সাহাদাৎ রানা

  ১৪ জুলাই, ২০২০

মতামত

বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে অনিয়ম প্রসঙ্গে

মানুষের পাঁচটি মৌলিক অধিকারের মধ্যে চিকিৎসা হলো অন্যতম একটি অধিকার। মানুষের বাঁচা-মরার প্রশ্নটি এখানে সরাসরি জড়িত বলে চিকিৎসা প্রসঙ্গটি বারবার উচ্চারিত হয়। আর সেই অধিকার আমাদের দেশের সংবিধান তার নাগরিকদের দিয়েছে। তাই বিশে^র সব দেশের মতো আমাদের দেশেও চিকিৎসার বিষয়টি সব সময় আলাদা গুরুত্ব দেওয়া হয়। চিকিৎসা একটি মহান পেশা। আর চিকিৎসকরা সবসময় সবার কাছে বিশেষ কিছু। বিশেষ করে রোগীদের কাছে যেন ভিন্ন গ্রহের মানুষ। সব সময়ই তাই চিকিৎসকদের দেখা হয় বিশেষ মানুষ হিসেবে। শুধু চিকিৎসক নয়, এই পেশার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই রোগীদের কাছে সবসময়ই শ্রদ্ধার মানুষ। তবে সেই জায়গা থেকে মানুষ ধীরে ধীরে সরে আসছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে। বর্তমানে আমাদের দেশে চিকিৎসা বিষয়টি আর সেবাবান্ধব বলে কিছু নয়। হয়ে গেছে পুরোপুরি ব্যবসা। বর্তমানে করোনাকালে যা আবারও নতুন করে আমাদের সামনে এসেছে। বিশ্বের অন্য অনেক দেশে যখন করোনার মতো এমন কঠিন সময়ে চিকিৎসা বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট সবাই সতর্ক, সেখানে আমাদের চিত্র ভিন্ন। করোনাকে পুঁজি করে একশ্রেণির মানুষ টাকা উপার্জনের উপায় খুঁজছেন। প্রতারণা করছেন সাধারণ মানুষের সঙ্গে। বিশেষ করে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর অবস্থা এ ক্ষেত্রে ভয়াবহ।

একটু পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যায়, আমাদের শুরু থেকেই করোনা চিকিৎসা দেওয়ার ক্ষেত্রে বেশকিছু বেসরকারি হাসপাতাল ছিল উদাসীন। পরে অবশ্য সরকারের চাপে পড়ে কিছু বেসরকারি হাসপাতাল করোনা চিকিৎসায় নিজেদের যুক্ত করে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কিছু নিয়মনীতি দেওয়া হলেও এসব বেসরকারি হাসপাতাল কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করছে না। বিশেষ করে সম্প্র্রতি উত্তরার রিজেন্ট হাসপাতালের করোনা-সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশিত হওয়ার পর মানুষকে এ বিষয়ে শঙ্কিত করে তুলেছে। যেখানে করোনা টেস্ট না করে রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে রোগীদের। এখন প্রশ্ন হলো আর কতগুলো হাসপাতালে এমনটা করা হচ্ছে বা হয়েছে?

শুধু তাই নয়, শঙ্কার বিষয় হলো রিজেন্ট হাসপাতালের অনিয়মের তথ্য বেরিয়ে আসার পর বেরিয়ে এসেছে আরো অনেক তথ্য; যা এত দিন অনেকের কাছেই ছিল অজানা। এখানে আরো উদ্বেগের খবর হলো, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যেসব বেসরকারি হাসপাতাল ও ল্যাবকে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা ও সেবা প্রদানের অনুমতি দিয়েছে এসব অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের নেই লাইসেন্স নবায়ন। অন্য অনেক বিভাগের লাইসেন্স নবায়নের বিষয়টি না জানা থাকলেও স্বাস্থ্য বিভাগ জানবে না, এটা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ স্বাস্থ্য বিভাগের যাচাই-বাছাইয়ের পরই অনুমোদনের সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়। এখন প্রশ্ন হলো, তাহলে কারা যাচাই-বাছাই করল। কোন প্রক্রিয়ায় করা হলো। নিশ্চয় সেখানে কোনো ফাঁকি রয়েছে। এটা সত্য, এ ক্ষেত্রে কিছু অসাধু কর্মকর্তার সঙ্গে যোগসাজশে পরীক্ষা করার অনুমোদন নিয়েছে কিছু হাসপাতাল। দুঃখজনক তথ্য হলো, অনেক হাসপাতাল ‘পিসিআর’ পরীক্ষার অনুমোদন নিয়ে রাখলেও এজন্য প্রয়োজনীয় মেশিন ও সরঞ্জাম তাদের নেই। মেশিন ও সরঞ্জাম না থাকলেও অজানা ক্ষমতার প্রভাবে এসব বেসরকারি হাসপাতাল অনুমোদন পেয়েছে করোনা পরীক্ষার। আর এ সুযোগে পরীক্ষার নামে সেই অসাধু চক্র রোগীদের কাছ থেকে নিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের অর্থ। হাজার হাজার ভুয়া করোনা রিপোর্টের তথ্যই এর সবচেয়ে বড় প্রমাণপত্র। অথচ নিয়ম হলো, কোনো বেসরকারি হাসপাতালকে অনুমোদন দেওয়া হলে সবার আগে দেখতে হবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোয় করোনা রোগীর সেবা দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা রয়েছে কি না। কিন্তু এ ক্ষেত্রে এমন নিয়ম মানা হয়নি। কিছু অসাধু কর্মকর্তার সঙ্গে যোগসাজশে এসব করা হয়েছে।

আমাদের দেশের বাস্তবতায় মানুষ সরকারি হাসপাতালের ভোগান্তির কথা ভেবে বেসরকারি হাসপাতালমুখী হন। সবার বিশ^াস টাকা বেশি লাগলেও ভালো সেবা পাওয়া যাবে বেসরকারি হাসপাতালে। কিন্তু সম্প্রতি রাজধানীর উত্তরায় রিজেন্ট হাসপাতালে করোনা পরীক্ষার ভয়াবহ জালিয়াতির তথ্য সবাইকে হতবাক করে দিয়েছে। পাশাপাশি বিশ^াসের জায়গায়ও বড় রকমের ধাক্কা লেগেছে। বিশেষ করে করোনাকালীন এমন খবর সবার মনে গভীর উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা তৈরি করেছে। শুধু করোনা রোগী নয়, অন্য সাধারণ রোগী নিয়েও স্বজনদের ভয় কমেনি। বরং আরো বেড়েছে। আমাদের দেশে অবশ্য আগে থেকেই বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের বিষয়ে অনেক অভিযোগ রয়েছে। তার পরও মানুষ সরকারি হাসপাতালের অবহেলার কারণে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে যেত। কিন্তু উত্তরার রিজেন্ট হাসপাতালের তথ্য সবার সামনে প্রকাশিত হওয়ায় সবাই এখন নড়েচড়ে বসেছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সারা দেশে এমন অসংখ্য রিজেন্ট হাসপাতাল রয়েছে। যাদের প্রধান কাজ হলো মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করা ও অবৈধ পথে অর্থ উপার্জন করা।

পরিসংখ্যান বলছে, বর্তমানে সারা দেশে ১৭ হাজারের বেশি বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক রয়েছে। এমন পরিসংখ্যানের তথ্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের। যার অনুমোদন দিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ। এখানে শঙ্কার তথ্য হলো, অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের লাইসেন্স নবায়ন নেই। প্রতি বছর লাইসেন্স নবায়ন করা বাধ্যতামূলক হলেও অর্ধেকের বেশি বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের লাইসেন্স নবায়ন করা হয়নি। বরং যা কিছু হয়েছে তাও অবৈধ উপায়ে। আর বাকিগুলো লাইসেন্স ছাড়াই চলছে বছরের পর বছর। আর এসব কাজ করেন কিছু অসাধু কর্মকর্তা। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, স্বাস্থ্য বিভাগের দুর্নীতির কথা যেন সবার কাছে স্বাভাবিক ঘটনা। তবে প্রত্যাশা ছিল করোনাকালীন সেই দুর্নীতি কমে আসবে, কিন্তু কমেনি। বরং করোনাকে পুঁজি করে একশ্রেণির মানুষ প্রতারণা করছেন। বিশেষ করে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো আইন ও নিয়মনীতি না মেনে নিজের ইচ্ছে মতো যা ইচ্ছে তাই করছে।

শুধু তাই নয়, করোনাভাইরাসের এ সময়ে সাধারণ রোগীরা তাদের স্বাভাবিক চিকিৎসাসেবা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন, যা এক ধরনের দুর্ভাগ্যই বলা যায়। এতে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে শিশু ও বষস্ক রোগীরা। এ ছাড়া দেশে লাখ লাখ সাধারণ রোগী রয়েছেন। বিশেষ করে ক্যানসার, কিডনি ও হৃদরোগসহ অন্যান্য অসুখে গুরুতর অসুস্থ এমন রোগীরদেরও চিকিৎসা পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব রোগী এখন হাসপাতালেও যেতে পারছেন না। বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে গেলে চাওয়া হচ্ছে করোনা রিপোর্ট। এখানে সবচেয়ে বেশি অসহায় হয়ে পড়েছেন তাদের আত্মীয়স্বজনরা। সাধারণ রোগীদের হাসপাতালে নিয়ে গেলেও করোনা সন্দেহে সেখানে ভর্তি করানো হচ্ছে না। অথচ কেউ ভেবে দেখেন না করোনা ছাড়াও দেশে সাধারণ অনেক রোগী রয়েছেন।

বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের এ ধরনের কর্মকান্ড কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এমন কর্মকান্ড বড় ধরনের অপরাধও। এর দায় স্বাস্থ্য বিভাগ কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। যারা এসব কর্মকান্ডে জড়িত তাদের খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। সরকারের উচিত বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া; যা করতে হবে অতিদ্রুত। যেন সাধারণ মানুষের মধ্যে এই ধারণা জন্মে যে, কেউ অন্যায় করলেও পার পাবেন না।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close