মাহবুবুল আলম

  ০৯ জুলাই, ২০২০

পর্যালোচনা

ভ্যাকসিন নিয়ে আর এক স্নায়ুযুদ্ধ

করোনাভাইরাস প্যান্ডেমিক আকারে দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ মানুষ মারা গেছে এবং প্রতিদিনই মারা যাচ্ছে। আক্রান্তের ঘর ছাড়িয়েছে কোটির ওপরে। ভাইরাসটি অত্যন্ত ছোঁয়াচে। মুহূর্তেই একজনের কাছ থেকে অসংখ্য মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এর সংক্রমণে পুরো বিশ্ব দিশাহারা হয়ে পড়েছে। জার্মান, ফ্রান্সসহ উন্নত বিশ্বের দেশগুলো করোনার দ্রুত ভ্যাকসিন উৎপাদনে নিরলস গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। গবেষক ও বিজ্ঞানীরা করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কারে দিন-রাত এক করে ফেলেছেন। যে কাজ করতে এক যুগের অধিক সময় লাগে, সে কাজ তারা পাঁচ মাস ধরে করছেন এবং এর মধ্যে শতাধিক ভ্যাকসিন আবিষ্কারের কথা জানিয়েছেন। যদিও সেগুলোর কার্যকারিতা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।

কোভিড-১৯-এর ছোবলে পৃথিবী আজ এক মহাসংকটকাল পার করছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর ইতিহাসে এমন সময় এসেছে বলে জানা যায় না, যেখানে প্রায় গোটা পৃথিবী একসঙ্গে অবরুদ্ধ। আমরা সবাই জানি, যেকোনো রোগ দীর্ঘস্থায়ী হয় না। তবে এ কথা সত্য, প্রতিটি খারাপ সময় বেশকিছু দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তন এনে দেয়। কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাসও ঠিক তেমনি পরিবর্তন আনতে চলেছে, তা এখন নিশ্চিতভাবে বলা যেতে পারে। করোনাভাইরাসের টিকা আবিষ্কার নিয়ে বিশ্বব্যাপী তুমুল প্রতিযোগিতা চলছে। পাশাপাশি ক্ষমতার যুদ্ধও শুরু হয়েছে। এ প্রতিযোগিতা মূলত শুরু হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে। এ যুদ্ধকে বলা যায়, ‘টিকাযুদ্ধ’। কারণ যে দেশ করোনার প্রথম কার্যকর ও নিরাপদ ভ্যাকসিন বা টিকা আবিষ্কার করতে পারবে, সে দেশ এ টিকা নিয়ে বিশ্বে ছড়ি ঘোরাতে পারবে। তার কাছে পুরো বিশ্ব জিম্মি হয়ে পড়বে। দেশটি তখন এর মাধ্যমে বাণিজ্য শুরু করবে এবং বিনিময়ে তার স্বার্থ আদায় করে নেবে। এ যুদ্ধ ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে।

যুক্তরাষ্ট্র অনেকটা তড়িঘড়ি করেই রেমডিসিভি নামে ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু করে দিয়েছে। শুরুতে এর ফলাফল খুব বেশি ইতিবাচক বলে ঘোষণা করা হয়নি। কয়েক দিন পর ঘোষণা করা হয়েছে, এটি গুরুতর অসুস্থ রোগীদের জন্য খুবই কার্যকর এবং এটি ১১ দিনের মধ্যে রোগীকে সুস্থ করে তোলে। যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ প্রশাসন এফডিএ তার অনুমোদনও দিয়ে দেয়। এদিকে চীনও করোনার কার্যকর ভ্যাকসিন আবিষ্কার করে ফেলেছে বলে জানা গেছে। এরই মধ্যে তা মানুষের মধ্যে প্রয়োগ শুরু করেছে। তবে অন্য দেশের ভ্যাকসিন আবিষ্কার নিয়ে যত মাতামাতি হচ্ছে, চীনেরটি নিয়ে তেমন কোনো আলোচনাই নেই। চীনও চুপচাপ রয়েছে। এখানেই চীনের সূক্ষ্ম কূটনীতি বা কৌশল। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যেহেতু চীনেই এই ভাইরাসের প্রথম উৎপত্তি এবং তারা সংগ্রাম করে এ থেকে মুক্ত হয়েছে, তাই এ রোগের চরিত্র সম্পর্কে তাদর সবচেয়ে বেশি জানার কথা। প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও চীন সবচেয়ে বেশি এগিয়ে। ফলে তার পক্ষেই সম্ভব করোনার কার্যকর প্রতিষেধক আবিষ্কার করা। বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রও ভালো করেই জানে।

কোভিড-১৯ প্রমাণ করে দিয়েছে, সংক্রামক ব্যাধি রাজনৈতিক সীমানা মানে না। যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে ন্যায্যতা নিশ্চিত না করছি; ততক্ষণ আমরা একটা সংক্রামক ব্যাধির বৈশ্বিক হুমকি মোকাবিলা করতে পারব না। বিশ্বজুড়ে এ মুহূর্তে করোনাভাইরাসের টিকা আবিষ্কারের জন্য মোট ৪৪টি প্রকল্পের কাজ চলছে। বিজ্ঞানী এবং গবেষকদের যেসব দল এই কাজে নিয়োজিত কেইট ব্রোডেরিক তাদের একটি দলের সদস্য। তিনি একজন অণুজীব জিনবিজ্ঞানী। কেইট ব্রোডেরিক কাজ করেন যুক্তরাষ্ট্রের একটি বায়োটেকনোলজি কোম্পানি ইনোভিওতে। এই কোম্পানিটি আশা করছে, এ বছরের ডিসেম্বর মাস নাগাদ তারা কোভিড-১৯-এর টিকার ১০ লাখ ডোজ তৈরি করতে পারবে। কিন্তু এই টিকা কোথায় পাওয়া যাবে, কাদের দেওয়া হবে?

বিশ্বে মহামারি করোনার প্রতিষেধক তৈরির দৌড়ে এগিয়ে রয়েছে পাঁচটি নামি সংস্থা। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, সহসাই করোনার সম্ভাব্য ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা জানা যাবে। আর সেপ্টেম্বর থেকে মানুষের শরীরে প্রয়োগ করা যাবে করোনার ভ্যাকসিন। সারা বিশ্বে ভ্যাকসিন পৌঁছে দিতে সময় লাগতে পারে আরো তিন থেকে ছয় মাস। জানুয়ারিতে কোভিড-১৯-এর জেনেটিক সিকোয়েন্স প্রকাশের ঠিক আট সপ্তাহের মাথায় মর্ডানার এমআরএনএ-১২৭৩ ভ্যাকসিনের প্রথম ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ম্যাসাচুসেটস বায়োটেকনোলজি সংস্থা (মর্ডানা)। সম্প্রতি মার্কিন বায়োটেক সংস্থা জানিয়েছে, প্রাথমিক পর্যায়ের ট্রায়ালে ৪৫ জন স্বেচ্ছাসেবকে এ ভ্যাকসিন প্রয়োগ করে। মর্ডানা দাবি করেছে, ভ্যাকসিন স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে অ্যান্টিবডি তৈরি করেছে। ভ্যাকসিনটি আসলে মানবদেহে কাজ করে কি না, তা দেখার লক্ষ্যে সংস্থাটি জুলাইয়ে বৃহৎ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করার পরিকল্পনা করেছে। এ ছাড়াও এমআরএনএ-১২৭৩ ভ্যাকসিনে ইঁদুরের ফুসফুসে ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

চীনা সংস্থা ক্যানসিনো বায়োলজিকস। ক্যানসিনোর অ্যাড৫-এনসিওভি ভ্যাকসিনের প্রথম ট্রায়াল শেষ করে তারা দ্বিতীয় ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করেছে। ক্যানসিনো তৈরি ভ্যাকসিনটি অক্সফোর্ডের মতো ডিএনএ ভ্যাকসিন। পিপলস লিবারেশন আর্মির মেডিকেল সায়েন্স বাহিনী নিয়ে কাজ করা ক্যানসিনো প্রথম পর্যায়ের পরীক্ষার বিস্তারিত ফলাফল প্রকাশ করেনি। কেবল এটুকু বলেছে, প্রথম পর্বের ‘প্রাথমিক সুরক্ষা তথ্যের’ ভিত্তিতে দ্বিতীয় পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রায় ৫০০ জন স্বেচ্ছাসেবক ট্রায়ালে অংশ নিয়েছেন।

যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। তাদের তৈরি করোনার সিএইচএডিএক্স১ এনকোভ-১৯ ভ্যাকসিন। এ ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা আসছে জুলাইয়ের মধ্যেই জানা যাবে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। ভ্যাকসিনটি যদি কার্যকর হয়, তাহলে সেপ্টেম্বরের মধ্যে এক মিলিয়ন ডোজ ভ্যাকসিন উৎপাদন করার লক্ষ্য নিয়ে তারা এগোচ্ছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্য রিজিয়াস প্রফেসর অব মেডিসিন স্যার জন বেল বলেন, ভ্যাকসিনটি নিয়ে আমরা আত্মবিশ্বাসী। কারণ এটি শক্তিশালী অ্যান্টিবডি তৈরিতে সক্ষম। এরই মধ্যে যুক্তরাজ্যের বৃহৎ ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন তৈরিতে অক্সফোর্ডের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছ।

ইম্পেরিয়াল এমন একটি ভ্যাকসিন তৈরি করছে, যা মানুষের আগে পরীক্ষা করা হয়নি। অধ্যাপক রবিন শাটকের নেতৃত্বে দলটি ফেব্রুয়ারির প্রথম থেকেই ভ্যাকসিনটি পশুদের শরীরে পরীক্ষা করে আসছে। জুনে তারা মানবদেহে ভ্যাকসিন প্রয়োগের কথা বলেছে। প্রাথমিকভাবে সরকারি অর্থায়নে ২২.৫ মিলিয়ন ডলার পেয়েছিল গবেষণা করতে। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটিকে অতিরিক্ত ১৮.৫ মিলিয়ন ডলার দেওয়ার ঘোষণা করা হয়েছে। এ বছরের শেষের দিকে তিনটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করতে সক্ষম করবে। তবে সেপ্টেম্বরের মধ্যে যুক্তরাজ্যে যেকোনো একটি কার্যকরী ভ্যাকসিন ব্যবহারের সম্ভাবনা খুব বেশি।

মার্কিন বায়োটেক সংস্থা ইনোভিও ফার্মাসিউটিক্যাল। ইনোভিও গত মাসে করোনাভাইরাসের সম্ভাব্য একটি ভ্যাকসিনের পরীক্ষামূলক প্রয়োগের অনুমতি পেয়েছে। আইএনও-৪৮০০ ভ্যাকসিনের প্রাক-মডেলগুলোতে প্রতিরোধের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। সংস্থাটি তার প্রথম ধাপের পরীক্ষার জন্য ৪০ জন স্বাস্থ্যবান মানুষকে তালিকাভুক্ত করেছে। আশা করা যাচ্ছে, এরই মধ্যে তারা কার্যকারিতা পরীক্ষার পর্যায়ে যেতে পারে। এই ভ্যাকসিনের জন্য কোয়ালিশন ফর এপিডেমিক প্রিপারডেন্সনেস ইনোভেশনসের কাছ থেকে মোট ১৪ মিলিয়ন ডলার অনুদান পেয়েছে সংস্থাটি।

ভারতে তৈরি প্রথম করোনভাইরাসের ভ্যাকসিন ১৫ আগস্ট লঞ্চ করার বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিকেল রিসার্চ। এর নামকরণ করা হয়েছে কো-ভ্যাকসিন। চলতি সপ্তাহেই ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরুর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রয়টার্সের খবর অনুযায়ী ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিকেল রিসার্চের সঙ্গে যুক্ত হয়ে করোনাভাইরাসের টিকা তৈরির চেষ্টা করছে হায়দ্রাবাদভিত্তিক বায়ো-থেরাপিউটিকস নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ‘ভারত বায়োটেক’, যারা এ সপ্তাহে টিকার প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমোদন পেয়েছে। ২ জুলাই টিকার ট্রায়ালের সঙ্গে জড়িত ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে উদ্দেশ্য করে লেখা চিঠিতে বলরাম ভার্গব উল্লেখ করেনÑ ‘সব ধরনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সম্পন্ন হওয়ার পর জনস্বাস্থ্যে ব্যবহারের জন্য সর্বশেষ ১৫ আগস্ট, ২০২০-এর মধ্যে এই টিকা প্রস্তুত করার বিষয়ে বিবেচনা করা হচ্ছে।’

বাংলাদেশের প্রথম ভ্যাকসিন আবিষ্কারের দাবি করেছে গ্লোব ফার্মাসিউটিক্যালস। ১ জুলাই গ্লোব বায়োটেক লিমিটেডের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, তারা পশুর শরীরে এই ভ্যাকসিনের সফলতা পেয়েছে এবং একইভাবে মানবদেহেও এর সফলতা পাওয়া সম্ভব। তবে আন্তর্জাতিক নীতিমালাতেও কোনো ভ্যাকসিন কিংবা ড্রাগ আবিষ্কারের পর তার পূর্ণাঙ্গ ডেটা, ট্রায়াল, আন্তর্জাতিক জার্নালে রিপোর্ট পাবলিশমেন্ট সম্পন্ন করার পর আবিষ্কারের ‘দাবি’ করা হয়ে থাকে। যা এখনো বাংলাদেশে অনুপস্থিত। এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই প্রতিষ্ঠানটি জানায়, এনসিবিআই ভাইরাস ডেটাবেইজ অনুযায়ী গত মঙ্গলবার পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী ৫ হাজার ৭৪৩টি সম্পূর্ণ জিনোম সিকোয়েন্স জমা হয়েছে; যার মধ্যে বাংলাদেশ থেকে জমা হয়েছে ৭৬টি। সব সিকোয়েন্স বায়োইনফরম্যাটিকস টুলের মাধ্যমে পরীক্ষা করে গ্লোব বায়োটেক লিমিটেড তাদের টিকার টার্গেট নিশ্চিত করে। যা যৌক্তিকভাবে এই ভৌগোলিক অঞ্চলে অধিকতর কার্যকরী হবে বলে আশা করছেন তারা। আমি ব্যক্তিগতভাবে গ্লোব ফার্মাসিউটিক্যালের উদ্যোগকে স্বাগত জানাই।

লেখক : কবি-কথাসাহিত্যিক কলামিস্ট ও গবেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close