নাজমুন্নাহার নিপা

  ০৯ জুলাই, ২০২০

বিশ্লেষণ

নিরাপদ পানির নিশ্চয়তা অপরিহার্য

পরিবেশের অন্যতম প্রধান উপাদান হচ্ছে পানি। দিন দিন পানির চাহিদা বেড়েই চলছে। কিন্তু সেই পানি নিরাপদ না হলে তা জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। দূষিত পানি অনেক সময় মৃত্যুর কারণও হতে পারে। পানি ছাড়া এক দিনও চলা আমাদের পক্ষে অসম্ভব। প্রতিদিন প্রায় সব ধরনের কাজে আমাদের পানি লাগে। আমাদের শরীরের দুই-তৃতীয়াংশই হচ্ছে পানি যা রক্তে ৮৩ ভাগ, হাড়ে ২২ ভাগ, মস্তিষ্কে ৭৪ ভাগ, পেশিতে ৭৫ ভাগ। অর্থাৎ শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোর সঠিক কর্মসম্পাদনের জন্য পানির প্রয়োজনীয়তা অনেক। প্রতিদিন যদি যথেষ্ট পরিমাণ পানি পান না করা হয় তাহলে শরীর দ্রুত ক্লান্ত হয়ে পড়ে। গাছের গোড়ায় পানি না দিলে যেমন শুকিয়ে যায়; তেমনি পানির অভাবে আমাদের শরীরে পুষ্টি সরবরাহ ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ব্যাহত হয়। বিশ্বব্যাপী ত্বকের যতেœ যখন নামিদামি প্রসাধনসামগ্রীর ব্যবহার বাড়ছে তখন ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা ত্বক সুন্দর রাখতে পানি নিয়ে একটি ভিন্নধর্মী তথ্য দিয়েছেন। তারা গবেষণায় দেখেছেন, ত্বকে পানির পরিমাণ স্বাভাবিক থাকলে ত্বক ভালো থাকে ও ত্বকের ভাঁজ কমতে সাহায্য করে।

শরীরের প্রতিটি কাজে পানির সাহায্য প্রয়োজন। পানি রক্তে ও কোষে অক্সিজেন ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করে। এ ছাড়া সারা শরীরের রক্ত সরবরাহ ও সঞ্চালন বৃদ্ধি পায় পানি পানে। পানি শরীরের তাপমাত্রাও নিয়ন্ত্রণ করে। পানি হজম শক্তি বাড়ায়, হজম প্রক্রিয়া ঠিক রাখে। কেবল মানুষই নয়, প্রাণিকুলের স্বাভাবিক জীবনের জন্যও পানি প্রয়োজন। আদিকাল থেকেই বিশুদ্ধ খাবার পানি সংগ্রহ করার জন্য মানুষের প্রাণপণ চেষ্টা চলছে। যেভাবেই হোক মানবজীবনে বিশুদ্ধ খাবার পানির সরবরাহ নিশ্চিত করাই আমাদের প্রধান লক্ষ্য।

প্রাপ্তবয়স্ক একজন মানুষের দৈনিক ২ থেকে ৩ লিটার পানি পান করতে হয়। সুস্থ শরীর নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য পানি অন্যতম একটি নিয়ামক। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি ইনফরমেশন এর গবেষণা অনুযায়ী প্রতিদিন মাত্র ৫০০ মিলি লিটার পানি পান করলে দেহের বিপাক প্রক্রিয়া ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পায় এবং ২ লিটার পানি পান করলে ৪০০ কিলোজুল শক্তি উৎপাদন হয়। আমরা প্রতিদিন বিভিন্নভাবে (যেমনÑ ইউরিন, ঘাম, শ্বাসপ্রশ্বাস ইত্যাদি) শরীর থেকে পানি হারাই। আমাদের ফুসফুস থেকে নিঃশ্বাসের সঙ্গে দৈনিক দুই থেকে চার কাপ পানি বের হয়ে যায়, অন্যদিকে দৈনিক ছয়বার বাথরুমে গেলে আরো ছয় কাপ পানি দেহ থেকে কমে যাচ্ছে।

পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, রাজধানী ঢাকায় দৈনিক পানির প্রয়োজন ২২০ থেকে ২৩০ কোটি লিটার। ঢাকার পানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান গড়ে দিনের চাহিদার পুরোটাই সরবরাহও করে। তবে নগরবাসীর দীর্ঘদিনের অভিযোগ, ওয়াসার পানিতে মাত্রাতিরিক্ত দুর্গন্ধ ও ময়লা থাকে। দীর্ঘ সময় ধরে ফোটানো হলেও কিছু এলাকায় সরবরাহকৃত পানি থেকে দুর্গন্ধ যাচ্ছে না, তা পানযোগ্যও হচ্ছে না। কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরবরাহকৃত পানির ১৫ শতাংশ আসে সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার থেকে। শীতলক্ষ্যা ও বুড়িগঙ্গা থেকে পানি এনে শোধন করে তা নগরবাসীর জন্য সরবরাহ করা হয়। ভূগর্ভস্থ পানি বা নদী থেকে যে পানি আহরণ করা হয় সেটা দুই দফায় পরিশোধনের মাধ্যমে পুরোপুরি দূষণমুক্ত করা হয় ঠিকই তার পরও ঢাকার বাড়িগুলোয় এই বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা যায় না। তার কারণ যে পাইপলাইনের মাধ্যমে এই পানি মানুষের বাসাবাড়িতে সরবরাহ করা হয়, সেখানে লিকেজ বা পুরোনো পাইপের কারণে পানি দূষিত হয়ে পড়ে। এ ছাড়া বাড়ির ট্যাংকগুলো নিয়মিত পরিষ্কার না করাও পানি দূষিত হয়ে পড়ার আরেকটি কারণ।

ঢাকাসহ সারা দেশের সরবরাহকৃত পানির মান নিয়ে সম্প্রতি এক জরিপ চালায় বিশ্বব্যাংক। তাদের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাসাবাড়িতে যে পানি সরবরাহ হয় সেখানে ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ প্রায় ৮২ শতাংশ। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের আদর্শ মানমাত্রা অনুযায়ী পানীয় জলে শূন্য (০) ই-কোলাই এবং শূন্য (০) টোটাল কলিফর্ম থাকতে হবে। ভূগর্ভস্থ পানি নানাভাবে দূষিত হতে পারে এর মধ্যে অন্যতম একটি হলো, বৃষ্টির পানির সঙ্গে ভূপৃষ্ঠের দূষণ মিশ্রিত হয়ে ভূগর্ভে জমা হওয়া। অপরদিকে ভূপৃষ্ঠস্থ পানি দূষণের কারণ অনেক, এরমধ্যে কয়েকটি হলো, বিভিন্ন কল-কারখানার বর্জ্য পরিশোধন ব্যতীত নিকটস্থ জলাশয়ে মিশে যাওয়া; বিশেষ করে নদীতে নির্গত করা, গৃহস্থালি ময়লা আবর্জনা পুকুর, খাল-বিল ও অন্যান্য জলাশয়ে নিক্ষেপ এবং পানিতে থালা-বাসন ধোয়া, মানুষ ও গবাদিপশুর গোসল, পাটের আঁশ ছাড়ানোর সনাতন পদ্ধতির কারণে পানি দূষিত হয়। প্রাকৃতিক কারণে পশুপাখি ও বিভিন্ন জলজপ্রাণীর মৃতদেহ পানিতে মিশে পানি দূষিত হয়। এ ছাড়াও শহরের ড্রেনেজ লাইনের ময়লা আবর্জনা মিশ্রিত দূষিত পানি নদীতে মিশে পানি দূষিত হয়। সারা পৃথিবী নিরাপদ পানির সংকটে ভুগছে। ২৮টি দেশে নিরাপদ পানির অভাবের অবস্থা খুবই গুরুতর। ৩০ বছর পর পানির অভাবে দুর্গত লোকের সংখ্যা হবে দুই থেকে তিনশ কোটি।

এশিয়ান ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট আউটলুক-২০১৬ শীর্ষক এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ৪৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশে নদীর পানি সবচেয়ে বেশি দূষিত হচ্ছে আর নদী অববাহিকাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে অবনতি হয়েছে নেপাল, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত গঙ্গা অববাহিকার পানি। প্রতিবেদনটিতে আরো বলা হয়েছে, পানি নিরাপত্তার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ঝুঁকিপূর্ণ। এ দেশের মাটির ওপরের ও নিচের দুই ধরনের পানির অবস্থাই খারাপ। বাংলাদেশে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের প্রবণতা অনেক বেশি। এ দেশে প্রতি বছর ৩০ দশমিক ২১ ঘন কিলোমিটার পানি উত্তোলন করা হয় ভূগর্ভ থেকে, যার ৮৬ শতাংশ ব্যবহৃত হয় কৃষিকাজে, বাকি ১৩ শতাংশ গৃহস্থালি কাজে এবং ১ শতাংশ পানি শিল্পের কাজে ব্যবহৃত হয়। পরিবেশগত ঝুঁকি বৃদ্ধির একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে ভূগর্ভস্থ থেকে ব্যাপক হারে পানি উত্তোলন।

অস্বাভাবিক জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আগামীতে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে চলেছে যার ফলে পানির সংকট আরো তীব্রতর হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রচলিত পানির উৎসগুলো আর্সেনিক, আয়রন, ব্যাকটেরিয়াসহ নানা ধরনের দূষণের শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ফলে পানির গুণগত মান নিশ্চিত করাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পানির অপর নাম জীবন হলেও যদি সেটা দূষিত হয়, তাহলে পানিই হতে পারে নানা রোগের কারণ। দূষিত পানি পান করার কারণে সম্প্রতি পানিবাহিত রোগের প্রকোপ ভয়াবহ হারে বেড়ে গেছে।

প্রতি বছর বিশ্বের প্রায় ৩১ লাখ মানুষ দূষিত পানি পান করার ফলে নানা রকম রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এদের প্রায় ৯০ শতাংশই ৫ বছরেরও কম বয়সের শিশু। বিশ্বে প্রতি ১৫ সেকেন্ডে একজন করে শিশু পানিবাহিত রোগে মারা যায়। হেপাটাইটিস, টাইফয়েড, ডায়রিয়া, কলেরা, আমাশয়, জন্ডিসের মতো মারাত্মক ব্যাধির উৎস হচ্ছে দূষিত পানি। দূষিত পানি থেকে ক্যানসারের মতো মারাত্মক রোগও হতে পারে এমনই তথ্য দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি’। তাদের প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়, দূষিত পানিতে এমন কিছু রাসায়নিক আছে, যা মানুষের প্যানক্রিয়াসের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়। ফলে ইনসুলিনের স্বাভাবিক নিঃসরণ বন্ধ হয়ে মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়। দীর্ঘদিন দূষিত পানি ব্যবহারের কারণে শরীরে টক্সিন (বিষাক্ত পদার্থ) জমা হয়, যা বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়। দূষিত পানির ফলে কিডনি রোগ, দীর্ঘমেয়াদি লিভার সমস্যা এবং চক্ষুরোগী বাড়ছে।

এ ক্ষেত্রে স্মরণ রাখতে হবে বিশুদ্ধ পানির নিশ্চয়তা দিতে না পারলে জনস্বাস্থ্যকে হুমকিমুক্ত করা যাবে না। নিরাপদ পানি পানে পানি পরিশোধন এর বিকল্প নেই। পুকুর, কুয়া, খাল ও অন্যান্য ছোট জলাশয়ে যেখানে বাহ্যিক কোনো দূষণ নেই এমন পানিকে ছেঁকে নিয়ে ফিটকিরি দিয়ে পরিষ্কার করা যায়, এভাবে দ্রবীভূত অবাঞ্চিত উপাদান যেমনÑ ফাইটোপ্লাঙ্কটন তলানি আকারে জমা হয়। এ ছাড়া বর্তামানে পানি নিরাপদ করতে এক ধরনের বড়ি ব্যবহার করা হয়, যা হ্যালোজেন ট্যাবলেট বা হ্যালোট্যাব নামে পরিচিত। পানির জীবাণু ধ্বংস করতে ক্লোরিন বহুল ব্যবহৃত একটি রাসায়নিক। বিংশ শতাব্দীর এই যুগে পানি বিশুদ্ধকরণের অনেক অত্যাধুনিক পদ্ধতি রয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি হলো আল্ট্রাভায়োলেট রিভার্স ওসমোসিস প্রযুক্তি। পরিষ্কার ও স্বচ্ছ পানি জীবাণুমুক্ত করার জন্য অতিবেগুনি বিকিরণ কার্যকরী একটা পদ্ধতি। জাতিসংঘের ৪৭তম সাধারণ পরিষদে সতর্কবাণী হিসেবে বলা হয়, বিশ্ববাসীগণ, পানি সাশ্রয় করুন, যুক্তিযুক্তভাবে তা ব্যবহার করুন এবং পানিসম্পদ সুরক্ষা করুন। লেখক : শিক্ষার্থী

এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close