রায়হান আহমেদ তপাদার

  ০৮ জুলাই, ২০২০

বিশ্লেষণ

আদর্শ রাজনীতির সন্ধানে তরুণ প্রজন্ম

রাজনীতি মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের মাধ্যম, তাই রাজনীতির প্রতি মানুষের আগ্রহ সৃষ্টির শুরু থেকেই। রাজনীতির গতি-প্রকৃতি কোনদিকে যায়, তার প্রতি মানুষের তীক্ষè দৃষ্টি থাকে। আমার দেশ তোমার দেশের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর এমন অভিব্যক্তির মাধ্যমে মূলত দেশপ্রেম প্রকাশ করাটা জরুরি নয়। এটি অত্যন্ত সংকীর্ণ ও বিকৃত অভিব্যক্তি। যে দেশপ্রেম অন্য জাতিকে হেয় করে, তা উৎকট স্বাদেশিকতা এবং বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে। জাপানিদের উন্নয়নের একটি প্রধান কারণ হলো তাদের দেশপ্রেম জাতীয় অহংকারে পরিণত হয়েছে। মানসম্মত পণ্য এবং দায়িত্বপূর্ণ আচরণ জাপানি দেশপ্রেমের নিদর্শন। রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হয় কার্যত রাজনৈতিক নেতৃত্বের দ্বারা, নেতৃত্ব কলুষিত হয়ে গেলে রাজনীতি মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের পরিবর্তে মানুষের ভাগ্যে নেমে আসে অবধারিত দুর্যোগ। বর্তমান বিশ্বে রাজনীতি আর রাজনীতিবিদদের হাতে নেই, এখানে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন ব্যবসায়ী ও টাকাওয়ালারা; প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিবিদরা এই টাকাওয়ালাদের কাছে এক ধরনের জিম্মি। সারা জীবন যিনি রাজনীতির জন্য জীবনের মূল্যবান সময় ব্যয় করলেন, জীবন উৎসর্গ করে পরিবারের সদস্যদের সময় না দিয়ে রাজনীতির মাঠ তৈরি করলেন; তৈরি করলেন অগণিত নেতাকর্মী ও শুভাকাক্সক্ষী। কিন্তু দেখা গেল একজন টাকাওয়ালা ব্যক্তি এসে হঠাৎ তার স্থান দখল করে বসলেন।

দেশভাগের পর থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত আমাদের গৌরবময় অর্জনগুলো সম্ভব হয়েছিল দেশের মানুষের রাজনৈতিক বোধ আর সক্রিয়তার কারণেই। আর তার জ্বলন্ত উদাহরণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেসময় দেশ পেয়েছিল বিচক্ষণ আর কর্তব্যনিষ্ঠ রাজনীতিবিদ যথাযথ রাজনৈতিক চর্চার মাধ্যমে তৈরি হয়েছিল অনেক তীক্ষè ছাত্রনেতা। গ্রিক দার্শনিক প্লেটো মনে করতেন, রাষ্ট্র শাসনের কাজে যুক্ত হওয়া সবার পক্ষে সম্ভব নয়। যাদের মধ্যে এই গুরুদায়িত্ব পালনের সহজাত যোগ্যতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক সামর্থ্য দেখা যাবে, সেই মানুষের বিশেষ রাজনৈতিক শিক্ষায় দীক্ষিত করতে হবে। যে রাজনৈতিক শিক্ষা তাদের শেখাবে বিত্ত এবং ক্ষমতা লাভ করলেই জীবন অর্থবহ হয় না। প্রকৃত অর্থে সুন্দর জীবন হলো, প্রজ্ঞা, শুভবোধ ও ন্যায়বিচার দিয়ে পরিচালিত জীবন। প্লেটোর বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, রাজনীতি কোনো মামুলি ব্যাপার নয়। রাজনীতিবিদ হওয়ার জন্য দরকার বুদ্ধিবৃত্তিক যোগ্যতা আর প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও দেশের প্রতি কর্তব্য পালনের মানসিকতা। এ কারণেই প্লেটো বলেছিলেন, যারা রাজনীতিতে আসবেন তাদের পরিবার থেকে আলাদা করে প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যেন নিজের কাছের মানুষদের চেয়ে রাষ্ট্রকে বেশি সেবা করার মানসিকতা তাদের মধ্যে তৈরি হয়। রাজা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রধান পরামর্শদাতা চানক্য বলে ছিলেন রাজ্য সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য মন্ত্রীরা শাসককে মূল্যবান এবং যৌক্তিক পরামর্শ দেবেন। চানক্য মনে করতেন, রাষ্ট্র হলো একটি গাড়ি আর দেশের শাসক গাড়ির একটি চাকা। গাড়ির অন্য চাকাগুলো হলো দেশের মন্ত্রীরা।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এক চাকায় যেমন গাড়ি চলবে না; তেমনি মন্ত্রীরা রাজনীতি-অভিজ্ঞ ও সুবিবেচক না হলে শাসক একা রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারবেন না। রাজনীতি করলে, জনপ্রতিনিধি হলে যে ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম, দুর্নীতি থেকে দূরে থেকে সত্যিকার অর্থেই মানুষের সেবা করতে হবে, সেই রাজনৈতিক শিক্ষা কি রাজনৈতিক দল এই মানুষের দিয়েছিল? রাজনীতি করা, সংসদে দায়িত্ব পালন করা সহজ কোনো কাজ নয় যে, প্রকৃত রাজনীতির প্রয়োজনীয় পাঠ এবং চর্চা ছাড়া এবং জটিল দায়িত্ব পালনের মতো বুদ্ধিবৃত্তি ছাড়া যে কেউ রাজনীতিবিদ হয়ে যাবেন। সৎভাবে জীবনযাপন করা কেন জরুরি, তা বোঝার জ্ঞান যে রাষ্ট্রে মানুষের তৈরি হয় না, সেই রাষ্ট্র একটি নির্বোধ রাষ্ট্র। আর যে রাষ্ট্রে মানুষ জানে ন্যায় আর সততা কী, কিন্তু জানার পরও তারা সৎভাবে জীবনযাপন না করে অন্যায় কাজ করে, সেই রাষ্ট্র হচ্ছে একটি বিকৃত চিন্তার রাষ্ট্র। আল-ফারাবির মতে, কোনো রাষ্ট্র এমন হয়ে গেলে বুঝতে হবে; সেই রাষ্ট্রের সরকার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। এই তিন ধরনের ত্রুটিপূর্ণ রাষ্ট্রেই জীবন প্রকৃত অর্থে সুন্দর করে তোলার ব্যাপারে মানুষের মনোযোগ থাকে না। তাদের আগ্রহ থাকে অনেক টাকার মালিক হওয়ার প্রতি আর ভোগসর্বস্ব জীবনযাপনের প্রতি। দুঃখজনক যে, আমাদের দেশে যেভাবে বিভিন্ন সময় দুর্নীতি, দখলবাজি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, অবৈধ ব্যবসা, অনিয়ম, রাজনৈতিক ক্ষমতায় মত্ত হয়ে সন্ত্রাস আর নির্যাতনের ঘটনা আমরা দেখতে পাই, তাতে বোঝা যায় আল-ফারাবি বর্ণিত সেই ধরনের মানুষের সংখ্যা এখানে কম নয়। রাজনীতির প্রকৃত উদ্দেশ্য যদি হয় জনকল্যাণ, তাহলে রাজনীতি করে সম্পদশালী হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

অথচ আমাদের সমাজে দুর্নীতি হচ্ছেই। দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষ যদি এই দেশে রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাশালী হন, তাহলে জনগণের কল্যাণের জন্য তারা কাজ করছেনÑ রাজনৈতিক দলগুলোর এমন দাবি বিশ্বাসযোগ্য হবে না। এখানে যখন যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকে, সেই দলের ছাত্র সংগঠন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে ক্ষমতার দাপট দেখাতে শুরু করে। সেই সঙ্গে যুক্ত হয় মূল দলের সব কাজের প্রতি সম্মতি প্রদর্শন। মূল দলের কোনো নেতার কর্মকান্ড বিতর্কিত হলেও ছাত্র সংগঠন তার সমালোচনা করে না। বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা এমন রাজনৈতিক চর্চায় অভ্যস্ত হওয়ার পর কী করে আশা করা যায় যে, তারা দেশে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি শক্তিশালী করার ব্যাপারে ভবিষ্যতে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখবে? রাজনীতির অর্থ তো নিজ স্বার্থে নেতাদের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন আর ক্ষমতার দাপট দেখানো নয়। প্রখ্যাত মার্কিন লেখক হেনরি ডেভিড থোরো গুরুত্ব দিয়েছিলেন মানুষের নীতিচেতনা। থোরো মনে করতেন, নির্দিষ্ট কোনো বিধি মানার পরিবর্তে একজন ব্যক্তির নৈতিক বোধ তাকে যে কাজ করতে বলে, তার তাই করা উচিত। আর মানুষ তার নীতিচেতনা অনুযায়ী কাজ না করলে রাষ্ট্রে অন্যায় বাড়বে। নৈতিক বোধবিহীন মানুষের থোরো তুলনা করেছিলেন প্রাণহীন কাঠ বা পাথরের টুকরোর সঙ্গে; যা ব্যবহার করেই তৈরি করা হয় অত্যাচার আর নিপীড়ন করার যন্ত্র। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ তো তাদের নীতি বাদ দিয়ে রাজনীতি করেননি। অন্যায় দেখেও নিজ স্বার্থের জন্য তারা নীরব থাকেননি। তারা শোষণমূলক ক্ষমতাশালী গোষ্ঠীর বিরোধিতা করেছেন যৌক্তিকভাবে।

এবং তাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব তাই অজস্র মানুষকে নৈতিক সাহসে উজ্জীবিত হয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে অনুপ্রাণিত করেছিল। রাজনীতিবিদরা তাই তখনই সফল, যখন তারা নিজেদের স্বার্থের জন্য মানুষের ওপর অন্যায়ভাবে কর্তৃত্ব করার পরিবর্তে মানুষের মুক্তির জন্য কাজ করেন। রুশ বিপ্লবী আলেকজান্ডার হারজেন যেমন বলেছিলেন, সবার জন্য সত্যিকারের স্বাধীনতাই হলো প্রকৃত বিপ্লবের মূল আদর্শ। হারজেন সতর্ক করে ছিলেন যে, কিছু রাজনীতিবিদ কেবল নিজেদের মুক্তি নিশ্চিত করেন, জনসাধারণের অবস্থার পরিবর্তন করার প্রতি তাদের আগ্রহ থাকে না। এই রাজনীতিবিদরা যেন মানুষের পায়ের শিকল ভেঙেছেন ঠিকই, কিন্তু কারাগারের দেয়াল ভেঙে দেননি। তা তারা নিজেদের সুবিধার জন্য ঠিকই টিকিয়ে রাখেন এবং গণমানুষের প্রকৃত মুক্তি আসে না। হারজেনের এই বক্তব্য বিভিন্ন সময়ে দেখতে পাওয়া বাস্তব অবস্থাই বর্ণনা করে। রাজনীতি যদি একটি ক্ষুদ্র ক্ষমতাশালী গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার হাতিয়ারে পরিণত হয়, তাহলে তা আর রাজনীতি থাকে না। আমাদের দেশের সাম্প্রতিক রাজনীতি কেবল মুখের কথায় নয়, সত্যিকার অর্থেই কি সাধারণ মানুষের কল্যাণ করছে? রাজনীতি যারা করেন তাদের এবং সচেতন নাগরিকদের এই প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া দরকার। দেশের অভ্যন্তরে বা বাইরে নাগরিকদের প্রতিটি কাজে, সিদ্ধান্তে এবং আচরণে জাতীয় গর্বের প্রতিফলন ঘটতে হবে। এ প্রতিফলন কেবল দেশের অভ্যন্তরে পারস্পরিক আচরণে ঘটলেই চলবে না, প্রতিটি নাগরিক একজন রাষ্ট্রদূত হিসেবে একজন অতিথি আপ্যায়নে কিংবা নিজ প্রবাসে অবস্থানকালীনও একই আচরণ বজায় রাখতে হবে।

রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেশীয় অহংকার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হতে হবে। নিজের দেশকে ভালোবাসা মানে অন্যের দেশকে ঘৃণা করা নয়। নিজের শ্রেষ্ঠত্বকে প্রমাণের জন্য অন্য জাতিকে হেয় করাকে অবাস্তব দেশপ্রেম বলা হয়। এই গ্রহের অংশীদার হিসেবে আমরা পরস্পরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আপনি যা করবেন, তা আমাকে প্রভাবিত করবে এবং আমার কাজ আপনার ওপর বর্তাবে; এ কারণেই পারস্পরিক সামাজিক দায়িত্ববোধ ও মানবিক মূল্যায়নের ওপর প্রতিটি দেশের কাঠামো প্রস্তুত হয়। রাজনীতিতে শেষ বলে কথা নেই এ ধরনের ধোঁকাবাজি, নীতিহীন ও স্বার্থবাদিতার কথা যারা বলেন, মূলত তারাই সুস্থ রাজনীতি ধ্বংস করে দিচ্ছেন। তরুণ মেধাবী শ্রেণি তাদের এই কূটকথা বোঝে বলেই রাজনীতিবিমুখ এবং অনাগ্রহী হয়ে পড়েছে। এটা কোনোভাবেই দেশের জন্য কল্যাণকর হতে পারে না। এ পরিস্থিতির অবসান হওয়া জরুরি। শিক্ষিত তরুণদের মানসিকতা ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী দলগুলোর উপলব্ধি করা এখন সময়ের দাবি। তাদের একপেশে দৃষ্টিভঙ্গির রাজনীতি পরিবর্তন করতে হবে। দেশের ভবিষ্যৎ যাদের ওপর নির্ভরশীল এবং যারা সত্যিকার অর্থে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার সক্ষমতা রাখে, সেই শিক্ষিত ও যোগ্য তরুণ শ্রেণিকে দেশের সম্পদ ভেবে কাজে লাগানোর উদ্যোগ নিতে হবে। তা না হলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে স্বার্থবাদের রাজনীতি চলছে, তা দেশে ভয়াবহ সংকট তৈরি করবে। উৎসর্গ মানে সব সময় হারানো নয়, বরঞ্চ বেছে নেওয়ার চেয়ে বেশি কিছু। এর অর্থ হলো, বৃহত্তর অর্জনের জন্য ক্ষুদ্রতর বিসর্জন। মহৎ নেতৃত্ব বিরক্তি নয়, বরং স্বেচ্ছায় উৎসর্গ করেন। দেশের বৃহত্তর স্বার্থের জন্য ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করতে পারলে দেশ উন্নতির পথে অগ্রসর হয়।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close