বাদল চৌধুরী

  ১৪ জুলাই, ২০২০

শ্রদ্ধাঞ্জলি

প্লেব্যাক সম্রাটের অনন্তের পথে যাত্রা

মিনু বাড়ৈয়ের কোল আলোকিত করে জন্ম নিয়েছিল এক ফুটফুটে শিশু। মা তার প্রিয় শিল্পী কিশোর কুমারের নামের সঙ্গে মিল রেখে সদ্যোজাত সন্তানের নাম রাখলেন এন্ড্রু কিশোর কুমার বাড়ৈ। ডাকতেন ‘কিশোর’ বলে। ধীরে ধীরে সেই ছেলেটি বড় হয়ে সংগীতাঙ্গনে পা রাখল। আর পরিচালক দেওয়ান নজরুল বাবা-মার দেওয়া নাম ছোট করে নাম দিয়েছিলেন এন্ড্রু কিশোর। এক দিন স্বমহিমায় সেই ছেলেটিই হয়ে উঠল সংগীত কিংবদন্তি এন্ড্রু কিশোর।

সংগীতশিল্পী এন্ড্রু কিশোর ১৯৫৫ সালের ৪ নভেম্বর রাজশাহীতে জন্মগ্রহণ করেন। বাবার নাম ক্ষীতিশ চন্দ্র বাড়ৈ এবং মা মিনু বাড়ৈ। স্ত্রীর নাম লিপিকা এন্ড্রু ইতি। তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে। দুজনেই অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন। মেয়ে মিনিম এন্ড্রু সংজ্ঞা সিডনিতে গ্রাফিক ডিজাইন ও ছেলে জে এন্ড্রু সপ্তক মেলবোর্নে ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে পড়াশোনা করছেন। মা রাজশাহীর বুলনপুর মিশন গার্লস হাইস্কুলের শিক্ষিকা থাকায় সেখানেই পড়াশোনায় হাতেখড়ি। রাজশাহীতেই কেটেছে তার শৈশব ও কৈশোর। ছোটবেলা থেকেই সংগীতে অনুরক্ত ছিলেন তিনি। প্রাথমিকভাবে সংগীতের পাঠ শুরু করেন ওস্তাদ আবদুল আজিজ বাচ্চুর কাছে।

রাজশাহী সিটি কলেজে থেকে বাণিজ্য বিভাগে এইচএসসি পাস করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবস্থাপনায় পড়লেও গানই ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান। রাজশাহীর নামকরা সংগীতচর্চা কেন্দ্র সুরবাণী সংগীত বিদ্যালয়ে এন্ড্রু কিশোর গান শিখতেন। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীত, আধুনিক গান, লোকগান ও দেশাত্মবোধক গানে রাজশাহী বেতারের তালিকাভুক্ত শিল্পী হন। একসময় গানের নেশায় রাজধানীতে ছুটে আসেন। অচেনা এই শহরে শুরু হয় তার গানের যুদ্ধ। ক্লান্তিময় পথ পেরিয়ে নিজেকে তিনি একজন জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। একে একে অনেক কিছুই তার কাছে ধরা দিয়েছে প্রথম হয়ে। মাঝে কিছুদিন ব্যবসাও করেছিলেন। এন্ড্রু কিশোর ১৯৮৭ সালে আহমাদ ইউসুফ, আনোয়ার হোসেন বুলু, ডলি জহুর প্রমুখের সঙ্গে টিভি নাটক, বাণিজ্যিক অন্যান্য প্রযোজনার জন্য ‘প্রবাহ’ নামে একটি বিজ্ঞাপন প্রতিষ্ঠান শুরু করেন।

উত্তরাঞ্চলীয় জেলা রাজশাহীতে বেড়ে ওঠা এই গায়ক আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ পেয়েছেন দেশ বিদেশের অসংখ্য পদক ও সম্মাননা । ১৯৮২ সালে তিনি প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। আশির দশকে প্লেব্যাকের জগতে পা রাখার পর থেকে বাংলা, হিন্দিসহ বহু চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি। তার বহুসংখ্যক গান স্থান করে নিয়েছে মানুষের হৃদয়ে, স্মৃতির মণিকোঠায়। এজন্য তিনি ‘প্লেব্যাক সম্রাট’ নামে পরিচিত। চলচ্চিত্রে এন্ড্রু কিশোর গান গাওয়া শুরু করেন ১৯৭৭ সালে। ‘মেইল ট্রেন’ চলচ্চিত্রে তিনি গেয়েছিলেন ‘অচিনপুরের রাজকুমারী নেই যে তার কেউ’ গানটি। চলচ্চিত্রে এটাই ছিল তার প্রথম গান। সুরকার ও সংগীত পরিচালক ছিলেন আলম খান। কিন্তু এন্ড্রু কিশোর সবার কাছে পৌঁছে যান দুই বছর পর। তার গানটি ছিল ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’। মনিরুজ্জামান মনিরের লেখা গানটির সুরকার ও সংগীত পরিচালক ছিলেন আলম খান।

এন্ড্রু কিশোর দীর্ঘদিন পুরোদস্তুর পেশাদার কণ্ঠশিল্পী হিসেবে দুই বাংলায় গান করেছেন। উপহার দিয়েছেন একের পর এক জনপ্রিয় গান। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে অসুস্থ হয়ে পড়ার আগ পর্যন্ত এন্ড্রু কিশোর প্লেব্যাক ও স্টেজ শো নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করেছেন। আলম খানের সুর-সংগীতে গেয়েছেন প্রয়াত সব্যসাচী লেখক ও কবি সৈয়দ শামসুল হকের লেখা শেষ তিনটি গান। এন্ড্রু কিশোর দেশের প্রখ্যাত সুরকারদের মধ্যে বেশি গান করেছেন আলম খান, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, আলাউদ্দিন আলীর সঙ্গে। এ ছাড়া গান করেছেন শেখ সাদী খান, ইমন সাহা, আলী আকরাম শুভসহ অনেকের সঙ্গে। ভারতের প্রখ্যাত সুরকার আর ডি বর্মণের সুরেও গান গেয়েছেন। দেশের গ-ি পেরিয়ে কলকাতাতেও প্লেব্যাকে বেশ কয়েকটি গান করেছেন তিনি। সংগীত জগতে এন্ড্রু কিশোর এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী নাম। তিন দশক ধরে বাংলাদেশে চলচ্চিত্রের গানে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছেন তিনি। একের পর এক গেয়েছেন হৃদয়কাড়া গান। মুগ্ধ করেছেন দর্শক-শ্রোতাদের। তার গাওয়া অসংখ্য জনপ্রিয় গান মানুষের মুখে মুখে। জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী এন্ড্রু কিশোরের কণ্ঠে গাওয়া হয়েছে বাংলা চলচ্চিত্রের সর্বাধিক গান। তার গাওয়া গানের পরিমাণ ১৫ হাজার।

বাংলা চলচ্চিত্রে তার গাওয়া গানগুলো তাকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। এ গুণী শিল্পীর সবচেয়ে জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে ‘জীবনের গল্প/আছে বাকি অল্প’, ‘হায় রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’, ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি’, ‘আমার বুকের মধ্যিখানে’, ‘তুমি যেখানে/আমি সেখানে’, ‘সবাই তো ভালোবাসা চায়’, ‘চাঁদের সাথে আমি দেব না তোমার তুলনা’, ‘বেদের মেয়ে জোসনা আমায় কথা দিয়েছে’, ‘তুমি আমার জীবন/আমি তোমার জীবন’, ‘ভালো আছি ভালো থেকো’, ‘ভেঙেছে পিঞ্জর মেলেছে ডানা’, ‘ভালোবেসে গেলাম শুধু ভালোবাসা পেলাম না’, ‘তুমি আমার কত চেনা’, ‘তুমি মোর জীবনের ভাবনা’, ‘তোমায় দেখলে মনে হয়’, ‘এইখানে দুইজনে নির্জনে’সহ অনেক গান। জীবনের বেশির ভাগ সময়ে মূলত চলচ্চিত্রে গান করেই কাটিয়েছেন। চলচ্চিত্রে এতটাই ব্যস্ত ছিলেন যে অডিও বাজারে খুব একটা অ্যালবাম করেননি। চলচ্চিত্রের বাইরে এসে প্রথম দিকে তিনি ‘ইত্যাদি’তে গান করেন ‘পদ্মপাতার পানি নয়’, যা বেশ জনপ্রিয়তা পায়। পরবর্তীকালে বেশ কয়েকবার ‘ইত্যাদি’তে এসেছেন। সংগীতবিষয়ক রিয়েলিটি শো বাংলাদেশি আইডলের বিচারক ছিলেন এ জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী।

২০১১ সাল থেকে প্রতি তিন মাস অন্তর একবার রাজশাহী যেতেন। তার ওস্তাদের নামে রাজশাহীতে ‘ওস্তাদ আব্দুল আজিজ বাচ্চু স্মৃতি সংসদ’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। তিনি ছিলেন সংগঠনের সভাপতি। তারই উদ্যোগে নিয়মিত একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হতো। সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়ার জন্য তিনি রাজশাহীতে ছুটে যেতেন। মৃত্যুর আগেও যখন তিনি কথা বলতে পারতেন- সে সময় তিনি সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক কণ্ঠশিল্পী মঈনুল ইসলামের উপস্থিতে সভাপতির দায়িত্ব হস্তান্তর করেন, তার বাল্যবন্ধু রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান দ্বীপকেন্দ্রনাথ দাসের কাছে।

দীর্ঘ ১০ মাস ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করে হেরে গেলেন জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী এন্ড্রু কিশোর। ৬ জুলাই, সোমবার সন্ধ্যা ৬টা ৫৫ মিনিটে নিজের শহর রাজশাহীর মহিষবাথান এলাকায় তার বোন ডা. শিখা বিশ্বাসের বাড়িতে শেষ হলো তার জীবনের গল্প; পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিলেন তিনি। এন্ড্রু কিশোর ছিলেন এ দেশের সংগীত অঙ্গনের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। শ্রোতাদের হৃদয়ে স্বদেশ প্রেম ও মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করা ছিল তার গানের মূল বৈশিষ্ট্য। বাংলা গানের অপ্রতিদ্বন্দ্বী শিল্পী এন্ড্রু কিশোর চলে যাওয়ায় শুধু বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গন নয়, উপমহাদেশের সংগীতাঙ্গনে যে শূন্যতা সৃষ্টি হলো, তা আর পূরণ হবার নয়। কিন্তু তার গাওয়া কালজয়ী গানগুলোই তাকে সংগীত জগতে সমুজ্জ্বলে আসীন করে রাখবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মরহুমের আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, এন্ড্রু কিশোর তার গানের মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

লেখক : কবি ও সাংবাদিক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close