মো. কায়ছার আলী

  ০৯ জুলাই, ২০২০

বিনম্র শ্রদ্ধা

সুরের জাদুকর এন্ড্রু কিশোর

‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে রইবো না আর বেশি দিন তোদের মাজারে’, অথবা ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস দম ফুরাইলে ঠুস’। মরণের ডাককে বারংবার স্মরণ করে অনুভূতির অবিনশ্বর মূর্ছনাকে বা মর্ম বিদায়ী আবেদনকে কোটি কোটি ভক্ত অনুরাগীর অসংখ্য গানের সুরের স্রোতে মুগ্ধ করে এবার সত্যিই না ফেরার দেশে চিরতরে চলে গেলেন সুরের জাদুকর এন্ড্রু কিশোর (১৯৫৫-২০২০)। দয়ালের ডাক এসে গেলে সবাইকে ঠুস হতে হয়। তাইতো যে রাজশাহীতে জন্ম, সেখানেই শেষ বিদায়। জীবনে পাওয়া না পাওয়ার হিসাব-নিকাশে কী আছে জানি না, তবে এটুকু জানি, তিনি আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। বাংলা সিনেমার সোনালি যুগে বা জোয়ারের সময় তার শ্রুতিমধুর কণ্ঠস্বর ছিল পরানের গহিনে শত শত আকুতি ভরা সুরের তালে তালে ছন্দে ছন্দে মোহিত করা একজন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো। হাসি-আনন্দ, প্রেম-বিরহ সর্বক্ষেত্রে গান গেয়ে তিনি আপামর জনগণের মনকে দোলা দিয়েছেন।

গান শুধু বিনোদনই নয়, কিছুটা জ্ঞান বিনিময়ের পথ। গানের মাধ্যমে সামাজিক মূল্যবোধ জাগ্রত বা ঘুণে ধরা সমাজকে অবক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করার অন্যতম হাতিয়ারও বলা যায়। অনেকে জানে না গানটির সুরকার কে? গীতিকার কে? কিন্তু তারা শিল্পীকে বা অভিনয় শিল্পীকে চিনেন এবং ওই সিনেমার নামটি জানেন। আপনার যে অসুখটি হয়েছিল সে অসুখে যমদূত ছায়ার মতো সঙ্গী হিসেবে রয়ে যায়। সব ক্ষেত্রে বলা ঠিক নয় ‘ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়’। মানুষ ইচ্ছা করলে হাজার বছর বাঁচবে না, পুনরায় শিশু হবে না, রাজা হতে পারবে কি না জানি না, যৌবনের সৌন্দর্য চিরকাল ধরে রাখতে পারবে না আর হারানো সময় কখনো ফিরে পাবে না। জীবনটাই হলো মৃত্যুর জন্য তৈরি। অপ্রিয়, অবিনশ্বর, অমোঘ এই চিরন্তন রীতির কাছে সবাই পরাজিত হতে বাধ্য। কীর্তিময় জীবন হোক বা না হোক সবাই এর স্বাদ এক দিন পাবে। তুমুল জনপ্রিয় গায়কির অনন্য শৈলীতে নিজেকে উন্নীত করেও তিনি সাদামাটা জীবনযাপনের অধিকারী ছিলেন। ভদ্র, বিনয়ী ও মার্জিত মানুষটিকে নিয়ে কখনো কোনো বিতর্ক হয়নি। অনেক মানুষ হঠাৎ চলে যায়, বলে যায় না বা যেতে পারে না। তবে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন আমার আর সময় নেই। তাইতো নিজেই দেশের পবিত্র মাটিতে ফিরতে চেয়েছিলেন এবং বলেছিলেন ‘দেশে গিয়ে মরতে চাই’।

অত্যন্ত নির্দয়, নিষ্ঠুর যমদূত এ মায়াভরা জগৎ সংসারে হাজির হয় নিতে, দিতে নয়। দেখতে দেখতে অনেক কিংবদন্তি চলে গেলেন, শূন্য হলো অনেক জায়গা, অনেক পদপদবি। হয়তো ধীরে ধীরে সবই স্বাভাবিক হবে। সব সৃষ্টি জগৎ এক দিন ধ্বংস হবে, শুধু রয়ে যাবেন চিরঞ্জীব বিধাতা। তিনিই মহাবিচার করবেন। দেহগত দূর অচিনপুরে রইলেও তিনি রয়ে যাবেন শুদ্ধ সংগীতচর্চায় এক মায়াভরা কণ্ঠস্বরে, সুরে। গুণীদের কাতারে রয়ে যাবে তার অমর নাম। কোনো দিন মুছে যাবে প্রায় ১৫ হাজার গান গাওয়া প্লেব্যাক সম্রাটের। ‘ভেজা চোখ’ সিনেমায় মরণব্যাধিতে আক্রান্ত ইলিয়াস কাঞ্চন তার যে অমর গানটি গেয়েছিলেন ‘জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প’। সেই অল্প সময় বাকি থাকতেই তিনি সিঙ্গাপুরে গিয়েছিলেন গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর। সেখানে ১৮ সেপ্টেম্বর তার ব্লাড ক্যানসার আক্রান্ত হওয়ার খবরটি ছিল সবার জন্য বিশাল আঘাত। ১০ মাস দীর্ঘমেয়াদি ও ব্যয়বহুল চিকিৎসায় তাকে সহায়তা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রবাস থেকে তার দুই ছেলে দেশে আসছেন। তার স্ত্রী ইতি কিশোর যথার্থই বলেছেন, ‘তিনি শুধু তার বা তাদের পরিবারের নয়, বরং দেশের মানুষের একটি অংশ বা সম্পদ’। ‘নয়নের আলো’ সিনেমায় অভিনীত জাফর ইকবাল আজ বেঁচে নেই, কিন্তু ওই সিনেমার সেই অমর গানটি যেটা তার অসুস্থ মাকে উদ্দেশ্য করে গেয়েছিলেন সেই গানটি রয়েই গেল’ আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটিও শুধু চোখ দুটো মাটি খেয়ো না, আমি মরে গেলেও তারি দেখার স্বাদ মিটবে না গো মিটবে না। তারে এক জনমে ভালোবেসে ভরবে না মন, ভরবে না...’। সারা জীবনজুড়ে মাটির সন্তান মাটির সন্ধান করে গেছেন। অবশেষে মাটির কাছেই ঠাঁই নিলেন। বিধাতার কাছে মিনতি একলা মাটির ঘরে থাকতে যেন তিনি ভয় না পান এবং দুচোখ দিয়ে যেন তিনি দেখতে পান দেশ-বিদেশে কোটি কোটি ভক্ত অনুরাগীকে। মাটির ঘর তথা পরপারে ভালো থাকুক এ মহান শিল্পী। এটা শুধু আমার নয়, আমাদের প্রার্থনা।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close