reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ০৭ আগস্ট, ২০২০

মুক্তমত

চিকিৎসাসেবা থেকে রোগীদের বঞ্চিত করা অপরাধ

আর কে চৌধুরী

উন্নয়নশীল বিশ্বের যেসব দেশে সরকারি ও বেসরকারি খাতের সমন্বয়ে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়, সেসব দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে মিশ্র স্বাস্থ্যব্যবস্থা বলা হয়। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অধিদফতর ও সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর মাধ্যমে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়। অন্যদিকে, ব্যক্তিমালিকানাধীন ক্ষুদ্র ও বৃহৎ প্রতিষ্ঠান এবং এনজিওগুলো বেসরকারি খাতে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে থাকে। বেসরকারি খাতের স্বাস্থ্যসেবা দানের জন্য ১৯৮২ সালের মেডিকেল প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস অ্যান্ড ল্যাবরেটরিজের (রেগুলেশন) ৪ নম্বর অর্ডিন্যান্সের অধীন লাইসেন্স প্রদান ও নবায়ন করে স্বাস্থ্য অধিদফতর। আর এর আওতায় পরিচালিত হচ্ছে দেশের বেসরকারি চিকিৎসাব্যবস্থা।

অধ্যাদেশটি যখন করা হয়েছিল, তখন দেশে হাতে গোনা কয়েকটি বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান ছিল। বর্তমানে তার অবয়ব কয়েক গুণ বাড়লেও বেসরকারি খাতের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতে যুগোপযোগী আইনপ্রণয়ন করা হয়নি। অধ্যাদেশ হওয়ার পর আইনপ্রণয়নে পাঁচবার উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা ভেস্তে যায়। এ খাতে যুগোপযোগী আইন বা নীতিমালা না থাকায় বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতে অনিয়ম-দুর্নীতিও বেড়েছে লাগামহীনভাবে। প্রাপ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন নাগরিকরা।

করোনাকালে এ খাতের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি আরো প্রকাশ্যে এসেছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী দেশে সরকারি হাসপাতালের সংখ্যা ৬৫৪টি। আর ৫ হাজার ৫৫টি বেসরকারি হাসপাতাল। তবে সারা দেশে এর চেয়ে কয়েক গুণ বেশি অনিবন্ধিত বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে। দেশে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণকারী জনসংখ্যার প্রায় ৭০ শতাংশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে সেবা নেয়। সুতরাং সাধারণ মানুষের কথা বিবেচনায় নিয়ে অধ্যাদেশটিকে যুগোপযোগী করে পরিপূর্ণ আইনে পরিণত করা জরুরি। এ ধরনের আইন বা নীতিমালাগুলো ডিজিটাল মাধ্যমে সবার জন্য উন্মুক্ত রাখতে হবে; যাতে যে কেউ এ আইন বা নীতিমালা অনুযায়ী তার প্রাপ্য সেবা পাচ্ছেন কি না, তা যাচাই করতে পারেন।

স্বাভাবিক সময়ে যেসব হাসপাতাল ও ক্লিনিক রোগীতে ঠাসা থাকত, সেগুলো এখন প্রায় রোগীশূন্য। করোনা ছাড়া বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে যারা হাসপাতালে ভর্তি হতে যাচ্ছেন, তাদের কাছে চাওয়া হচ্ছে কোভিড-১৯ নেই মর্মে প্রত্যয়নপত্র।

এদিকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বন্ধ রেখেছেন প্রাইভেট চেম্বারে রোগী দেখা। এ অবস্থায় অনেক রোগী এ হাসপাতালÑ সে হাসপাতাল ঘুরে শেষ পর্যন্ত চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যুবরণ করছেন।

এমনকি সম্প্রতি সরকারের একজন অতিরিক্ত সচিব কিডনি জটিলতায় অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে রাজধানীর একের পর এক নয়টি হাসপাতালে নেওয়া হলেও কেউ চিকিৎসা দিতে রাজি হয়নি। অবশেষে তাকে কোভিড-১৯ রোগীদের জন্য নির্দিষ্ট কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং সেখানে তার মৃত্যু হয়। সরকারের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার চিকিৎসাসেবাপ্রাপ্তির যেখানে এ হাল, সেখানে সাধারণ মানুষের অবস্থা কী, তা সহজেই অনুমেয়।

বস্তুত করোনা আতঙ্কে চিকিৎসক ও নার্সদের একটি বড় অংশ সব ধরনের চিকিৎসাসেবা থেকে নিজেদের বিরত রেখেছেন। ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামের (পিপিই) স্বল্পতা এবং সাধারণ রোগীরা যে করোনা আক্রান্ত নন, তা নিশ্চিত না হওয়ার কারণেই মূলত চিকিৎসাব্যবস্থায় এ সংকট দেখা দিয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, অসংখ্য ধরনের রোগে আক্রান্ত হতে পারেন মানুষ।

কিন্তু দেখা যাচ্ছে, একদিকে রোগীরা যেমন চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন না, অন্যদিকে রোগের উপসর্গ দেখা দেওয়ার পর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ডায়াগনসিসও করা যাচ্ছে না। এমন অবস্থায় চিকিৎসাসেবার বর্তমান অবস্থায় শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন সবাই। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, দেশের হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসকদের জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক সুরক্ষা সরঞ্জাম দেওয়া হয়েছে। তাই যদি হয়, তাহলে চিকিৎসকদের কেন এত ভয়? বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমান সময়ে কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে যত মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তার চেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে অন্যান্য রোগে আক্রান্তদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না দেওয়ার কারণে। এমনকি চিকিৎসক পরিবারের রোগীরাও পাচ্ছেন না হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা।

বস্তুত বর্তমান করোনা সংকট দেশের স্বাস্থ্য খাতের দুরবস্থার চিত্রটি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু রোগীরা চিকিৎসা পাবেন না, এ পরিস্থিতি মেনে নেওয়া যায় না। কিছুদিন আগে খোদ প্রধানমন্ত্রী চিকিৎসকদের এ ধরনের আচরণে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। চিকিৎসা একটি মহৎ পেশা বলেই স্বীকৃত। এমন নজিরও রয়েছে, নিজের জীবন বিপন্ন করে হলেও অনেক চিকিৎসক রোগীর সেবা দিয়েছেন।

এ কথা সত্য, বর্তমান পরিস্থিতিতে করোনা আতঙ্ক রয়েছে সর্বত্র। চিকিৎসকদের মধ্যেও এই আতঙ্ক থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে হাসপাতালগুলোর চিকিৎসকরা

করোনা আতঙ্কে অন্যান্য রোগের চিকিৎসা দেবেন না, তা হতে পারে না। চিকিৎসাসেবা পাওয়া মানুষের মৌলিক অধিকার। এ অধিকার থেকে রোগীদের বঞ্চিত করা অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।

আমরা মনে করি, সরকারি-বেসরকারি কোনো চিকিৎসক বা হাসপাতালের বিরুদ্ধে রোগীর চিকিৎসা বা তাকে ভর্তি না করানোর অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক অথবা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। চিকিৎসক ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে আমাদের প্রত্যাশা, কোভিড-১৯ রোগের যেমন, তেমনি অন্যসব রোগের চিকিৎসার ব্যাপারেও তারা আন্তরিক হবেন।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, উপদেষ্টা, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, মহান মুক্তিযুদ্ধে ২ ও ৩ নম্বর সেক্টরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close