আবুজার গিফারী

  ১৫ জুলাই, ২০২০

পর্যবেক্ষণ

দুর্যোগ মোকাবিলায় দেশ কতটা প্রস্তুত

একবিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশ যেসব নতুনত্ব সমস্যা মোকাবিলা করছে তার ভেতর অন্যতম হলো প্রাকৃতিক দুর্যোগ। কয়েক বছর ধরে দেশটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রকোপে জর্জরিত। একটি দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আরেকটি দুর্যোগের উৎপত্তি। দুর্যোগের তীব্র ভয়াবহতা এ দেশের মানুষ আজ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছে। যত দিন যাচ্ছে এ দেশের মানুষ ততই প্রকৃতির কাছে নীরব-অসহায়। প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানুষের জীবন-জীবিকাকে চরম বিপর্যয়ের মুখে ফেলছে। সময়ে-অসময়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ সংঘটিত হওয়ার পেছনে মানুষই অনেকাংশে দায়ী। যেমন হরহামেশাই বৃক্ষ নিধন, বন উজাড়, অযথা পাহাড় খনন, ব্যাঙের ছাতার মতো ইটভাটা নির্মাণ, মাত্রাতিরিক্ত সিএফসি গ্যাস নির্গমন ইত্যাদি। তাছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের ফলেও আমরা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করছি। বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হয়ে যেসব দেশ মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন, সেদিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে।

প্রতি বছর যে দুর্যোগগুলো বাংলাদেশ মোকাবিলা করছে তা হলোÑ বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বজ্রপাত, ভূমিকম্প, ভূমিধস ইত্যাদি। বিগত বছরগুলোতে আইলা, সিডর, মহসিন, ফণী, নার্গিসের মতো প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতির চিত্র দৃশ্যমান। আজও সেসময়কার ক্ষতিগ্রস্তরা তাদের সে দুর্দশা কাটিয়ে উঠতে নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। সেই সংগ্রামের রেশ থামতে না থামতেই আবারও নতুন কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের উৎপত্তি হচ্ছে। যেমন মহাপ্রলয়ঙ্করী সুপার সাইক্লোন আম্পান। আম্পানে উপকূল অঞ্চলে কয়েকশ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে দক্ষিণ অঞ্চলে চিংড়িঘের মালিকদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। একটি পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে সুপার সাইক্লোন আম্পানে ১৩০০ কোটি ডলারের বেশি ক্ষতি হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে আরেকটি দুর্যোগ ওতপ্রোতভাবে জড়িত, সেটা হলো জলোচ্ছ্বাস। জলোচ্ছ্বাস বলতে বোঝায় সমুদ্রের পানি ফুলে উঁচু হয়ে উপকূলে আঘাত হানা। মূলত প্রবল ঝড়ের থেকেই জলোচ্ছ্বাসের উৎপত্তি। আমরা জানি, দেশে ১৮টি উপকূল অঞ্চল রয়েছে। প্রতি বছর জলোচ্ছ্বাসে সেই উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে বিশেষ করে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাটে অসংখ্য প্রাণহানি ও প্রচুর পরিমাণে ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্যা প্রসঙ্গে বলতে গেলে প্রথমেই চলে আসে চর অঞ্চলের কথা। সেখানে প্রতি বছর বন্যা হবেÑ এটাই স্বাভাবিক। এটা চরের কৃষকের জীবনের অংশবিশেষে পরিণত হয়েছে। সেখানে সময়ে-অসময়ে বন্যার কারণে কৃষিতে অপূরণীয় ক্ষতি হয়। বন্যার সময় জনজীবন বিপর্যস্ত হওয়ার পাশাপাশি গবাদিপশুর ক্ষয়ক্ষতি ও মানুষের নানাবিধ রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে দেশের উত্তর অঞ্চলে বন্যার পানিতে সহস্রাধিক এলাকা প্লাবিত হয়েছে। সরকারের ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, বর্তমান দেশের ১৪টি জেলার প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ বন্যার পানিতে বন্দি। বন্যার কারণে ঘর ও ফসলের ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১৪ লাখ মানুষের। সরকারের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পূর্বাভাস অনুযায়ী, এ মাসেই বন্যার আরেকটি ঢল উজান থেকে আসতে পারে। এতে প্রায় আরো ১০টি জেলা বন্যার পানিতে আক্রান্ত হতে পারে। ফলে আরো কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি হতে চলেছে। করোনাকালে বন্যায় ক্ষতি ও প্রাণহানি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই এখন থেকেই বন্যার ক্ষতি কমিয়ে আনতে আগাম প্রস্তুতি নিতে হবে।

বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশে শক্তিশালী ভূমিকম্প এবং সুনামির আশঙ্কা করছেন। ভূমিকম্প পরবর্তী প্রস্তুতি খুবই জরুরি। বাংলাদেশে পার্শ্ববর্তী দেশ নেপাল, চীন এবং ভারতের তুলনায় প্রায় অর্ধেক মাত্রায় ভূমিকম্প অনুভূত হয়। নেপালের সমমাত্রায় বাংলাদেশে ভূমিকম্প হলে রাজধানী ঢাকার ৬০ থেকে ৭০ ভাগ ভবন ধসে এবং হেলে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ভূতাত্ত্বিকদের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, রিখটার স্কেলে সাড়ে সাত মাত্রার ভূমিকম্প হলে কেবল রাজধানী ঢাকার প্রায় ৩ লাখ ২৬ হাজার অবকাঠামোর মধ্যে ৭২ হাজার ভবন ধসে যাবে। একই সঙ্গে প্রায় ৯০ হাজার লোকের প্রাণহানি হবে। বর্তমানে পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড়ধস নিত্তনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। আর এসব পাহাড়ধসের পেছনে বিশেষজ্ঞরা যে কারণগুলো উল্লেখ করছেন সেগুলো হলো; পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড়গুলো বালুময় এবং এসব পাহাড়ের ভেতরে অনেক ফাটল থাকায় অতিবৃষ্টির ফলে পাহাড়ের ফাটলে পানি জমে পাহাড়ধস। মানুষের দ্বারা অবৈধভাবে প্রচুর পরিমাণ পাহাড় কাটা এবং পাহাড়ে বনের গাছ কেটে বন উজাড় করা।

সময় এসেছে সতর্ক হওয়ার। এখন যদি সতর্ক না হই তাহলে আমাদের পরবর্তীতে আরো ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। ইতিপূর্বে দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকার কী করেছে বা না করছে, দুর্যোগ প্রতিরোধে সরকারের ব্যর্থতা বা সফলতা কতটুকু? এসব দরকষাকষি ভুলে গিয়ে দুর্যোগ প্রতিরোধে এখনই স্থায়ী সমাধান খুঁজতে হবে। আর এগুলো বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে দুর্যোগ প্রতিরোধে যুগোপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে দুর্যোগ খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ নির্ধারণ করতে হবে ও তার সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। দুর্যোগ প্রতিরোধে করণীয় হিসেবে আমরা দুটি দিকনির্দেশনা উল্লেখ করা যায়। প্রথমত; দুর্যোগ পূর্বকালীন প্রস্তুতি, দ্বিতীয়ত; দুর্যোগ পরবর্তীকালীন প্রস্তুতি।

প্রথমত, সরকারকে সুষ্ঠু পূর্বপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ এবং গণমাধ্যমের সুষ্ঠু ভূমিকা পালন নিশ্চিত করতে হবে। অগভীর নদী ড্রেজিং করতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ নদীর তীরে বাঁধ নির্মাণ করতে হবে। সম্ভাব্য দুর্যোগের ব্যাপারে ব্যাপক প্রচার চালাতে হবে। রাস্তাঘাট মজবুত করে তৈরি করতে হবে। জনগণকে দুর্যোগ মোকাবিলায় ব্যাপকভাবে সচেতন করে তুলতে হবে। দ্বিতীয়ত, দুর্যোগ-পরবর্তী ত্রাণ দ্রুত ভুক্তভোগীদের কাছে পৌঁছাতে হবে। যেখানে সুপেয়পানির অভাব, সেখানে সুপেয়পানি সরবরাহ করতে হবে। আবাসস্থল ক্ষতিগ্রস্তদের অতিদ্রুত আবাসস্থল মেরামতের ব্যবস্থা করতে হবে। আর্থিকভাবে যারা ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। সর্বোপরি আগামীতে যাতে এ রূপ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বহুলাংশে কমানো যায়, সে ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে। দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ে সরকারের পাশাপাশি আমাদের সবাইকে সমন্বিত প্রচেষ্টার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাকেও ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়াতে হবে। সরকারের একার পক্ষে দুর্যোগ মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না, যদি না আমরা সচেতন হই। সুতরাং আমাদের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে এবং দুর্যোগ মোকাবিলায় অংশ নিতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগসমূহ পুরোপুরি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হলেও উপযুক্ত ও সময়োপযোগী পদক্ষেপের মাধ্যমে জীবন ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব।

লেখক : শিক্ষার্থী

আইন বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close