তা অতি দ্রুততার সঙ্গে পরিবর্তন হচ্ছে। খাপখাওয়াতে তাই পাটের বহুমুখীকরণে সুষ্ঠু পরিকল্পনা দরকার। পাটের মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন-২০১০ ও বিধিমালা-২০১৩ আছে। পলিথিন উৎপাদন, বিপণন, ব্যবহার বন্ধ ও পাটপণ্যের মোড়ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের লক্ষ্যে চাহিদা অনুযায়ী গুণগত মানস¤পন্ন পণ্য উৎপাদন এবং এর প্রচার বাড়াতে হবে। মানসম্মত পাট উৎপাদন, পাটের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ, পাটপণ্যের বহুমুখীকরণ, পাটকলের আধুনিকায়ন, পাটপণ্যের বাজার সম্প্রসারণÑ এই পাঁচটি বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে জাতীয় পাটনীতি-২০১৮-এর অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। পাটের গুরুত্বের বিষয়টি সরকারের আন্তরিকতা প্রশ্নাতীত। কারণ বর্তমান সরকারের উদ্যোগে ২০১৭ সালেই সর্বপ্রথম ৬ মার্চকে জাতীয় পাট দিবস হিসেবে পালন করা হয়। সরকার ২০১০ সাল পাটজাত মোড়কের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করেছে। দেশ-বিদেশে পাটের বাজার পুনরুজীবিত করতে পাট আইন-২০১৭ যথাযথ বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই।

পাটের উন্নয়ন ও বহুমুখীকরণের জন্য প্রশিক্ষণের পাশাপাশি দরকার গবেষণা। এ ক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে। কৃষিক্ষেত্রে প্রচুর গবেষণা হয়। তার ফলেই কৃষিতে আমাদের প্রচুর উন্নতি হয়েছে। আসলে কোনো বিষয়/সেক্টরে উন্নয়নের জন্য প্রচুর গবেষণার ক্ষেত্র থাকতে হবে। অদৃশ্য এ উন্নয়নে আমাদের জোর দিতে হবে। এটা অবশ্য সব সেক্টরের জন্য প্রযোজ্য। ভালো মানের বীজের অভাব সব সময়েই থাকে। পাটচাষ, সংরক্ষণ ও বিতরণের উন্নয়নে কৃষিঋণের সহজীকরণ করতে হবে। প্রয়োজনে ব্যাংকগুলোর ওপর তদারকি বাড়াতে হবে। পাটের কম দাম পান প্রান্তিক কৃষক। কৃষকের চেয়ে মধ্যস্বত্বভোগীদের বেশি লাভবান হয়। অনেক ক্ষেত্রে বিনা পুঁজিতে কৃষকের মাথায় ব্যবসা করে থন তাদের কোনো লোকসানের ভয় নেই; কিন্তু কৃষকের লোকসানের আশঙ্কা থাকে। তারা আবার সিন্ডিকেটও তৈরি করে থাকেন। কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি পাট ক্রয়ের ব্যবস্থা বাড়াতে হবে। এসব নেতিবাচক দিকগুলো শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করা আজ জরুরি হয়ে পড়েছে। এতে কৃষকরা লাভবান হবেন এবং পাটচাষে ঝুঁকবেন। পাটসংশ্লিষ্ট কুটির শিল্পের জোরদারকরণ প্রকল্প হাতে নিতে হবে। দক্ষ জনবল নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে বহুমুখীকরণে তাড়াতাড়ি ফল পাব আমরা। তাদেরও পুনঃপুনঃ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ থেকে দক্ষতর জনবল হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তাহলে বৈচিত্র্য আনাটাও সম্ভব হবে। সরকারের নতুন নতুন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে দ্রুত খাপখাওয়াতে পারবে তারা। পাট ও পাটসামগ্রী বিপণনে হাটবাজার সম্প্রসারণ করতে হবে, গুদাম মেরামত বা নতুন তৈরি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য সংশ্লিষ্টদের মধ্যে ব্যাংকগুলোকে স্বল্পসুদে ঋণের ব্যবস্থাকরণের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদানের ব্যবস্থা রাখতে হবে।

সোনালি ব্যাগের প্রসারের ব্যবস্থা করতে হবে। ক্ষতিকারক পলিথিনের ব্যবহার কমিয়ে এতে আকৃষ্ট করতে হবে। প্রয়োজনে প্রথমদিকে সোনালি ব্যাগের উন্নয়ন/ব্যবহারে ভর্তুকির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। আমদানি করা পচনশীল পলিমার ব্যাগের যে দাম তার পাঁচ ভাগের এক ভাগ দামেই পাওয়া যাবে সোনালি ব্যাগ। বর্তমানে এক কেজি পলিথিন তৈরি করতে ২০০-২৫০ টাকা খরচ হয়। এর চেয়ে ৫০-১০০ টাকা বেশিতেই পাওয়া যাবে প্রতি কেজি সোনালি ব্যাগ। ব্যাগটির দাম কমিয়ে দেবে মূলত এর বিভিন্ন বাই-প্রডাক্ট (উপজাত)। এর গুরুত্বপূর্ণ দুটি বাই-প্রডাক্ট হলো লিগনিন ও হেমোসেলুলোজ। বিভিন্ন ধরনের কসমেটিক সামগ্রী তৈরিতে ব্যবহার করা হয় লিগনিন। এটি ভালো দামে বিক্রি হবে। আর হেমোসেলুলোজ সার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পাটের যে আঁশ এই ব্যাগ তৈরিতে ব্যবহার করা হয় তার মাত্র ২-৩ শতাংশ উচ্ছিষ্টাংশ হিসেবে বেরিয়ে আসবে। বাকি ৯৭-৯৮ শতাংশই হবে কোনো না কোনো প্রডাক্ট। পাট একটি পরিবেশবান্ধব পণ্য। পরিবেশবিনাশী পলিথিন এমন একটি রাসায়নিক বস্তু যা পচনশীল নয়। এটি পোড়ালেও দুর্গন্ধযুক্ত ধোঁয়া বের হয়ে পরিবেশ নষ্ট করে দেয়। এটি যেখানে পড়ে থাকে, সেখানে থেকেই কৃষি ফসলের জমিতে মাটির রস চলাচলে বাধার সৃষ্টি করে। বিভিন্ন খাল-বিল, নদী-নালা, ড্রেন, নর্দমাÑ সব জায়গায় পরিত্যক্ত পলিথিন জমে জমে পানি চলাচলে বাধা সৃষ্টি হয়ে স্থায়ী জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে থাকে। সেজন্যই পলিথিনের বিকল্প হিসেবে শুধু বাংলাদেশে নয়, আমাদের প্রতিবেশী ভারতসহ বিশ্বের অনেক দেশে ‘ক্যারিং ব্যাগ’ হিসেবে পাটের তৈরি ব্যাগ ব্যবহার করা হচ্ছে।

পাটের কোনো কিছুই ফেলনা নয়। ছোট-বড় সবধরনের পাটগাছ থেকে পাতা নিয়ে পুষ্টিকর পাটশাক খাওয়া যায়। এ পাটশাক শুকনো হিসেবেও দীর্ঘদিন ঘরে সংরক্ষণ করে খাওয়ার সুযোগ থাকে। পাটের পুরো মৌসুমে জমির মধ্যে যে পাতা পড়ে, তা উক্ত জমির জৈব পদার্থযোগে উর্বরতা বাড়াতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। পাটের শিকড়, গাছ, পাতা থেকে সার যোগ হলে পরবর্তী ফসল আবাদে ওই জমিতে আর কোনো বাড়তি সার প্রয়োগের প্রয়োজন পড়ে না। জনগণের মধ্যে দেশীয় পণ্যের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টিতে নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া। সর্বনাশা পলিথিনের ব্যবহার স¤পূর্ণরূপে বন্ধ করে সুলভ ও আকর্ষণীয় পাটপণ্য তৈরি করার প্রতি জোর দিতে হবে। এজন্য শ্রম ব্যবস্থাপনায় আধুনিক ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ, শ্রমিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে অধিক মনোযোগ দিতে হবে। পাটশিল্পে দক্ষ কর্মী সৃষ্টিতে অধিক ডিপ্লোমা ইনস্টিটিউট স্থাপন করা দরকার। পাট একটি পরিবেশবান্ধব বস্তু। পাট থেকে উন্নত মানের ভিসকস সুতা উৎপাদন হয়। যার সুতি কাপড় থেকেও বাজারমূল্য বেশি। পাটখড়ি জ্বালানির প্রধান উৎস হলে কয়েক বছর ধরে পাটখড়ির চারকোল বিদেশে রফতনি হচ্ছে, আয় হচ্ছে হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে পাট থেকে তৈরি হচ্ছে চা। এতে জীবন রক্ষাকারী উপাদান আছে।

বর্তমানে বাংলাদেশের পাটশিল্পে বেশকিছু সমস্যার কথা আগেই উল্লেখ করেছি। এ ছাড়া স্থবিরতা বা মূল্যহ্রাসের পরিপ্রেক্ষিতে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি; পুরোনো যন্ত্রপাতির উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস, শ্রমিক সমস্যা, বহু বিস্তৃত দুর্নীতি, অদক্ষ ব্যবস্থাপনা, মূলধন ঋণে উচ্চ সুদের হার আদায়, রাষ্ট্রায়ত্ত মিলে অদক্ষ ব্যবস্থাপনা, অনিয়ন্ত্রিত অপচয়, বিদ্যুৎ ঘাটতি, অদক্ষ বা আধা দক্ষ শ্রমিক, অধিক জনবল নিয়োগ, জবাবদিহির অভাব, রুগ্ণ ট্রেড ইউনিয়ন চর্চা ইত্যাদি সমস্যা এ শিল্পের জন্য অন্তরায়। এ বিষয়গুলো ভালোভাবে দেখতে হবে বা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পাটকলগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর বিশদ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। দেশে ও বিদেশে পাটের বাজার বাড়াতে পাটজাত পণ্যের প্রদর্শনী, মেলা ও প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে। বিভিন্ন দূতাবাসের মাধ্যমে বিদেশে প্রচারের কাজ ত্বরান্বিত করাও জরুরি। আমাদের টেকসই উন্নয়নের জন্য সুষ্ঠু কর্মপরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। কোয়ালিটি উন্নয়ন করতে হবে পণ্যে। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন পর্যায়ে প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। যত প্রশিক্ষণ তত দক্ষ জনবল তৈরি হবে। বিভিন্ন পরিকল্পনা প্রণয়নে সহায়তা করবে। আর দরকার জনসচেতনতা সৃষ্টি। ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে পলিথিন বা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক জিনিসপত্র ব্যবহারে অনুৎসাহিত করে ইতিবাচক জনমত গড়ে তুলতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারি-মিডিয়া-বেসরকারি সেক্টর সবাইকে আন্তরিকতার সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলে আমরা ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারব। ইতোমধ্যে সবার প্রচেষ্টাই আমরা সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সফল হয়েছি।

লেখক : কবি ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close