রায়হান আহমেদ তপাদার

  ৩০ জুলাই, ২০২০

মুক্তমত

কর্মসংস্থাননির্ভর প্রবৃদ্ধি অর্জন প্রয়োজন

করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাবে মানুষের আয় কমে গেছে, বেড়েছে বেকারত্ব। যাদের আয় কম, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বেশি। এমন অনেক ব্যক্তি আছেন, যাদের আয়ের উৎস একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থা বিআইডিএসের মতে, দেশের ২৯ হাজার ৯০৯ জনের ওপর জরিপ পরিচালনা করে এক তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, করোনার কারণে দেশের ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। এ ছাড়া করোনার কারণে সব জেলাতেই বেকারত্ব বেড়েছে। তবে তুলনামূলকভাবে সিলেটে কর্মসংস্থান হারানোর হার বেশি। আর শহর এলাকার তুলনায় গ্রামে কাজ হারিয়েছে বেশি। করোনা আগে গ্রামে বেকারের হারও ছিল বেশি। কিন্তু এখনকার প্রেক্ষাপটে যতই দিন যাচ্ছে বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বেকারত্ব এখন এক গভীর ও জাতীয় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর বর্তমানে করোনা মহামারির তান্ডবে বেকারত্বের নাজুক পরিস্থিতি গোটা বিশ্বজুড়েই। কিন্তু আমাদের দেশের নীতিনির্ধারকরা জনসংখ্যাকে জনসম্পদ বলে আত্মতুষ্টি লাভ করলেও বাস্তবে এর বিপরীত অবস্থা দেখা যাচ্ছে। দুই বছর ধরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশে উন্নীত হলেও বেকারের সংখ্যা কিছুতেই কমছে না। অনেকে একে কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি বলে উল্লেখ করেছেন। প্রান্তিক তরুণ জনগোষ্ঠীর কাছে উন্নয়নের ছোঁয়া সঠিকভাবে যাচ্ছে কি না, তা এক বিরাট প্রশ্নের বিষয়।

স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশেই বেকার সমস্যা সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশে নিম্ন মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষ অনেক বেশি। আর সে কারণেই লেখাপড়া শেষ করে চাকরির সন্ধানে দ্রুত বেরিয়ে পড়তে হয়। চাহিদা অনুসারে কর্মক্ষেত্র কম হওয়ায় এমনিতেই বেকার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে দিন দিন। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বেকারত্বের হার বাংলাদেশেই বেশি। কিন্তু এই শিক্ষিত তরুণরা দেশের বোঝা নয়, মূলত সম্পদ! বেকার নারী-পুরুষ হন্যে হয়ে কাজ খুঁজছেন, কিন্তু তারা কাজ পাচ্ছেন না। পরিবারের বাবা-মা হয়তো পড়াশোনা শেষ করা ছেলে বা মেয়েটির পথ চেয়ে বসে আছেন, কখন তারা পরিবারে সচ্ছলতা বয়ে আনবে ও তাদের মুখে হাসি ফোটাবে। একজন বেকারের নীরব যন্ত্রণা কেউ অনুভব করতে পারেন না, কেউ বোঝেন না বা বুঝতে পারেন না তাদের মনের অনুভূতি। ইউনেসকোর এক গবেষণা মতে, শিক্ষা হলো দারিদ্র্যবিমোচনের প্রধান শর্ত। কিন্তু আমাদের দেশে যে শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে, তা জাতির কাক্সিক্ষত চাহিদা পূরণে কার্যকর ভূমিকা রাখছে কি না, তা ভেবে দেখার প্রয়োজন রয়েছে কিছুটা হলেও আশার কথা হচ্ছে, এবারের বাজেটে গ্রামীণ এলাকায় উদ্যোক্তা তৈরির বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিয়েছে সরকার। উদ্যোক্তা উন্নয়নে ব্যাংকিং সুযোগ-সুবিধা গ্রামীণ এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত করেছে। এখন এই সুযোগ-সুবিধা কীভাবে পরিকল্পিত উপায়ে কাজে লাগানো যায়, সেজন্য আর্থিক ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাকে সরকারের প্রশাসনযন্ত্রের সঙ্গে সংগতি রেখে কাজ করতে হবে। ইতোমধ্যে শহর ছেড়ে আবার অনেকে গ্রামে স্থানান্তরিত হচ্ছেন। এই যে যারা গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন, তাদের জন্য স্থানীয় পর্যায়ে ডেটাবেইজ তৈরি করে সেখানে তাদের ডেটা সংরক্ষণের পাশাপাশি গ্রামীণ এলাকায় শিক্ষিত ও অশিক্ষিত বেকার এবং সদ্য যারা কর্ম হারাচ্ছেন তাদেরও ডেটাবেইজ তৈরি করতে হবে।

তার পাশাপাশি কর্মপ্রত্যাশীদের যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা এবং কী ধরনের কর্ম করতে ইচ্ছুক সে বিষয়ে একটি সম্যক ধারণা নিয়ে সুন্দর করে এনটিটি রিলেশনশিপ ডায়াগ্রাম তৈরি করে তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের উদ্যোগ স্থানীয় পর্যায়ে গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে তৃণমূল পর্যায়ে যেসব রাজনৈতিক নেতা আছেন তারা যাতে তদারকি করতে পারেন, সেজন্যও তাদের ক্যাপাসিটি তৈরির ব্যবস্থা করতে হবে। সরকার যেভাবে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াতে চাচ্ছে, সেটি প্রশংসনীয়। তবে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতকেও এগিয়ে আসতে হবে সততা, ন্যায়পরায়ণতা এবং জবাবদিহির আলোকে। বৈশ্বিক করোনা মহামারির কারণে দেশ-বিদেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে টালমাটাল অবস্থা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে সব দেশেই বেকার সমস্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম না হলেও সরকার কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করেছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগ নিলেও করোনা মহামারি এটির বাস্তবায়নকে অনেকটা জটিল করে তুলেছে। ‘জীবন ও জীবিকা’ দুয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধনের প্রয়াস সরকারপ্রধান গ্রহণ করেছেন। যারা বাস্তবায়ন করবেন তাদের অবশ্যই আন্তরিক হতে হবে। আসলে প্রধানমন্ত্রী যে বিশাল দিকনির্দেশনা দেন, তা মানুষকে ভালোবেসে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে দিয়ে থাকেন। আসলে যারা কোনো নির্দেশ বাস্তবায়ন করবেন, তারা প্রতিটি স্তরে মডেল তৈরি করে একটির সঙ্গে আরেকটি সংযোগ স্থাপন করে স্থানীয় পর্যায়ে কৃষিনির্ভর কর্মসংস্থানের পাশাপাশি চুক্তিভিত্তিক খামার প্রতিষ্ঠা করা।

এ ছাড়া গ্রামীণ পর্যায়ে বিমা ব্যবস্থাপনার অগ্রগতি গত ৪৯ বছরেও তেমন একটি হয়নি। বিমা কোম্পানিগুলোর উচিত মেধা, মনন ও ধীশক্তি দিয়ে নতুন নতুন বিমা স্কিম কমিউনিটি সার্ভিসের জন্য গ্রামীণ পর্যায়ে খোলা। ছোট ছোট মিল ও কল-কারখানা গ্রামীণ পর্যায়ে স্থাপনে ব্যাংকসমূহকে এগিয়ে আসতে হবে। আবার যেসব গ্রামে প্রবাসীরা বিদেশে ছিলেন, যারা কষ্ট করে এত দিন দেশে অর্থ পাঠিয়েছেন, তাদের মধ্যে যারা দেশে ফেরত আসবেন, তারাও যেন তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মসংস্থান পান; সেজন্য উদ্যোগী হতে হবে। কেননা আগের থেকে পরিকল্পনা প্রণয়ন করে সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করে দেশের উন্নয়নকে এগিয়ে নিতে হবে কর্মসংস্থান তৈরির ক্ষেত্রে বিদেশে দাতাগোষ্ঠী এবং আমাদের দেশের চাহিদার মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে হবে। আইএমএফের এক্সিকিউটিভ বোর্ড সম্প্রতি দেশের জরুরি লেনদেনে ভারসাম্য এবং রাজস্ব প্রয়োজনের জন্য ৭৩২ মিলিয়ন ডলার জরুরি সাহায্য বাংলাদেশকে র‌্যাপিড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি এবং র‌্যাপিড ফাইন্যান্সিং ইনস্ট্রুমেন্টের আওতায় দিয়েছে। বাংলাদেশ সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে আইএমএফ বলেছে, করোনাভাইরাসের কারণে বাংলাদেশের বহিঃস্থ আয় তৈরি পোশাকশিল্পের রফতানি এবং বিদেশ থেকে প্রবাসী কর্তৃক প্রেরিত অর্থের উৎসে সমস্যার সৃষ্টি করেছে। তারা আরো উল্লেখ করে যে, যারা একেবারে অসহায়, ব্যবসায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত এবং সামষ্টিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে সমস্যার মধ্যে রয়েছে তাদের সহায়তা করতে হবে। রাজস্ব ঘাটতি মেটানোর ক্ষেত্রেও এ ফান্ড কাজে দেবে বলে আইএমএফ অভিমত ব্যক্ত করেছে। রাজস্ব নীতির পাশাপাশি মুদ্রানীতিকেও কর্মসংস্থান উপযোগী পরিবেশ নিয়ে সাধারণ জনমানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে।

এ মুহূর্তে বাংলাদেশের ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ জুন, ২০২০-এর হিসাব অনুযায়ী ৩৫ বিলিয়ন ডলার, যেটি সর্বোচ্চ। ফরেন এক্সচেঞ্জে রিজার্ভের চেয়ে একটি দেশে নেট ফরেন অ্যাসেট কত সেটি জানা দরকার। নেট ফরেন অ্যাসেটের একটি বড় অংশ অবশ্যই দেশের অভ্যন্তরীণ ক্রেডিট ব্যবস্থাপনায় কাজে লাগিয়ে কর্মসংস্থাননির্ভর প্রবৃদ্ধি অর্জন করা দরকার। দেশে অনেক ধনাঢ্য কনসালট্যান্ট আছে যারা গ্রামের মানুষের কাছে না গিয়ে বড় বড় কথা বলে। প্রায়ই স্ট্যান্টবাজি করার জন্য এমন সব উক্তি অনেকে করে, যাতে মনে হয় সততা, নিষ্ঠা ও একাগ্রতায় তাদের বিকল্প নেই। অথচ তাদের হাতে যখন যোগ্য প্রার্থী নির্বাচনের দায়িত্ব পড়ে তখন যোগ্যদের চেয়ে অযোগ্যদের দিকেই তারা আগ্রহী হয়। তার কারণ নিজেদের আত্মপ্রীতি, স্বজনপ্রীতি এবং বাড়তি অর্থপ্রীতি। আসলে সুযোগ সন্ধানীরা চাপাবাজি করে কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে অর্থনীতির উন্নয়ন চায় না। এরা আবার বিভিন্ন সময়ে সরকারি প্রজেক্ট, যেটি বিআইডিএসের করার কথা তাও পেয়ে থাকে। লকডাউনের সময়ে তার অফিস কাকে নিয়োগ দিল এবং পেছনের দরজা দিয়ে নেওয়ার ইচ্ছে থাকলে তারা বিজ্ঞাপন নাও দিয়ে নিতে পারত। সমাজে যখন দুর্বৃত্তায়ন হয় তখন শিক্ষিত মানুষেরাই নেতৃত্ব দেন।

ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পাটকলগুলো আধুনিকায়ন, বাজারজাতকরণ, বিপণন ও সরবরাহজনিত সমস্যাকে এমন করে তুলেছে যে, বছরের পর বছর লোকসান গুনতে গুনতে অচল হয়ে গেছে। সরকারি তহবিল থেকে অর্থ সাহায্য করতে হচ্ছে। জনবান্ধব সরকার বাধ্য হয়ে পাটকলগুলো বন্ধ করার নীতিগত সিদ্ধান্তের কারণে ২৫ হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে যাবে, সে কথাও ভাবতে হবে। বৈশ্বিক মহামারির এ সময়ে এ পাটকলগুলো আরও তিন মাস পরে যাতে বন্ধ করা হয়। যাতে করে পাটকল শ্রমিকের বেতন-ভাতাদি এক ধরনের প্রণোদনা হিসেবে এ মহামারিতে বিবেচিত হবে। কেননা, মানুষের আয় হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তার একটি উৎস। সত্যি বলতে কী এ দেশে দুর্ভাগ্য হলো যে যায় লঙ্কায়, সেই রাবণ হয়। ফলে সরকারি ও বেসরকারি খাতেও অনেক ক্ষেত্রেই দুস্থ মানুষের প্রতি অমানবিক আচরণের বিষয়টি সাধারণ জনমানুষের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঈর্ষণীয়, এ বিষয়ে ভিন্নমতের অবকাশ নেই। তবে আলোর নিচে রয়েছে অন্ধকার। এই অন্ধকারে লুকিয়ে রয়েছে লাখ লাখ বেকার। বাতাসে মিশে আছে তাদের গুমোট দীর্ঘশ্বাস! বিবিএসের হিসাবে প্রতি বছর ২৭ লাখ কর্মক্ষম মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করলেও সরকারি বা বেসরকারিভাবে কাজ পাচ্ছে মাত্র ১ লাখ ৮৯ হাজার মানুষ। ফলে প্রতি বছর বিপুলসংখ্যক মানুষ বেকার থাকছে। বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার মতে, বর্তমানে দেশে জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশই যুবা এবং তাদের মধ্যে ৪০-৪২ ভাগই বেকার। আমাদের অর্থনীতি, বেকারত্ব এবং আইএমএফ ও দাতাদের দ্বারা আমাদের মুরগি বানানোর প্রক্রিয়া যদি আমরা বুঝি এবং আমরা যদি জেগে না ঘুমাই; তা হলে আমাদেরও উচিত কর্মসংস্থান ও সামাজিক খাতে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ নিশ্চিত করে অভ্যন্তরীণ বাজার শক্তিশালী করা। বেকারত্ব শুধু একটি সরকারকে নয়, একটি দেশকেও বিপদে ফেলতে পারে। দেশের উন্নয়নে বেকারত্ব বিরাট বাধা। বেকারত্ব দূরীকরণকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে না নিতে পারলে অদূর ভবিষ্যৎ ভয়াবহ অন্ধকারে নিমজ্জিত হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close