reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ০৬ আগস্ট, ২০২০

মতামত

বন্যা ও দুর্যোগ হ্রাসে প্রয়োজন বনায়ন

সাহাদাৎ রানা

দেশের অনেক এলাকা এখন বন্যাকবলিত। বন্যার পানিতে আটকে পড়ে অনেক মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। কোনো কোনো এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি অন্য যেকোনো সময়ের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। এটা আমাদের জন্য সত্যিই ভয়ের কারণ। আর ভয়ের কারণ এখন প্রায় প্রতি বছরই বন্যার সম্মুখীন হচ্ছি আমরা। কখনো ছোট আকারের বা কখনো ভয়াবহ আকারের বন্যা দেখছি। আর এমন আকস্মিক বন্যা হওয়ার প্রধানতম কারণ বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব। এমন বিরূপ প্রভাবের বাইরে নই আমরাও। গত প্রায় তিন দশক ধরে পৃথিবীজুড়ে সবচেয়ে আলোচিত হলো জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি। দিন দিন জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি আরো ব্যাপকভাবে আমাদের সামনে আসছে। এর একটাই কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে পৃথিবীতে বসবাসরত মানুষের জীবন ব্যবস্থায় নেতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ্যণীয়। বাংলাদেশও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। তাই আমরা নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হচ্ছি প্রায় নিয়মিত।

বাস্তবতা হলো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর বেশির ভাগই দরিদ্র। স্বাভাবিকভাবেই এই তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশের নামও। অবশ্য সাম্প্রতিক সময়ে শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বই জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের সামনে দাঁড়িয়ে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমগ্র বিশ্বের প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উষ্ণতা বা তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে মেরুদেশের বরফ গলে যাওয়ায় বাড়ছে সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতা। আবার প্রতি বছর অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, তাপমাত্রার আকস্মিক এবং ব্যাপক উঠানামার অনুঘটক হচ্ছে আকস্মিক বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়সহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের। প্রকৃতির এই খেয়ালিপনায় বিশ্বজুড়েই জনজীবন নানাভাবে প্রভাবিত ও বিঘিœত হচ্ছে। এমন আকস্মিক বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়সহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সামনে এখন আমরা দাঁড়িয়ে। বলা যায় প্রায় প্রতি বছরই এর সম্মুখীন হচ্ছি আমরা। যার বিরূপ প্রভাব পড়ছে আমাদের জীবন ব্যবস্থায়।

বাংলাদেশ কেন জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবের সম্মুখীন? এই প্রশ্নে উত্তর খুঁজতে গেলে আলোচনা করতে হবে আমাদের দেশের ভৌগোলিক অবস্থানের দিকে। মূলত ভূতাত্ত্বিকভাবে বাংলাদেশের চারপাশের সিংহভাগ অংশ অর্থ্যাৎ পশ্চিম, উত্তর আর পূর্ব সীমান্তজুড়ে রয়েছে ভারত। ঠিক পশ্চিমে অবস্থিত ভারতের পশ্চিমবঙ্গ। উত্তরে পশ্চিমবঙ্গের কিছু অংশের সঙ্গে আসাম ও মেঘালয়। পূর্বে ভারত ছাড়াও আছে মিয়ানমানের সীমান্ত। আর দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। এছাড়া উত্তর দিকে রয়েছে সুউচ্চ হিমালয় পর্বতমালার একাংশ। যেখান থেকে বরফগলা পানির প্রবাহে সৃষ্ট হয়েছে বড় বড় নদী। বর্ষার সময়ে নদীবাহিত পানির প্রবাহ বেড়ে গেলে নদী উপচে পানি লোকালয়ে পৌঁছে সৃষ্টি হয় বন্যার। এজন্য নিয়মিতই নানা মাপের বন্যার মুখোমুখি হচ্ছি আমরা। আর এটা বলা যেতে পারে প্রতি বছরেরই চিত্র। শুধু বন্যা নয়, বন্যার ঠিক আগে বা পরে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে আসে অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ। যেমন- ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো, নিম্নচাপ ও জলোচ্ছ্বাস আমাদের জীবনকে বিধ্বস্ত করে দেয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ প্রভাবে অত্যাধিক তাপমাত্রা, অতিবৃষ্টি, বায়ুপ্রবাহ, সমুদ্রস্তর বৃদ্ধি ইত্যাদি বহুমুখী পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আর এমনটা হচ্ছে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবের কারণে।

তবে আশার কথা হলো, বাংলাদেশ জলবায়ুু পরিবর্তন মোকাবিলায় অনেকখানি এগিয়েছে। কিন্তু তারপরও এ ক্ষেত্রে রয়েছে অনেকগুলো বাধা। বিশেষ করে বাংলাদেশের আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যা বেশি হওয়ায় কাক্সিক্ষত লক্ষ্য পূরুণ সম্ভব হচ্ছে না। এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ^ব্যাপী শিল্পায়নের জন্য কার্বন নিঃসরণ প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। বাংলাদেশেও এমন কার্বন নিঃসরণের পরিমাণও বাড়ছে। প্রতিনিয়ত এমন বৃদ্ধি আমাদের সবার মনে ভয় জাগাচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। অবশ্য এজন্য বাংলাদেশের প্রয়োজন হবে কার্বন নিঃসরণ হ্রাসে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা। কার্যকর উদ্যোগ হচ্ছে বনায়ন বৃদ্ধি। কেবল কার্বন নিঃসরণ হ্রাসই নয়, প্রাকৃতিক দুযোগ মোকাবিলায়ও এই বনায়নের কার্যকর ভূমিকা অপরিসীম। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা দলের নেতাকর্মীসহ দেশবাসীকে পরিবেশ রক্ষায় বেশি করে গাছ লাগানোর আহ্বান জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী সারা দেশে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির উদ্বোধনকালে এসব কথা বলেন। শুধু বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির সময়ে নয় প্রায় সারা বছর বিভিন্ন সময়ে প্রধানমন্ত্রী পরিবেশ রক্ষায় সবাইকে বেশি করে গাছ লাগানোর পরামর্শ দিয়ে আসছেন।

বৃক্ষরোপণের ক্ষেত্রে কেবল সরকার নয়, এগিয়ে আসতে হবে শিল্পপতিদেরও। প্রতিটি শিল্পকারখানায় কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ হ্র্রাসের পাশাপাশি কার্বন ফুটপ্রিন্ট হ্রাসে কার্যকর পদক্ষেপ কর্তৃপক্ষকে নিতে হবে। এক্ষেত্রে শিল্পকারখানার মালিকদের এসব বন্ধ করার জন্য বাধ্য করতে হবে। সবুজ ও পরিবেশবান্ধব কারখানা তৈরি, ডেলাইট ডেভিং, উপকরণের পুনর্ব্যবহার এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। সর্বোপরি সবুজের বিকল্প নেই। কেননা ব্যাপক বনায়ন পারে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে আমাদের অনেকটা রক্ষা করতে। কারণ বাংলাদেশে যে পরিমাণ বনায়ন থাকার কথা এর বিপরীতে

আছে খুব সামান্য। বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকায় প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। তাই ঘূর্ণিঝড়সহ প্রাকৃতিক

দুর্যোগের আঘাত মোকাবিলায় উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক বনায়ন গড়ে তোলার বিকল্প নেই। পাশাপাশি সমুদ্রের লবণাক্ত পানি যাতে কুল ছাপিয়ে মিঠা পানিতে মিশতে না পারে সেজন্য প্রয়োজন অনুযায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণ, পানি দূষণ প্রতিরোধ করার পাশাপাশি এর নিয়ন্ত্রণ এবং ব্যবস্থাপনার জন্য সঠিক ও কার্যকর পরিকল্পনা প্রয়োজন।

বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব পড়ছে কৃষির ওপরও। এর জন্য জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে কৃষিজীবীরা কীভাবে খাপ খাওয়াতে পারেন সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন কৃষকরা। অথচ কৃষকরাই দেশের প্রাণ। এখন দেশে যে বন্যা চলছে এই বন্যায়ও সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত তারাই। কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হলে, ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের অর্থনীতি। তাই তাদের বিষয়টি বিশেষভাবে মাথায় নিয়ে কাজ করতে হবে। কারণ কৃষকরা সঠিকভাবে তাদের কাজ করতে পারলে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে পারবে দেশ। বন্যা শেষ হলে কৃষকদের সামনে আসে নতুন চ্যালেঞ্জ। কৃষকরা যাতে সেই চ্যালেঞ্জে বিজয়ী হতে পারেন সে বিষয়ে সরকারকে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে।

এখানে আরো একটি বিষয়ে বিশেষভাবে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। এখন ঝড়ের মৌসুম। মাঝে মাঝে দেশের বিভিন্ন জায়গায় হঠাৎ আঘাত হানছে ছোট বড় ঘূর্ণিঝড়। এসব ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলায় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া খুবই জরুরি। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাংলাদেশ যে কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এর থেকে পুরোপুরি রক্ষার উপায় না থাকলেও প্রতিরোধ করে ক্ষতির পরিমাণ অনেকাংশে কমানো সম্ভব। কেননা জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব আমাদের প্রিয় এই মাতৃভূমিকে মারাত্মক ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। এজন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষায় নীতি নির্ধারকদের টেকসই কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। পাশাপাশি সবার সম্মিলিত প্রয়াস বাংলাদেশকে ভবিষ্যতের প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াবহতা থেকে নিরাপদ রাখতে পারে।

আর নিরাপদ রাখতে ও দুর্যোগ হ্রাসের জন্য ব্যাপক বনায়নের প্রতি সবার মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। এখন বর্ষা মৌসুম। গাছ লাগানোর উপযুক্ত সময়। তাই এই সময়ে বেশি করে সবাইকে বৃক্ষরোপণ করতে হবে। অবশ্য নির্দিষ্ট একটি সময়ে নয়, সারা দেশকে সবুজে রূপান্তরিত করতে বছরজুড়েই বৃক্ষরোপণ করতে হবে। কারণ বৃক্ষরোপণই পারে প্রকৃতির প্রতি সহমর্মিতা সৃষ্টি করতে।ফলে দুর্যোগ হ্রাস করা সম্ভব।

এনে রাখতে হবে, বৃক্ষই মানুষের প্রকৃত বন্ধু। কারণ মানুষকে অক্সিজেন সরবরাহ করে গাছ। শুধু তাই নয়, গাছ পরিবেশের ভারসাম্যও রক্ষা করে। আমাদের সুন্দরবন এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। গাছ যে শুধু পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে তা কিন্তু নয়। গাছের অর্থনৈতিক মূল্যও কম নয়। বিপদের সময় গাছ বিক্রি করে মানুষ আর্থিকভাবে উপকৃত হয়। বনজ, ফলদ ও ঔষধি সব ধরনের বৃক্ষই মানুষের জন্য উপকারী। তাই সবাইকে বেশি বেশি করে বৃক্ষরোপণ করতে হবে। তবেই সবুজে ভরে উঠবে চারপাশ। কমে আসবে অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, তাপমাত্রার আকস্মিক এবং ব্যাপক উঠানামা, আকস্মিক বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়সহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close